ধর্মীয় নয় বরং অর্থনৈতিক কারণেই বেশির ভাগ তরুণ জঙ্গি হয়েছে
যুক্তরাজ্য থেকে ৮৫০ জন ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। যাদের অর্ধেকই আবার যুক্তরাজ্যে ফিরেও এসেছে। বিভিন্ন দেশের এমন যুদ্ধ ফেরত আইএস জঙ্গিদের বেশ কয়েকজনের ওপর একটি গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে তাদের বেশির ভাগেরই ইসলাম ধর্মের মৌলিক জ্ঞান নেই। জাতিসংঘের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ এই গবেষণা চালায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যে তরুণরা আইএসে যোগ দেওয়ার জন্য সিরিয়ায় গিয়েছে তারা প্রধানত পশ্চাৎপদ ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে। এদের শিক্ষা-দীক্ষাও কম এবং জিহাদের সত্যিকার অর্থ সম্পর্কে এদের কোনো বুঝ নেই। এমনকি ইসলামী বিশ্বাস সম্পর্কেও এদের বুঝ কম।
জাতিসংঘের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গবেষণায় আরো দেখতে পায় যে, আইএসফেরত ওই জঙ্গিদের অনেকে যথাযথভাবে নামাজও পড়তে জানে না।
‘তাদের অনেকেই নিজেদের ধর্মকে ন্যায়বিচার এবং অন্যায় অবিচারের মানদণ্ডে দেখে। ধার্মিকতা এবং আধ্যাত্মিকতার নিরিখে নয়। ‘ ১২টি দেশের ৪৩ জনের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে এই মতামত দিয়েছেন গবেষকরা।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, একজন সাধারণ আইএস যোদ্ধা হন পুরুষ, তরুণ এবং অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগতভাবে এবং শ্রমবজারে প্রবেশে যোগ্যতার নিরিখে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তি।
এ ছাড়া সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবেও সেই ব্যক্তি প্রান্তিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা।
এদের বেশির ভাগই ছিল বেকার, বা স্বল্প বেতনের চাকরিতে নিযুক্ত। আর তারা নিজেদের জীবনের কোনো অর্থও ছিল না বলে জানিয়েছে।
জাতিসংঘ এর সবগুলো সদস্য দেশকেই ওই গবেষণায় যোগ দিতে বলেছিল। কিন্তু মাত্র ৭টি দেশ ওই গবেষণায় অংশগ্রহণে রাজি হয়। এর তিনটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ। আর বাকি চারটি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশ।
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হামিদ আল-সাঈদ এবং সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ব্যারেট কারাগার এবং কড়া নিরাপত্তা নজরদারির মধ্যে যুদ্ধফেরত ওই আইএস জঙ্গিদের সাক্ষাৎকার নেন।
আইএস, আল-কায়েদার সিরীয় অঙ্গ সংগঠন জাবহাত আল নুসরা এবং জিহাদি আহরার আল শাম থেকে যুদ্ধফেরত জঙ্গিদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই জঙ্গিদের বেশির ভাগই কোনো বড় এবং অকার্যকর পরিবার থেকে এসেছে। যে পরিবারগুলো শহরের দরিদ্র এলাকায় বাস করত এবং ‘মূলধারার সমাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে বিচ্ছিন্ন’ ছিল।
এই ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা তরুণদের জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেওয়ার পেছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণার চেয়ে বরং অর্থনৈতিক কারণগুলোই বেশি সক্রিয় ছিল। কেননা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ভালো বেতন, বাড়ি এবং এমনকি স্ত্রীও দেওয়ার কথা বলত এই তরুণদের। আর এই লোভেই এমনকি অসংখ্য সহিংস অপরাধীও আইএসে যোগদানের জন্য ইরাক ও সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে।
২০১৪ সালে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠার পর জঙ্গিরা মুসলিমদের আকৃষ্ট করার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালায়। ওই প্রচারণায় তাদের ‘কল্পিত পশ্চিমা নিপীড়ন’ থেকে মুক্ত আরাম ও আয়েশের জীবন যাপনের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় মুসলিম তরুণদের।
আইএস এর প্রচারণার জন্য ব্যবহৃত ভিডিওগুলোতে এক কল্পনার রাজ্যের ছবি দেখানো হতো। যেখানে দেখানো হতো, আইএস যোদ্ধারা মৌমাছি চাষ, কৃষি কাজ এবং এমনকি পিজ্জা বানানোর মতো কাজ করছে। এ ছাড়া তাদের রয়েছে প্রাসাদোপম বাড়ি, সুইমিং পুল এবং দামি গাড়ি। যা আইএস ‘খেলাফত’ থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। আর এসব দেখেই মূলত তরুণরা আইএসে যোগ দিতে উৎসাহিত হয়েছে।
এই প্রচারণার ফলে যেসব তরুণ বাড়িতে বসে বেকার জীবন কাটাচ্ছিল তাদের মধ্যে অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। এ ছাড়া সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকারের নিপীড়নের হাত থেকে সুন্নি মুসিলমদেরকে রক্ষার একটি আকুতিও তাদের মধ্যে কাজ করেছে। আর এই ভ্রাতৃত্ববোধের যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার একটি অনুভূতিও।
আর আইএস জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট প্রচারণার চেয়ে বরং বন্ধুমহল, মসজিদ, কারাগার, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়া-প্রতিবেশী এবং কর্মস্থলে গড়ে ওঠা সামাজিক নেটওয়ার্ক বেশি অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেব কাজ করেছে বলে জানান অনেক আইএসফেরত জঙ্গি।
জাতিসংঘের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আত্মপরিচয়ের রাজনীতিও ওই তরুণদের জঙ্গিবাদের আকৃষ্ট করে। তাদের অনুমিত সামাজিক অবিচার ও বৈষম্যের কারণেই তারা এই আত্মপরিচয়ের রাজনীতি করতে উদ্বুদ্ধ হয় বলে জানায় ও জঙ্গিরা।
এ ছাড়া চরমপন্থায় আকৃষ্ট হওয়ার আরো কারণে মধ্যে রয়েছে, নিজ দেশের সরকারগুলোর দুঃশাসন, বৈষম্যমূলক সামাজিক নীতি, বিশেষ সম্প্রদায়কে রাজনৈতিকভাবে একঘরে রাখা, প্রবাসে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের হাতে লাঞ্ছনার ফলে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ আর হতাশা এবং সরকারবিরোধী মনোভাব।
যুক্তরাজ্যে বেড়ে ওঠা জার্মান বংশোদ্ভূত জঙ্গি হ্যারি স্যাফ্রো ২০১৫ সালে তিন মাসের জন্য আইএসে যোগ দিয়েছিল। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি তার জঙ্গি হওয়ার হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে, পুলিশি হেনস্তা এবং স্থানীয়দের লাঞ্ছনাকে দায়ী করেন।
হ্যারি স্যাফ্রো বলেন, ‘আমার কিছু বন্ধু আমাকে বলত মুসলিম এবং কালো হওয়ার কারণেই আমাকে ওভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। আর আমার স্ত্রীও হিজাব পরার কারণেই জার্মানরা আমাকে সন্ত্রাসী মনে করত। বন্ধুরা আমাকে বলল যে পশ্চিম এবং বিশেষ করে জার্মানিতে মুসলিম হলে এমনই আচরণ পেতে হবে। এর চেয়ে বরং আইএসে যোগ দিয়ে শান্তি ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করা যাবে। ‘
তবে আইএসের কথিত ওই সুন্দর জীবন না পেয়েই তারা ফিরে এসেছেন বলেও জানান ওই যুদ্ধফেরত জঙ্গিরা। আইএস এর এই কল্পনার রাজ্য স্থাপনের রাষ্ট্র প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ায় এবং সম্প্রতি একের পর এক পরাজয়ের ফলে জঙ্গি সংগঠনটির সদস্য সংগ্রহেও ভাটা পড়েছে।
ইউরোপ-আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অন্তত ২৫ হাজার যোদ্ধা ইরাক ও সিরিয়ার আইএসে যোগ দিয়েছিল। আইএসের পরাজয়ের ফলে এই জঙ্গিরা সব নিজ দেশে ফিরে যেতে শুরু করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের এই গবেষণা জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নিজেদের কর্মসূচিগুলোকে আরো শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে। কারণ দৃশ্যমান যুদ্ধক্ষেত্র হারানোর পর আইএস তার জঙ্গি সদস্যদেরকে নিজ নিজ দেশের ‘শত্রু’দের ওপর হামলা চালানোর আদেশ দিয়েছে।