এরশাদ-খালেদা যুগে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বাংলাদেশে ছিল। দাপটে তারা রাজনৈতিক দল করেছে। তাদের মিল্লাত নামের একটি দৈনিক পত্রিকাও ছিল। খুনি ফারুক থাকতো বনানীর পুরনো ডিওএইচএস এর একটা বাড়িতে।
এয়ারপোর্ট রোডের কাছে সেই বাড়িটা এমন জায়গায় ছিল যাতে যে কোন মূহুর্তে সেখান থেকে পালিয়ে চলে যাওয়া যায়। সাংবাদিক হিসাবে একাধিকবার তার সঙ্গে সে বাড়িতে আমার কথা হয়েছে।
ফারুকের বাড়িতে সর্বশেষ গিয়েছিলাম খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটার বিহীন নির্বাচনের দিন। খুনি ফারুক সে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। তবে খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টিকে তখন বিরোধীদলের আসনে বসানোর উদ্যোগ নেন খালেদা জিয়া!
এর আগে এরশাদ ফারুককে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহন করিয়ে সারাদেশ সরকারি খরচ-প্রহরায় ঘোরার ব্যবস্থা করে দেন। খুনি ফারুক আমাকে তখন বলেছিল, জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া তাদের কাছে সুযোগমতো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।
কারন পচাত্তরে তাদের ওই ঘটনার ওপরে ভর করেই এই তিন জন বাংলাদেশের ক্ষমতায় গেছেন। নতুবা এরা আর দশজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বা তাদের স্ত্রীর ভূমিকায় বড়জোর রাওয়া ক্লাবে গিয়ে হ্রাসকৃত মূল্যে মদ খেতেন।
অথবা সেটেল্ড করতেন দেশে-বিদেশে কোথাও। গলফ খেলতেন। কিন্তু রাজনীতি করে দেশের রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী হবার মতো ক্যারিশমা তাদের ছিলনা। বিশেষ একজনের গোপন কথা একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল ফারুক।
স্বামীর মত্যুর পর এক বিয়ে পাগলা জেনারেল তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ট্র্যাডিশনাল আর্মি বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেবেনা এরজন্যে তারা এতে রাজি হননি। যে কোনভাবে হোক খবরটি তার কানে চলে যায়।
এরপর থেকে তিনি সেই জেনারেলের ওপর এতোটাই ক্ষিপ্ত হন যে তাকে কোনভাবেই সহ্য করতে পারেননা। কাজেই পুরো বিষয়টিই তাঁর ব্যক্তিগত ক্রোধের। অন্য কোন বিশেষ কারন বা রাজনৈতিক মতাদর্শের নয়।
পচাত্তরের হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে কথা তুলতেই খুনি ফারুক নানা আস্ফালন করতো। এমন ভাব করতো যে সে কাউকে ভয়-ডর করেননা। কিন্তু কথায় কথায় তার ভয়ডরের বিষয়গুলোও প্রকাশ পেয়ে যেত।
তার মধ্যে এক ধরনের ঘাড় ত্যাড়া একটা ভাবও ছিল। যেমন তার একটা ধারনা ছিল ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ডের কারনে কেউ তাদেরকে বিচারের সম্মুখিন করতে পারবেনা। তারা বিশ্বাস করতো ইনডেনিটি অধ্যাদেশ তাদের রক্ষা কবজ।
তাদের বিচার করা মানে দেশের সেনাবাহিনীর গায়ে হাত দেয়া! এরজন্যে কেউ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বা তাদের বিচারের উদ্যোগ নেবেনা। এরজন্যে এই খুনি সব সময় সরাসরি একটা কথা বলতো, পারলে তাদের বিচার করুক।
আরেকটি ধারনা ছিল ফারুকের। তাহলো আওয়ামী লীগ আর কোন দিন ক্ষমতায় আসতে পারবেনা। অন্তত আমেরিকা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেবেনা। এই ধারনা কিন্তু ডক্টর কামালেরও ছিল।
এরজন্যে ১৯৯১ সালে তিনি নির্বাচনী প্রচারনা থেকে নিজেই পিছিয়ে আসেন। সেই নির্বাচনে মিরপুর আসনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের তিন দিন আগে তিনি হঠাৎ করে তার কর্মীদের বলেন তার হাতে টাকাপয়সা নেই।
নির্বাচনের ক্যাম্প চালানোর কোন খরচাপাতি দিতে পারবেননা। ওই নির্বাচনে মিরপুরের খালেক ডক্টর কামালকে হারিয়ে এমপি হন। খালেকের মতো একজন প্রার্থীর কাছে ডক্টর কামালের হার নিয়ে তখন মিডিয়ায় হাসাহাসিও হয়।
কিন্তু শেষ মূহুর্তে প্রচারনা থেকে সরে আসার বিষয়টি তখন শুধু তাঁর বিশেষ কিছু নির্বাচনী কর্মীরাই জানতেন। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি ফারুকের দাবি মতো সে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।
এর আগে পর্যন্ত এই খুনি পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু ফারুকের দাবি ছিল বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে এটি সে জানতোনা! মুক্তিযুদ্ধের খবর সে নাকি জানতে পারে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে!
লন্ডনের সানডে টাইমসের এক রিপোর্ট পড়ে! এরপর সে আবুধাবী চলে যায়। সেখান থেকে লন্ডন-দিল্লী হয়ে কলকাতা এসে জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসাবে যোগ দেয়। কিন্তু প্রচার আছে ফারুক যুদ্ধে যোগ দিয়েছে পাকিস্তানি এসাইনমেন্টে!
কিন্তু ফারুক সেটা স্বীকার করেনি। খুনি ফারুক দাবি করে পচাত্তরে তাদের প্ল্যান ছিল বঙ্গবন্ধু আর শেখ কামালকে বন্দী করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু তাদের প্ল্যানমাফিক কাজ করেনি। বন্দুক হাতে থাকলে সব কাজ প্ল্যান মাফিক হয়না।
তার দাবি বঙ্গবন্ধু তখন চার দিকে ফোনে কথা বলছিলেন। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের লাইন খারাপ ছিল। তার ধারনা বঙ্গবন্ধু যদি ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন, তাহলে হয়তো ভিন্ন স্টোরি হতো।
তিনি যদি আরও আধঘন্টা সময় পেতেন তাহলে তারা হয়তো হেরে যেতেন। বাংলাদেশ নাকি তাতে ভারতের করদ রাজ্য হয়ে যেত! এসব নিয়ে কথা বলার সময় খুনি ফারুকের চোখেমুখে কোন অনুশোচনা ছিলোনা।
ফারুক বলেছে ১২ আগষ্ট তার বিবাহ বার্ষিকী ছিল। এ উপলক্ষে সে বেশি খরচ করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই পনের আগষ্ট তারা সফল না হলে সে বিপদে পড়ে যেত। কারন ওই ঋণ শোধের সামর্থ্য তার ছিলনা।
১৫ আগষ্টের সাফল্যের জন্যে খুনি ফারুক আওয়ামী লীগের লোকজনকে কৃতি্ত্ব দিয়েছে! ফারুকের বক্তব্য তারা সংখ্যায় অল্প ছিলেন। কামানে গোলা ছিলোনা। ওই অবস্থার ভিতর কিছু গোলা অজ্ঞাত লোকজন রহস্যজনক কায়দায় সরিয়ে ফেলেছিল!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতির কর্মসূচি উপলক্ষে রক্ষী বাহিনীর বড় কয়েকটি বহরকে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কাজেই আওয়ামী লীগের লোকজন যদি পথে নামতো, রক্ষীবাহিনীর ওই সব বহরকে যদি কাজে লাগানো হতো তারা বিপদে পড়ে যেত।
কর্নেল জামিলের হত্যা সম্পর্কে ফারুকের বক্তব্য ছিল ধানমন্ডির ২৭ নাম্বার থেকে শুক্রাবাদ পর্যন্ত রাস্তা তারা ব্লক করে রাখে। সে সময় জামিল বত্রিশ নাম্বারের দিকে আসছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল রক্ষী বাহিনীর ১২ টি ভ্যান।
জামিলকে থামতে বলা হয়। কিন্তু তিনি তা না শোনায় তাকে তারা গুলি করে। সেখানেই পড়ে যান জামিল। পরে ফারুক সেখানে গিয়ে দেখে রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা সেখানে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।
খুনি ফারুক বলেছে নাইনথ ডিভিশনের হেড কোয়ার্টারের দিকে সে একটা ট্যাংক নিয়ে যাচ্ছিলো। ট্যাংকে কোন গোলা ছিলোনা। ওখানে গিয়ে দেখে রক্ষী বাহিনীর পাঁচ হাজার সশস্ত্র সদস্য দাঁড়িয়ে। এত ফোর্স দেখে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
পরে জেনেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির নিরাপত্তার জন্যে তাদের সেখানে নেয়া হয়েছিল। পনের আগষ্টের ছক সাজানোর সময় এই ফোর্সের বিষয়টি তাদের মাথায় ছিলোনা। কাজেই সেখানে এভাবে তাদের সশস্ত্র অবস্থায় দেখে সে ঘাবড়েও যায়।
খুনি ফারুকের বক্তব্য, এরা যদি পাল্টো মুভ করতো তাহলে তাদের বিপদ হয়ে যেত। রক্ষী বাহিনীর এত সদস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো সেনা সদস্য তখন ঢাকা সেনানিবাসেও ছিলোনা। কিন্তু কার্যত তাদের কেউ কোথাও বাধা দেয়নি।
আওয়ামী লীগের লোকজনকে ভিতুর ডিম উল্লেখ করে এই খুনি বলেছে, খুনের পর এর নেতারা পোর্টফোলিও পাবার জন্যে তখনই তদবির শুরু করে দেয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদের জন্যে ফোন করে অনুরোধ করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধীরী।
ইনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করায় তাদের অবশ্য লাভও হয়। খুব তাড়াতাড়ি তিনি কূটনৈতিক পক্ষগুলোকে তাদের পক্ষে নিয়ে আসে। এসব সমর্থন এত তাড়াতাড়ি এসেছে যে তা তাদের ধারনারও বাইরে ছিল। ভারতের তরফ থেকেও আর কোন বাধা আসেনি।
ফারুক বলেছে, বঙ্গবন্ধুকে(তিনি সব সময় বলছিলেন শেখ মুজিব) সে চিনতোনা। তাঁর সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। তবে শেখ কামালের সঙ্গে কিছুটা জানা শোনা ছিল। তিনি তাকে বাসায় যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সে কখনো যায়নি।
এই পরিবারের দুই নববধূ, নারী শিশুদেরও হত্যা প্রসঙ্গে ফারুকের দাবি এটি অবস্থার প্রেক্ষিতে ঘটেছে। মিলিটারি অপারেশনে সবকিছু প্ল্যান মাফিক কাজ করেনা। তাদের লোকজন নার্ভাসনেসে ভুগছিল। কিন্তু এ নিয়ে কোন অনুশোচনা দেখায়নি এই খুনি।
পাশা উল্টে গেলে এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। সরকারি খরচে ও ব্যবস্থায় তাদের প্রথম ব্যাংককে নেয়া হয়। সেখান থেকে লিবিয়ায়। জিয়ার পক্ষে জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
জিয়া তাকে রাষ্ট্রদূতের চাকরি অফার করেন। তিনি তা গ্রহন করেননি। ১৯৭৬ সালের মে মাসে তিনি দেশে চলে আসলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে রাখা হয় প্রায় চার বছর। এরপর জেল থেকে বেরিয়ে আবার লিবিয়া চলে যায়।।
লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। ফারুক সেখানে একটি ব্রিটিশ নির্মান কোম্পানিতে কাজ নেয়। বিমানের হ্যাঙ্গার তৈরি করতো এই কোম্পানি। ফারুক তখন দেশে পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আজমের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
তার বক্তব্য, এই লোকটি এদেশে কী করে আছে, কিভাবে ভিসা পাচ্ছে, তার ভিসা নবায়ন কী করে হচ্ছে এটা সে ভেবে পায়না। এর একটা মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। এরশাদ আমলে দেশে রমজান মাসে হোটেল রেস্তোরা বন্ধের নির্দেশ জারি হয়।
ফারুক বিষয়টিকে ফালতু ব্যাপার উল্লেখ করে বলে, এরশাদের ব্যক্তিজীবনে ইসলামী আদর্শের কোন চর্চা নেই। বরং বিরোধিতা আছে। জিয়ার ব্যাপারে ফারুকের বক্তব্য ছিল, রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি দূর্নীতিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
এন্থনী মাসকারেনহাসের বই ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইটি সম্পর্কে ফারুক বলেছিল, এতে তথ্যগত বিভ্রান্তি খুব বেশি নেই। তবে বইটিতে ঘটনাগুলোর অতিরিক্ত লোমহর্ষক বর্ননা দেয়া হয়েছে। পড়ে মনে হচ্ছিল ওয়েস্টার্ন থ্রিলার কাহিনী পড়ছি।
ফারুক আমাকে আস্ফালন করে বলতো বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলানোর তাদের প্ল্যান ছিল! যার নামে বাংলাদেশের সৃষ্টি সেই জাতির পিতার প্রতি কি ঔদ্ধত্যের উক্তি-চিন্তাভাবনা ছিল খুনিদের!
অতঃপর ফাঁসির দড়িটা তার গলাতেই উঠেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে দেখে খুনি রশিদরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ঘাড়ত্যাড়া ফারুক যায়নি। ওই যে তার মাথায় ছিল কেউ তাদের গায়ে হাত দিতে পারবেনা!
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে প্রথম সুযোগেই ফারুক সহ দেশে থাকা সব খুনিদের গ্রেফতার করে গারদে ঢোকায়। ফাঁসিটা তাদের খালেদা বিলম্বিত করতে পেরেছেন। কিন্তু আটকাতে পারেননি।
বাংলাদেশের জাতির পিতাকে হত্যার খুনি ফারুকদের ফাঁসিতে প্রাণ খোয়ানোর পর তাদের পরিজনেরও এখন দেশেবিদেশে পরিচয় লুকিয়ে পালিয়ে দিন কাটে। সেই খুনি ডালিমও আর কোন দিন প্রকাশ্যে আসার সাহস করেনি।