যুক্ত ভাবে লিখেছেন:- অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ ও ড. সোচনা শোভা
করোনাভাইরাস আক্রান্ত প্রতিটি রাষ্ট্র ও জাতির জন্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের সুষ্ঠু বণ্টন বিশ্বনেতাদের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। সবার জন্য স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নে অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের একটি তালিকা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সেই তালিকার ওষুধের প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে বিশ্বমানের একটি কাঠামো রয়েছে, যেটাকে ভিত্তি করে বিশ্বনেতারা সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে, কোভিড-১৯ এর মতো বিশ্বব্যাপী মহামারির প্রতিক্রিয়ায় ভ্যাকসিন সরবরাহের নিমিত্তে সর্বজনীন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণকারী এমন কাঠামো তৈরি করা হয়নি।
বর্তমানে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিতে মূলত তিনটি ভ্যাকসিন রয়েছে। একটি রাশিয়া থেকে আসছে, অন্যটি চীন থেকে এবং অপরটি যুক্তরাজ্য থেকে বাজারজাত করার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে এটি প্রকাশিত হয়েছে যে, ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতার জন্য দরিদ্র দেশগুলোতে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করা হবে এবং যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষা চলছে। অতীতে আরও অনেক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল গরিব দেশে হয়েছে। সুতরাং, তাদের অবদান সঠিকভাবে মূল্যায়ন হওয়া দরকার।
সহযোগী উদ্ভাবনের সুবিধা ভাগ করে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক কোনো নিয়ম নেই। এ ক্ষেত্রে, কোনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যায়বিচারের নীতিও নেই যা জাতির মধ্যে ভ্যাকসিনগুলো সুষ্ঠু বিতরণের জন্য প্রয়োগ করা যেতে পারে।
নীতি-দার্শনিকদের মধ্যে একটি প্রবণতা রয়েছে- জন রলসের পার্থক্যের নীতি (the greatest benefit of the least advantaged members of society) ধারণাকে প্রয়োগ করে বণ্টনের নীতিমালা প্রণয়ন করা। কিন্তু রলস নিজেই বলেছেন, তার ন্যায়বিচারের নীতিগুলো কেবল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের বেলায় প্রযোজ্য। বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন বিতরণে জন রলসের নীতির ভিত্তিতে যদি বণ্টননীতি গ্রহণ করা হয়, তবে সুবিধাবঞ্চিত দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর উদ্ভাবন থেকে সুবিধা পেতে পারে। এই বণ্টন কি কোনো জাতি তাদের জনসংখ্যার ভিত্তিতে আনুপাতিকভাবে প্রাপ্য হওয়া উচিত?
যুক্তরাজ্য ভ্যাকসিনের আবিষ্কারক এবং ভারত ভ্যাকসিনের প্রধান নির্মাতা। তদুপরি, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষার আয়োজন করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, আমিরাত চীনের ভ্যাকসিনের পরীক্ষার আয়োজন করছে। অস্ট্রেলিয়া তাদের নিজস্ব ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে। তারা ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার জন্য কোনো দেশ বেছে নেয়নি। যদি বাংলাদেশ চীনের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করে, তবে চীন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সুবিধা পাচ্ছে- কেন বাংলাদেশকে সমানভাবে বরাদ্দ করা হবে না যদি বাংলাদেশের উৎপাদন ক্ষমতা থাকে। যদি অক্সফোর্ড ব্যর্থ হয়, তবে কেন ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমানভাবে বিবেচনা করা হবে না- কারণ তারা তাদের সাফল্যের জন্য বাকি বিশ্বের মানুষকে সুবিধা দেবে।
এই জটিল ও যৌক্তিক সমস্যাগুলোর একটি সন্তোষজনক উত্তরের প্রয়োজন। ক্লাসিক্যাল নৈতিক নীতিগুলো ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের সুবিধাগুলো বিতরণের জন্য কার্যকর হতে পারে কি?
জন রলসের প্রিন্সিপল অব ডিফারেন্স পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নেওয়ার কথা বলে। সেই বিবেচনায় স্বল্প আয়ের দেশগুলো বিবেচনায় আসতে পারে। কিন্তু যারা আবিষ্কার করল, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হয় কি না সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়।
অক্সফোর্ড যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় আজ যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে সেটির পেছনে যুক্তরাজ্যের কলোনিভুক্ত দেশগুলোর অবদান আছে। অনুরূপ একটি ধারণা ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ ফেরার সময় ব্রিটিশ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে দিয়েছিলেন। সুতরাং, প্রথম বিবেচনায় যুক্তরাজ্য ভ্যাকসিন পেলেও অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ ৫৩টি রাষ্ট্র ভ্যাকসিনের দাবি নৈতিকভাবে করতে পারে। আনন্দের বিষয় হলো, ভারত অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন বাংলাদেশের সঙ্গে শেয়ার করবে বলে জানিয়েছে।
পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবনীতিবিদ এজকাল ইমানুয়েল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে দেশগুলোর, শুরু থেকেই তালিকার শীর্ষে সে দেশগুলোর থাকা উচিত।
ভ্যাকসিন বণ্টনের বিষয়টি তিনি পরিস্থিতিকে উপচেপড়া জরুরি বিভাগে আগত রোগীদের মুখোমুখি একজন চিকিৎসকের সঙ্গে তুলনা করেন। ডাক্তার ওয়েটিং রুমে প্রবেশ না করে বললেন: ‘আমি ওয়েটিং রুমে বসে থাকা প্রত্যেককে তিন মিনিট সময় দিচ্ছি।’ ডাক্তার আরও বলেছেন: ‘ঠিক আছে, সবচেয়ে গুরুতর অবস্থায় কে আছেন? আমি প্রথমে তাদের সেবা দিতে যাচ্ছি।’ এই রকম একটি মুহূর্তের কথা উল্লেখ করে ইমানুয়েল বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড বা আফ্রিকার অনেক দেশে ভ্যাকসিন পাঠানো হলে কোভিড-১৯ থেকে মৃত্যুর পরিমাণ কমাতে তেমন কিছু করতে পারবেন না; কারণ এই দেশগুলোতে সংক্রমণের হার কম। তিনি বলেন, এই (দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড বা আফ্রিকার অনেক দেশ) ভ্যাকসিন অন্য কোথাও ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিলে আরও সুফল অর্জন করা যেতে পারে।
তবে ডব্লিউএইচওর ব্রুস অ্যালওয়ার্ড মন্তব্য করেছেন যে নতুন প্রাদুর্ভাবগুলো হঠাৎ করে নতুন জায়গায় সংক্রমণ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, আমরা একটি সর্বব্যাপী হুমকি (ভাইরাস) এবং সর্বব্যাপী দুর্বলতা (অত্যন্ত সংবেদনশীল উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী) নিয়ে কাজ করছি। অতএব আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দ্রুত ঝুঁকি হ্রাসের দিকে যাওয়া উচিত।
আসুন, স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভ্যাকসিন ক্রয় ও বিতরণের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী মহামারি কোভিড-১৯ মোকবেলা করার জন্য ডব্লিউএইচওর নীতি পরীক্ষা করি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের নীতিমালা ‘ন্যায্য বরাদ্দ মেকানিজম’ দুটি পর্যায়ে ভ্যাকসিন বিতরণের প্রস্তাব করেছে। প্রথম পর্যায়ে, সব দেশ তাদের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে ভ্যাকসিন পাবে; প্রাথমিকভাবে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন তাদের জনসংখ্যার ৩ শতাংশের সমান পরিমাণ দেওয়া হবে। সেখান থেকে, প্রথম ডোজ স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক যত্নের সম্মুখভাগের কর্মীদের দেওয়া হবে।
তারপরে, কোনো জাতির ২০ শতাংশ জনসংখ্যার সমপরিমাণ না পাওয়া পর্যন্ত অতিরিক্ত ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে। ডব্লিউএইচও অনুমান করে যে এই ডোজাগুলো কোভিড-১৯ থেকে সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের টিকা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে: বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের কম্বারবিডিটিস রয়েছে তাদের।
ডব্লিউএইচও কাঠামোটি প্রস্তাব দেয় দুটি মানদণ্ড অগ্রাধিকার সিদ্ধান্ত নিতে ব্যবহার করা উচিত: ভাইরাসটি কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে (কার্যকর প্রজনন সংখ্যা) এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা বা হামের মতো অন্যান্য রোগজীবাণু একই সাথে ছড়াচ্ছে কি না; এবং হাসপাতালে শয্যা ও নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের অধিগ্রহণের মতো মেট্রিকের ওপর ভিত্তি করে কোন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটা দুর্বল সেটা বিবেচনা করা।
আমরা যে নীতিমালা ডব্লিউএইচও থেকে পেয়েছি তার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে- কীভাবে ধনী দেশগুলোর জাতীয়তাবাদী চিন্তা এবং বিদ্যমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলে। আমরা এটাও জানি, যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউএইচও থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আমরা বিভিন্ন মহল থেকে ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আলোচিত হতে দেখছি। আমরা এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছি। এমন একটি পরিস্থিতিতে অতীতের মতো স্বল্প আয়ের দেশগুলো বঞ্চনার শিকার হবে বলে অনুমান করতে পারি।
বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে বিপদের মধ্যে আছে অনুমান করা যায়। এ সময় সবাইকে শান্ত থাকতে হবে এবং হটকারী সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকতে হবে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পুরো জাতি বিভাজিত। মাত্র ৩ শতাংশ ভোটার কোনো পক্ষ গ্রহণ করেননি। সুতরাং, বিষয়টা সবাইকে ভাবনায় ফেলছে। মহামারির এই সময়ে রাজনীতিকে দূরে রাখা খুবই জরুরি। কিন্তু সেটার পরিবর্তে চারপাশ থেকে ভিন্ন খাতে দৃষ্টি ফেরানোর অপচেষ্টা চলছে। বিশেষ করে ভারতের পত্রিকা ও দলগুলো বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যা খুবই বেদনাদায়ক।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো যেভাবে আবর্তিত হচ্ছে, তাতে ভয়ের অনেক কারণ আছে। ভারত ও চীন উভয়ে বলেছে তারা ভ্যাকসিন শেয়ার করবে। অপরদিকে রাশিয়া বাংলাদেশে ভ্যাকসিন দিতে সম্মতি প্রকাশ করেছে। এখনো কোনো জাতীয়তাবাদী চেতনা আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারেনি। পৃথিবীর অন্য কোথাও ভ্যাকসিন নিয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি হোক কারও কাম্য নয়। জাতিসংঘে এখনো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বিতর্কে যুক্ত। ভয়ের কারণ এখানেই অনেকের।
‘বাংলাদেশ ভালো থাকুক’- এই যদি আমাদের সবার নীতি হয়, তবে আমাদের সতর্ক আচরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে যাতে ধনী দেশগুলো উঠতে পারে, সেজন্য আমাদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বন্ধুত্বকে মর্যাদা দিতে আমরা আমাদের পুরনো বন্ধুদের যেন সম্মান করি। এ রকম ভারসাম্যমূলক নীতির চর্চা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। আশা করি, বাংলাদেশ সরকার সব বন্ধুরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হবে এবং মহামারি থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন সংগ্রহে সফল হবে।
লেখকদ্বয় যথাক্রমে: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ – শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।