নবীর সাথে নিসবত সবটাই হুরমত

শায়েখ ড. সাইফুল আজম আযহারীর লেকচার শুনছিলাম৷ অল্প কথায় অধিক মর্মপূর্ণ দলিলনির্ভর খুবই চমৎকার একজন লেকচারার৷ উনার একটি আলোচনায় ‘মোজেজা’ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেছিলেন৷ সেই আলোচনার সামান্য খন্ডচিত্রের আলোকে আমার আজকের শিরোনাম- “নবীর সাথে নিসবত সবটাই হুরমত৷”

যুগে যুগে মানুষদেরকে সঠিক পথ নির্দেশিকার জন্য মহান আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রেরিত অসংখ্য নবী-রাসূলগণ এই পৃথিবীতে আগমন করেছেন৷ তাঁদের মধ্য থেকে কাউকে দিয়েছেন আসমানি গ্রন্থ, কাউকে দিয়েছেন সহীফা (খন্ড অনুলিপি) আবার কাউকে দিয়েছেন শুধুমাত্র ওহী (ঐশী নির্দেশ)৷ কাউকে পাঠিয়েছেন নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের কওমদের (জাতি) জন্য আবার কাউকে পাঠিয়েছেন পুরো বিশ্বজাতির কল্যাণের জন্য৷

এই পৃথিবীতে বিচিত্র জায়গার, বিচিত্র রকমের, বিচিত্র প্রকৃতির মানুষজন রয়েছে৷ কারো সাথে কারো মিল নেই৷ জাত, শ্রেণি, ভাষা, ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি সবকিছুতেই রয়েছে ভিন্নতা৷ ভৌগলিক, সামাজিক, পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক এ পার্থক্যগুলোও বিদ্যমান৷ এতদ্বসত্ত্বেও আমাদের একটা কমন পরিচয় রয়েছে যে, ‘আমরা মানুষ’৷ এবার আসি নবী-রাসূলগণ কিভাবে মানুষদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন! কিভাবে একজন মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে সহজেই আয়ত্তে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, কিভাবে নিজেকে আলাদা করেছিলেন অন্য মানুষ থেকে, কিভাবে বলেছিলেন যে- “আমি স্রষ্টা কর্তৃক আদিষ্ট একজন নবী/রাসূল (সংবাদবাহক), অতএব তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো এবং আমাকে সত্য নবী হিসেবে স্বীকার করো৷”

এই কথাটা শুনার পরই লোকজন বলতো, সে আবার কেমন নবী? সেতো আমাদের মত আহার করে, আমাদের মত বাজারে যায়, আমাদের মত ঘুমায়, সে আবার স্রষ্টা প্রদত্ত নবী হয় কিভাবে?
এর জবাবে মহান জাল্লে জালালুহু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবী/রাসূলদের কিছু ‘এক্সট্রা পাওয়ার’ দিয়ে দিলেন যার নাম ‘মোজেজা’ বা অলৌকিক ক্ষমতা৷ যার মাধ্যমে তিনি অন্য সবার থেকে আলাদা হতে পারেন, মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাদের ঈমানকে মজবুত করতে পারেন৷ প্রত্যেক নবী-রাসূলদেরকে আল্লাহ তাআলা সময় এবং স্থান (Time & place) অনুসারে মোজেজা বা অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছেন, যেটা দ্বারা মানুষকে এমন কিছু দেখানো হয় যা তার আকলের (sense) বিপরীত, যার প্রভাবে সে কনভিন্সড হয়ে যায়৷ আর জাদুবিদ্যা (Magic) ও মুজেজার (Miraculous) মধ্যে এটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পার্থক্য৷ জাদু হচ্ছে শয়তান প্রদত্ত দৃষ্টিভ্রম, ছলনা, প্রতারণা মাত্র৷ আর মুজেজা হচ্ছে স্রষ্টা প্রদত্ত বাস্তব অলৌকিক শক্তি৷ জাদুবিদ্যা ও মুজেজার মধ্যে নিখুঁত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছিল নবী হযরত মূসা (আ.) এর লাঠি মোবারক এবং পাপীষ্ঠ ফেরাউনের সেরা যাদুকরদের সাপের ঘটনার মধ্য দিয়ে৷ যেদিন সকল জাদুকররা মূসা (আ.) এর কাছে পরাজিত হয়ে মাথানত করে ঈমান গ্রহণ করেছিল৷

যাইহোক স্রষ্টা প্রদত্ত এই বিশেষ ক্ষমতা সবার জন্য নির্ধারিত নয়, শুধুমাত্র তিনি যাকে নির্বাচিত করেন, তিনি যাকে চান তাকেই প্রদান করেন৷ সেক্ষেত্রে নবী-রাসূলগণ হলেন সেরা৷ তাই নবী-রাসূলগণ আমাদের মত কোনো সাধারন মানুষ নন, তাঁরা হচ্ছেন মহামানব৷  তাঁদের সাথে কোনোকিছুর নিসবত (সম্পৃক্ত) থাকা মানে আল্লাহর সাথে কোনোকিছুর নিসবত থাকা৷  অর্থাৎ তাঁদেরকে ভালোবাসা মানে আল্লাহকে ভালোবাসা আর তাঁদেরকে কিংবা তাঁদের সাথে সম্পৃক্ত কোনোকিছুকে অবজ্ঞা করা মানে আল্লাহকে অবজ্ঞা করা৷ তাঁদের আনুগত্য করা মানে আল্লাহর আনুগত্য করা, তাঁদের বিরোধীতা করা মানে স্বয়ং আল্লাহর বিরোধীতা করা৷ আর প্রেম, ভালোবাসা, মুহাব্বত ব্যতীত কখনো আনুগত্য আসা সম্ভব নয়৷ তাই নবী-রাসূলগণের সন্মান, শান-মান, ইজ্জত স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বৃদ্ধি করে দিয়েছেন৷ তিনি তাঁদেরকে বিশেষ গুণে বিশেষায়িত করে পাঠিয়েছেন যাতে করে সৃষ্টিকুল আনুগত্য পোষণ করে৷

পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানব ও নবী হযরত আদম (আ.) কে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তাআলা সকল ফেরেশতাদেরকে সিজদা করার নির্দেশ দিলেন৷ একমাত্র ইবলিশ ব্যতীত সকল ফেরেশতাই সিজদা করলো৷ জিজ্ঞেস করা হলে ইবলিশ যদি বলতো যে, “আল্লাহ ভুল করে ফেলেছি, মাফ করে দাও” তাহলে হয়তো ক্ষমা পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকতো৷ কিন্তু ইবলিশ ক্ষমা চাওয়া কিংবা অনুতপ্ত হওয়া তো দূরের কথা বরং সে বলল, আমি কিভাবে আগুনের তৈরি হয়ে মাটির তৈরি আদমকে সিজদা করবো?

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইবলিশের এই খোঁড়া যুক্তিকে কোনোভাবেই এক্সেপ্ট করলেন না৷ প্রথম কারন হল, প্রভুর নির্দেশ উপেক্ষা করা, যেটাতে কোনোপ্রকার যুক্তিতর্ক (Arguments) চলে না৷ দ্বিতীয় কারন হল, মাটি যেহেতু আদম নবীর সাথে সম্পৃক্ত তাই মাটিকে অবজ্ঞা করা মানে নবীকে অবজ্ঞা করা, আর নবীকে অবজ্ঞা করা মানে স্বয়ং আল্লাহকে অবজ্ঞা করা৷ শুধুমাত্র একজন নবীকে অবজ্ঞা করা বা নবীর সাথে নিসবত কোনো উপাদানকে অবজ্ঞা করার ফলস্বরূপ ইবলিশের সাড়ে ছয় লক্ষ বছরের ইবাদত নিমিষেই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল, সব পুণ্য জলাঞ্জলি করে দিল৷ মাত্র একটি অপরাধের ফলাফলে সে ‘মুয়াল্লিমুল মালাইকা’ (The leader of the angels) নাম মুছে দিয়ে ‘চিরঅভিশপ্ত শয়তানে’ (Endless cursed/The Repulsion evil) নামকরণ করা হল৷

এমনিভাবে আল্লাহর এক নবী হযরত সালেহ (আ.) এর ঘটনার দিকে যদি যাই, পাথরের ভিতর থেকে কিভাবে একটি জ্যান্ত উটনী/উষ্টী বের করে আনলেন! পবিত্র কুরআনে যার নামকরণ করলেন ‘নাকাতুল্লাহ’ (আল্লাহর উটনী)৷ কিন্তু এই উটনীর সাথে চরম দুর্ব্যবহার করার কারনে আল্লাহ তাআলা হযরত সালেহ (আ.) এর পুরো কওমকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন৷ শুধুমাত্র একটা উটনীর কারনে গোটা কওম ধ্বংস! কেন?
জবাব একটাই তা হল, এই উটনী ছিল নবীর মুজিজা, নবীর সাথে সম্পৃক্ত, যার নামকরণ স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন করেছেন৷

আবার বিপরীত দিক লক্ষ্য করা যায় সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (দ.) এর ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে৷ একদা উম্মে আয়মান (রা.) আল্লাহর রাসূল (দ.) এর পেশাব মোবারক পান করে ফেলেছিলেন, এটা জানতে পেরে রাসূল (দ.) বললেন, তোমার আর পেটের পীড়া হবেনা এবং তুমি কখনো তৃষার্ত হবেনা৷

এরকম অসংখ্য ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা এটা সাব্যস্থ হয়েছে যে, নবীদের সাথে নিসবত যে কোনোকিছুকে সন্মান করলে সে সন্মানিত হয় আর যে কোনোকিছুকে অসম্মান করলে সে অপদস্থ হয়, ধ্বংস হয়ে যায়৷ সেক্ষেত্রে সমগ্র সৃষ্টি জগতের নবী হুজুরে আকরাম (দ.) হলেন সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র, আমরা তাঁরই উম্মত (জাতি)৷ তাই আল্লাহর রাসূল (দ.) এর সাথে সম্পৃক্ত উনার পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে উনার ঘর, স্ত্রী, আত্নীয়-স্বজন, সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইত সকলেই নবীর সাথে নিসবত৷ তাঁদেরকে সন্মান করা মানে আল্লাহর রাসূল (দ.) কে সন্মান করা আর তাঁদের বিরোধীতা করা মানে আল্লাহর রাসূলের বিরোধীতা করা, আর রাসূলের বিরোধীতা করা মানে স্বয়ং আল্লাহর বিরোধীতা করা৷ তাই নবীদের সাথে নিসবত যেকোনো কিছুই হুরমত (সন্মানিত)৷ অর্থাৎ একজন নবীর শুভাগমন (মিলাদ/জন্ম) থেকে শুরু করে ইনতেকাল (ইহকাল ত্যাগ) করা পর্যন্ত যা যা নিসবত বা সম্পৃক্ততা রয়েছে সবগুলোই হুরমত, পবিত্র, সন্মানিত৷
উদাহরণস্বরূপ- পবিত্র কুরআন শরীফ যেমনিভাবে সন্মানিত তেমনিভাবে তার কভার, কাপড়, রেহালটাও কিন্তু সন্মানিত৷ কারন এগুলো পবিত্র কুরআনের সাথে নিসবত বা সম্পৃক্ত৷

তেমনিভাবে যারা আল্লাহর অতিপ্রিয় বান্দা যেমন ওলী-আউলিয়াগণ, আলেম-তাপসগণ৷ উনারা যেহেতু আল্লাহর রাসূলের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ওয়ারীস (উত্তরসূরি) প্রাপ্ত তাই তাঁদেরকে যেমন সন্মান করতে হবে তেমনি তাঁদের সাথে সম্পৃক্ত সকল বিষয়কেও সন্মান ও মর্যাদা দিতে হবে, আর নচেৎ আমরা নিজেরাই কঠিন অপদস্থের স্বীকার হব কিংবা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবো৷ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক৷ আমিন…

“রাসূল প্রেমে অন্ধ আমি, খুঁজি তাঁহার
চরণধূলি
তাঁরি সুবাস শুঁকে নিয়ে প্রেমপুষ্প
আনি তুলি৷
আহলে বাইতে রাসূল যাঁহারা
মম শিরতাজ,
পূত-পবিত্র অতি, নন দলিল মুহতাজ৷”