করোনা মহামারী মোকাবেলায় আমাদের ভুল সমূহ প্রতিদিন চিহ্নিত হচ্ছে। এই ভুল শুধু বাংলাদেশের না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ অনেকের। আসলে নতুন এই মহামারীর ব্যাপকতা আমরা সবাই শুরুতে বুঝে উঠতে পারিনি।
এখনও এ বিপদ যে কত কঠিন বুঝতে পারছিনা! সরল অথবা বোকার মতো একজন আরেকজনের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছি! প্লিজ এসব বন্ধ করুন। মানুষকে বাঁচাতে হবে। এখনও যে আমাদের সব ভুল চিহ্নিত করা গেছে তাও নয়।
যখন যে ভুল সামনে আসবে তা চিহ্নিত করে প্রতিকারের পথ সহজ করতে হবে। ভুল স্বীকার করা কোন দোষের নয়। ভুল স্বীকার করলে সমাধান সহজ হয়। প্রথমে আমার নিজের ভুল নিয়ে বলি।
এই মহামারীর শুরুতে আমি লিখেছিলাম করোনা মহামারী বাংলাদেশে ছড়াবেনা অথবা এটি ছড়ানোর মতো পরিবেশ বাংলাদেশে নেই। এক্ষেত্রে আমার তখনকার যুক্তি ছিল বাংলাদেশের সমাজ বহুজাতিক নয়।
কারন যে সব দেশে এটি ছড়িয়েছে তাদের সমাজ বহুজাতিক। চীনে এটির উৎস হলেও চীনারা এখন উন্নত বিশ্বের নানা দেশের নাগরিকও। যারা ওই সময়ে চীনা নববর্ষ উৎযাপনে চীনে গিয়েছিলেন।
কিন্তু আমার এই ধারনা অথবা যুক্তি ভুল প্রমানীত হয়েছে। আসলে মহামারীর সঙ্গে এসব ধারনা করা চলেনা। আর এই মহামারী বিশ্বের নানা অঞ্চলে নানান চেহারা দেখিয়েছে। বাংলাদেশে আসা করোনার চরিত্র বেশি ধংসাত্মক।
ইতালি থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রোগটা নিয়ে এসেছেন বলে শুরুতে আমরা ক্ষিপ্ত হয়েছি। এটিও ছিল একটি ভুল রাগ। শুধু ইতালি প্রবাসী নয় এটি যে কোন প্রবাসী বাংলাদেশির মাধ্যমে এটি দেশে আসতে পারতো। এবং এসেছেও।
যেহেতু আমরা এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছি। আমাদের যে কারোর মাধ্যমে রোগটি বাংলাদেশে পৌঁছতে পারতো। তা এমন নানা বাহকের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনা পৌঁছবার পর ঈদ সংখ্যায় ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় সৌদি আরব কাবা ঘর বন্ধ করেছে। আর যে কাবার দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানরাও নামাজ পড়েন, বাংলাদেশ সে মসজিদ বন্ধ রাখার সাহস দেখাতে পারেনি। আওয়ামী লীগের আবার শয়তানের ভয় বেশি।
কারন শয়তানরা আওয়ামী লীগকে সারাক্ষন চোখে চোখে রাখে। গার্মেন্টস সহ নানাকিছু খুলে দিতে হয়েছে। লোকজন লঞ্চে ফেরীতে গাদাগাদি যাওয়া আসা করেছেন। করোনা ছড়িয়ে পড়ার মোটামুটি যা যা দরকার ছিল সব হয়েছে বাংলাদেশে।
এই মহামারীর উৎস দেশ চীন। লকডাউন শব্দটিও সেখান থেকে এসেছে। চীন যে ধরনের পুলিশি রাষ্ট্র, তাদের সামর্থ্য, চিকিৎসা সামর্থ্য এসব থেকে বাংলাদেশ বহুদূর পিছিয়ে। চীনের মতো করে পরিস্থিতি মোকাবেলা আর কেউ করতে পারেনি।
বাংলাদেশে আরেকটি ভুল ধারনা শুরু থেকে চালু হয়ে গেছে। যেমন অনেকেই মনে করেছেন এই রোগ আর মহামারী বুঝি আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার দোষ! অথবা এটি সামলানোর দায়িত্ব শুধু সরকার অথবা শেখ হাসিনার।
কিন্তু মহামারী যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সামাল দিতে পারেনা। বাংলাদেশে এখন শেখ হাসিনার মতো একজন সর্বক্ষনিক আন্তরিক এবং পরিশ্রমী প্রধানমন্ত্রী আছেন। এখানে সবারই একটি কর্মঘন্টা অথবা ছুটিছাটা আছে। যা শেখ হাসিনার নেই।
মহামারীর এই সমস্যাটি মোকাবেলা যে কোন দেশের জন্যে চিকিৎসা এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশের সামর্থ্য কী তা আমরা জানি। বাংলাদেশে সামর্থ্য সীমিত বলেইতো আমরা এভাবে এক কোটি মানুষ দেশের বাইরে থাকি।
বিদেশে আয় করে দেশে টাকা পাঠাই বলেইতো আমাদের মায়েদের পরিবারগুলো ভালো চলে। দেশের সামর্থ্য ভালো থাকলেতো আমরা বিদেশ যেতাম না। উল্টো বিভিন্ন দেশের এক-দেড় কোটি লোক কাজ করতে বাংলাদেশে আসতেন।
তাতে করে বাংলা শিক্ষার আইএলটিএস চালু হতো। লোকজন বাংলা শিখে কাজের জন্যে বাংলাদেশে যেতো। এতদিন দেশের যারা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক যেতেন সেই জ্ঞানপাপীরা এখন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে বেজায় অসন্তুষ্ট!
বিরক্তি সহ ঘনঘন ফেসবুকে স্টেটাস লিখছেন, বাংলাদেশে শতশত আইসিইউ ভেন্টিলেটর নেই কেনো! সরকার এগুলো বানায়না কেনো! এখনও বানাচ্ছেনা কেনো! এটি ব্যর্থ রাষ্ট্র, ইত্যাদি!
যেন এখন চাইলেই গন্ডায় গন্ডায় বানানো হয়ে যাবে আর কী! শুধু বলা বাকি রেখেছে এই যে আমেরিকায় এক লাখের বেশি মরলো এর দোষও শেখ হাসিনার! ব্রাজিলেও লোকজন শেখ হাসিনার জন্যে মরছে!
অথচ এ ধরনের একটি বৈশ্বিক মহামারী মোকাবেলার মতো স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামো বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশের যত নেতা এই সময়ে টকশো করেছেন তারা যার যার কর্মীদের ঘরে থাকার জন্যে বললেও সংক্রমন বেশ কম হতো।
মানুষকে ঘরে রাখতে অস্ট্রেলিয়া এবারও দেশটির সিনিয়র নাগরিকদের ব্যাংক একাউন্টে বাড়তি ৭৫০ ডলার করে দিয়েছে। যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদেরকে সপ্তাহে দিয়ে যাচ্ছে ৫৫০ ডলার।
যাদের কাজ আছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ বেতন দিতে পারছেনা তাদেরকে সপ্তাহে ৭৫০ ডলার করে দিয়ে আসছে সরকার। আর বাংলাদেশের আড়াই হাজার টাকা দেয়া নিয়ে ঘটলো কত কান্ড-কীর্তি! অথচ চীনপন্থী লকডাউন শব্দটি বাংলাদেশেও জনপ্রিয়!
এই মহামারীতে বিপর্যস্ত হওয়াতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক আয়সূত্রগুলোও এখন বিপর্যস্ত। সরকার স্বাভাবিক সময়েও ব্যাংক থেকে ঋণ করে চলতো। কারন আঠার কোটি মানুষের দেশ হলেও এখানে করদাতার সংখ্যা পঞ্চাশ লাখের কম।
কিন্তু পরিশ্রমী, অল্পে সন্তুষ্ট মানুষ আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নাটকীয় অগ্রগতির সূচনা করেছিল। করোনা মহামারী দুনিয়ার নানাদেশের মতো বাংলাদেশের সব হিসাব-নিকাশকেও লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।
দারিদ্র বিতাড়নের কাহিনী চলে গেছে কিতাবে। শহরের স্বল্প আয়ের মানুষেরা আয় হারিয়ে পরিবার পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামে। কিন্তু শেখ হাসিনার সমানতালে কাজ করা আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় কোন নেতাকে এমন সক্রিয় দেখা যায়নি।
আর বিএনপির মির্জা ফখরুল-রিজভিগং পুরনো বক্তৃতা দিয়েই চলেছেন! কারন কাজ তাদের আগেও করতো হতোনা। এখনও করেননা। বারো বছর ধরে ক্ষমতায় নেই। কিন্তু তাদের সংসার চালানোর আয়সূত্র এখনও কেউ জানেনা।
এই সময়ে দরকার ছিল দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ঐক্য। বাংলাদেশে এক সময় রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক দূর্যোগের সময় টিএসসিতে শুকনো খাবারের প্যাকেট বানাতেন দিনের পর দিন। তারা এখন ফেসবুকে।
সরকার কিস্যু করছেনা! কবে সুশাসন আসবে এসব উদ্বেগে তারা ঘুমাতে পারেননা! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন হয় তখন কেউ ভাবতে পারেনি নতুন স্বাধীন দেশে আইয়ুব খানের স্টাইলের সামরিক রাজনৈতিক দলও আবার হবে।
বাংলাদেশের বিএনপি-জাতীয় পার্টি এগুলো সামরিক পেটে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দল। এবং এন্টি আওয়ামী লীগ দল হিসাবে বিএনপি দেশে জনপ্রিয়ও। দেশের অন্যতম শীর্ষ রাষ্ট্র বিজ্ঞানী বিএনপির সিনিয়র উপদেষ্টা!
দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে এরা ধংস করেছে। ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাকর্মী দেশে এখন সরকারি দলেও কম। সহমতভাইরা এখন ফেসবুকে বসে সারাক্ষন নেতার পোষ্টে লাইক শেয়ারের ঝড় তোলার কাজে ব্যস্ত।
ঘরের আসল খবর জানেন বলে শেখ হাসিনা ত্রান কার্যক্রমও প্রশাসন দিয়ে চালাচ্ছেন। প্রশাসনে চমৎকার মানবিক গুনাবলীর ছেলেমেয়েরা ইউএনও, ডিসি পদে চলে আসায় ত্রান দুর্নীতির অভিযোগও কম। পুলিশ বাহিনী চমৎকার বদলে গেছে।
সেনাবাহিনী সিভিল প্রশাসনের পক্ষে চমৎকার কাজ করছে। স্বাস্থ্যখাত শুরুর দিকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেও সে সংকট কাটিয়ে উঠেছে। তরুন ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরলস কাজ করছেন।
এদের অনেকে, পুলিশ-মিডিয়ার সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন মারা যাচ্ছেন, কিন্তু কোথাও কাজ থেমে নেই। বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের সামর্থ্য আমরা জানতাম। জরুরি ভিত্তিতে এই সামর্থ্য বাড়ানোর যে সব কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে তা আশাব্যঞ্জক হলেও পর্যাপ্ত নয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক এবং সর্বক্ষনিক বলে কোন কাজই থেমে নেই। এখন মানুষ মারা যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের মৃত্যুর মাধ্যমে পাওয়া স্বাস্থ্যখাতের এসব অগ্রগতি-প্রাপ্তি ভবিষতে কাজে লাগবে।
স্বাস্থ্যখাতের নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিএনপি নিত্য অভিযোগ করে যাচ্ছে। তারা ক্ষমতায় থাকতে দেশ বেহেস্তে ছিলোনা। এখন অভিযোগ না করে কিভাবে মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো যায় তা নিয়ে তারা কাজ বাড়ালে দেশ উপকৃত হবে।
মানুষকে সচেতন করতে বিএনপির বক্তব্য বাড়ানো উচিত। যেহেতু এই সংকট দীর্ঘদিন চলতে পারে অর্থনীতিরও ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে তাই ত্রান কার্যক্রম নিয়ে সরকারের একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত। যার যা খুশি ত্রান বিলি বন্ধ করতে হবে।
রোহিঙ্গা ত্রান যেমন প্রশাসনের মাধ্যমে বিলি হয়েছে তেমনি এক্ষেত্রেও সে মডেল অনুসরন করা যেতে পারে। বিএনপি বা যে কেউ ত্রান দিতে চাইলে তা সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউএনও বা ডিসির কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
বিলি করার সময় তারা সঙ্গে থাকবেন, এ সিদ্ধান্ত হলে কাজটি সংগঠিত হবে। বিএনপি বলছে তারা ৫৬ লাখ মানুষকে ত্রান দিয়েছে। তা দিয়ে থাকলে ভালো। সরকারি সংঘবদ্ধ ত্রান কার্যক্রমে বিএনপির ত্রান জমা হলে প্রকৃত হিসাব থাকব।
পূর্ব রাজাবাজারের মতো যে সব এলাকা লকডাউন হবে সে সব এলাকায় এমন সংঘবদ্ধ ত্রান কার্যক্রম চালাতে হবে। বিএনপির কাছে ত্রান বিলিতে বাধার অভিযোগের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ চেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক।
শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব বিএনপির পিপিই সামগ্রী গ্রহন করায় প্রেস ক্লাব ঘেরাও করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নানান অঙ্গ সংগঠন। প্লিজ এই বিপদের সময় এসব ফাজলামো বাদ দিন। বিএনপি পিপিই দিয়েছে আপনারাও দিন।
এরজন্যে প্রেসক্লাব ঘেরাও করতে হবে কেনো? এসব কার্যক্রম করোনা মোকাবেলায় সরকারের কার্যক্রম, নির্ঘুম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিশ্রমকে খাটো করে। অর্থনৈতিক দূর্দশায় ঢাকায় বাড়িভাড়া দিতে না পেরে লোকজন গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন।
এটিই দেশের বাস্তবতা। সবাই মিলে এ পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এই বিপন্ন মানুষদের সহায়তা করা গেলে সেটিই হবে আসল সহায়তা। মানুষ বাঁচলে রাজনীতি করা যাবে। সবাই ভুল থেকে শিক্ষা নিন প্লিজ।