ফজলুল বারী: সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারনে বিতর্কিত সংগঠন হয়ে ওঠা আওয়ামী যুবলীগে নতুন নেতৃত্ব আনা হয়েছে। রক্তের সাক্ষাৎ উত্তরাধিকার ফেরত আনা হয়েছে যুবলীগের চেয়ারম্যান পদে। শেখ ফজলুল হক মনি যিনি যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন তার বড় ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশকে সংগঠনের নতুন চেয়ারম্যান করা হয়েছে। যিনি তাঁর ‘আঙ্গুল দোষা ফুপা’ ওমর ফারুক চৌধুরীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ক্যাসিনোর চাঁদা আর পদ বিক্রি করে কাড়ি কাড়ি টাকা বানানোয় বিতাড়িত ফুপার পদ পেয়েছেন পচাত্তরের ভয়াল হত্যাকান্ডের ঘটনায় বাবা-মা হারানো এতিম শিশু হিসাবে বড় হওয়া এবং সর্বশেষ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরশ। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার রাতে পরশের বাবা-মাকেও একই সঙ্গে হত্যা করা হয়।
বাবরি চুলওয়ালা এতোদিন রাজনীতির সাতেপাঁচে না থাকা মানুষটিকে বলা হয়েছে সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত। কিন্তু তাঁর বয়সও যে এখন একান্ন। যে সংগঠনটির নেতৃত্বে তাকে আনা হয়েছে, এটি যে এখন আর সাদামাটা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো সেবা প্রতিষ্ঠান জাতীয় কিছু নয়। পদ পাবার পরদিনই নতুন চেয়ারম্যান এটি টের পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি আর বনানীর কবরস্থানে ফুল দিতে গিয়ে গুতোগুতি-ধাক্কাধাক্কির প্রতিযোগিতার ঘটনায় টের পেয়েছেন এর নেতাকর্মীরা আসলে কী চায়! অনেকের টাকা বানানোর মেশিন হিসাবেই এর নেতাকর্মীরা এটিকে দেখে অভ্যস্ত গত প্রায় এক যুগ। এরজন্যে গুতোগুতি করে হলেও এরা নিজেদের চাঁদমুখ ছবিতে দেখাতে চান! সম্রাটের হাতে হাতকড়া পড়লেও তার টাকা খাওয়া নেতাকর্মী-এমপি-পুলিশ-সাংবাদিকদেরকেতো শুধু প্রধানমন্ত্রী ফুফুর আর্শীবাদ দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে পারবেননা পরশ। টাকায় যেখানে দেশের নানান আরশও কাঁপে!
যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মনির ছেলে পরশকে চেয়ারম্যান করা হবে এটি জানার পর বুদ্ধিমান কেউ সে পদে প্রার্থী হননি। সাধারন সম্পাদক পদে কয়েকজন দেখে তাদের সমঝোতার জন্যে কুড়ি মিনিটের সময় বেঁধে দেয়া হয়। কুড়ি মিনিটে গণতান্ত্রিক সমঝোতার সুযোগ! কিন্তু সবাই নিজেদের সবচেয়ে যোগ্য ভেবে আপোষহীন থাকায় আওয়ামী লীগের প্রধান মুখপাত্র ওবায়দুল কাদের আর এক মিনিটের নাই ভরসা জানিয়ে ঘোষনা দেন মাইনুল হোসেন খান নিখিল যুবলীগের নতুন সাধারন সম্পাদক! সেই ঘোষনার পর থেকে পরশ-নিখিল পরিষদ যুবলীগের আগামী দিনের ভবিষ্যত। তিন বছর পরপর যুবলীগের সম্মেলন হবার কথা। কিন্তু কেউ জানেনা মোট কয় বছরে শেষ হবে এই তিন বছর! কারন যুবলীগের দুলা ভাই যুগ তখন ওমর ফারুক চৌধুরীর কমিটির তিন বছর শেষ হতে সাত বছর সময় লেগেছে!
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে আমরা যদি পারিবারিক রাজনৈতিক দোকান হিসাবে দেখি তাহলে পরশের নির্বাচনন বিষয়টি একটি অনিবার্য এবং নিরাপদ পছন্দ। নতুন এই চেয়ারম্যান দেশে-বিদেশে পড়াশুনা করা লোক। দেশের দামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির মাষ্টারি করতেন। কিন্তু একজন ভালো মাষ্টার এই সময়ে ক্ষমতাসীন সরকারি দলের বিশেষ যুবকদের মাষ্টারি ঠিকমতো করতে পারবেন এটি সরল ভাবাটা বোকামো হবে। কারন এদের সিংহভাগ মুখে বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বললেও অন্তরের দাবিটি ‘তাদের মূল্যায়ন’। এখন নতুন আরেকটি দাবি আসবে সামনে। তাহলে যুবলীগের সাবেক নেতৃত্বের আমলে তাদের ‘মূল্যায়ন হয়নি’! অতএব এখন তাদের ‘মূল্যায়নের’ দাবি চলে আসবে সামনে।
যুবলীগের এই পরিণতি কেনো? একটু ঠান্ডামাথায় পিছন ফিরে তাকানো যাক। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন হিসাবে যুবলীগের আত্মপ্রকাশ। মূলত ছাত্রলীগ থেকে আসা ছেলেমেয়েদের পরবর্তী সংগঠন হিসাবেই হয়তো এটির কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু জন্মের পর থেকে আজোবধি যুবলীগ এখন পর্যন্ত ছাত্রলীগ পরবর্তী যুব সংগঠন হয়ে উঠতে পারেনি। দিনে দিনে এটি হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাদের আব্বু অথবা চাচ্চুদের বয়সী আওয়ামী লীগের মতো আরেকটি সংগঠন! যেটি আওয়ামী লীগও নয় আবার যুবদের একটি সংগঠনও নয়। এই পদায়ন সমস্যায় ছাত্রলীগের বিদায়ী কমিটিগুলোর কত উজ্জ্বল মুখ পরবর্তীতে রাজনীতিতে থেকেই হারিয়ে যান! কেউ ব্যবসায় ভালো করেন। কেউ জড়িয়ে যান নানান পেশায়। ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের সঙ্গে লেগে থেকে পরবর্তী রাজনৈতিক মূল্যায়ন আদায় করে নিতে পেরেছেন এমন মুখগুলো হাতে গোনা। জেলা-উপজেলার চেহারাগুলোও সমান হতাশার।
মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্রলীগে ভাঙ্গনসহ আরও কিছু ঘটনাও যুবলীগের স্বাভাবিক বিকাশের প্রাথমিক নানান হিসাব-নিকাশকেও এলোমেলো করে দেয়। তখন জাসদ ছাত্রলীগের পাল্টা হয় মুজিববাদী ছাত্রলীগ। যুবলীগের মতো কমিউনিস্ট পার্টির একটি সংগঠন হয় যুব ইউনিয়ন। কিন্তু সংগঠন হিসাবে যুবলীগের সেভাবে বিকাশ ঘটেনি। ছাত্রলীগের পরবর্তী সংগঠন হিসাবেও যুবলীগের স্থান হয়নি। পচাত্তরের ভয়াল হত্যাকান্ড আওয়ামী লীগের মতো যুবলীগকেও তছনছ করে দেয়। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস আওয়ামী বিরোধীদলে থাকলে ছাত্রলীগ-শ্রমিক লীগ এমনকি মহিলা আওয়ামী লীগও যে ভূমিকা পালন করে যুবলীগ সেটা পারেনা। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত যুগে অপু উকিলদের যুব মহিলা লীগ যে ভূমিকা পালন করেছে, যুবলীগ সেটা পারেনি। উল্টো দেখা গেলো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে অর্থ-বিত্তে-প্রভাবে যুবলীগের নেতারাও ধনাঢ্য হন!
যুবলীগ নেতাদের গত দশ বছরের সম্পদের টালি করলে এর প্রমান মিলবে। অথচ সংগঠনটির সাংগঠনিক নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনেরাতে কাজ করেন বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শে বলিয়ান হয়ে দেশকে সোনারবাংলা গড়ার শপথের কথা শুধুই বলে যান। আর দলের নেতাকর্মীরা দেখেন সোনার ক্যারিয়ার হয় কতিপয় নেতার! যুবলীগের কিছু নেতার বিরুদ্ধে এতদিন টেন্ডারবাজির কমন অভিযোগের সঙ্গে সর্বশেষ ক্যাসিনোর ব্যবসার বিষয়টি যোগ হয়। অবিশ্বাস্য নতুন আবিষ্কারে চমকে যায় দেশ। এদের শক্তহাতে দমনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার ভাবমূ্র্তি আরও উজ্জ্বল হয়। আরও তলানিতে যায় আওয়ামী লীগ-যুবলীগের ভাবমূর্তি। এদের কয়েকজন অপসারন গ্রেফতারের স্বাদ পেলেও টেন্ডারবাজিতে চ্যাম্পিয়ন সাবেক কিছু নেতাকে সঙ্গে নিয়েই প্রতিদিন দুর্নীতি বিরোধী বক্তৃতা দেন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের!
যুবলীগের নতুন চেয়ারম্যান ঘোষনা দিয়েছেন তিনি দেশের শিক্ষিত যুবকদের রাজনীতিতে আগ্রহী করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু শিক্ষিত যুবকরা যে এখন রাজনীতিতে আগ্রহী না। যুবলীগের চলতি নেতাকর্মীরা কী তা চান? মনে হয়না। যুবলীগকে সবার আগে দরকার যুবকদের সংগঠনে পরিণত করা। ‘আব্বু-চাচ্চু যুবক’দের সংগঠন না। আব্বু-চাচ্চুদের সংগঠন আওয়ামী লীগ আছে। যুবলীগের এ চেহারা না পাল্টালে এ সংগঠন দাঁড়াবেনা। ইংরেজি সাহিত্যের নতুন ‘স্যারের’ নেতৃত্বেও না। সৃষ্টি সুখের উল্লাসী উদ্ভাবনী শক্তির যুবকদের আমরা এখন টেলিভিশন সহ নানা মিডিয়ার মাধ্যমে দেখি। বাংলাদেশের গ্রাম জনপদও উদ্ভাবনী যুবশক্তির পদচারনামুখর। যুবলীগ রাজনীতির মূলধারায় এদের নিয়ে আসতে পারলে এটি চলতি ধারার এটি লাঠিয়াল ধাচের সংগঠনের খোলস থেকে বেরুতে পারবেনা। ইংরেজির স্যার শুনছেন?