খুনিরা যখন খুন করে তখন তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনিরাতো মোশতাক-জিয়া এদের কাছে ছিল ‘জাতির সূর্য সন্তান’! তেমন জিয়া-এরশাদ-খালেদার ‘সূর্য সন্তান’ একজন খুনি মাজেদ এখন ফাঁসির দড়ির সামনে। সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন পদে থাকা অবস্থায় খুনি হওয়া মাজেদকে খালেদা জিয়া সচিব পদে পর্যন্ত পদোন্নতি দিয়েছিলেন! বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শিশু রাসেলকে যে খুনি প্রানভিক্ষা দেয়নি সে নিজে বাঁচতে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রানভিক্ষা চেয়েছিল! আহা! কার না বাঁচতে ইচ্ছা করে! রাষ্ট্রপতি তার প্রানভিক্ষার আবেদন নাকচ করাতে তাকে এখন ঝুলানোতে আর কোন সমস্যা নেই। ঢাকার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে আগামী রবি-সোমবার ফাঁসি কার্যকর হতে পারে এই খুনির।
মুজিব বর্ষেই এই খুনির ফাঁসি কার্যকরের আয়োজন চলছিল। তবে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়া খুব কম মানুষ তাকে নিয়ে আয়োজনটি জানতেন। করোনা পরিস্থিতির কারনে সব এলোমেলো হয়ে যাওয়াতে পরে গাবতলী গল্পের আশ্রয় নিতে হয়। আসল কাহিনী মাজেদ সর্বশেষ ভারতেই ছিল। তবে নজরদারিতে ছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষের। এমন মোক্ষম পণ্য নানা ব্যবসায় কাজে লাগায় চাণক্য কূটনীতির দেশ ভারত। যেখানে পলাতক খুনিদের অনেকে অধরা, তাই মুজিব বর্ষে ফাঁসিতে ঝুলাতে এমন একজন খুনি মাজেদকেও বাংলাদেশের বড় দরকার ছিল। মাস তিনেক আগে একটি বিশেষ বিমানে করে ভারতের হাত থেকে খুনি মাজেদকে ‘বুঝিয়া পাইলাম’ স্বস্তিতে নিয়ে আসা হয়! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-আইনমন্ত্রীও তা জানতেননা! সে কারনে গাবতলী গল্প শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, মনে হয় করোনার ভয়ে ভারত থেকে চলে এসেছিল!
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার স্বাক্ষীরা আদালতে বলেছেন, বাড়িতে গুলাগুলি রক্তক্ষয়ী হত্যালীলা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত শিশু রাসেল নিরাপদ আশ্রয় মনে করে মাজেদকে জড়িয়ে ধরে প্রানভিক্ষা চেয়েছিলেন। শিশুকাল থেকেইতো রাসেল দেখে আসছিলেন তাদের বাড়িতে মাজেদের মতো লোকজনই তাঁর বাবা-মা বঙ্গবন্ধু আর বেগম মুজিবের কাছে নানাকিছু চাইতে আসেন।
তাঁর বাবা-মা বাঙ্গালি জাতির পিতা-বঙ্গমাতা কাউকে কোনদিন বাড়ি খালি হাতে ফেরাননি। এই মাজেদকেও হয়তো আগেও তাদের বাড়িতে দেখেছেন রাসেল। বাড়িতে হয়তো তাকে মাজেদ ভাই অথবা মাজেদ আঙ্কেল বলেও ডেকেছেন! তাই তাকেই জড়িয়ে ধরে তার কাছেই প্রানভিক্ষা চেয়েছিলেন। কিন্তু এই পাষন্ড খুনি এমন একজন নিষ্পাপ শিশু রাসেলকেও বাঁচতে দেয়নি!
খুনি মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত না, শিশু রাসেল হত্যার সঙ্গেও জড়িত, জেল হত্যাকান্ডের সঙ্গেও জড়িত, এরকারনেই বুঝি জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার কাছে এতো কদর ছিল এই খুনির! নতুবা সেনাবাহিনীর একজন সাধারন ক্যাপ্টেন খুনির এত কদর কেনো তাদের কাছে হবে! খালেদা জিয়া তাকে সচিব পর্যন্ত করেছিলেন! বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুর রশীদকে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের উপনেতা পর্যন্ত করেছিলেন!
খালেদা জিয়ার সৌভাগ্য অথবা দূর্ভাগ্য দু’বছর জেলে কাটিয়ে বাসায় ফিরে তিনি এখন তার প্রিয় মাজেদের ফাঁসির খবরও দেখবেন টেলিভিশনে! বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্য আসামী, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিও খালেদা জিয়া বাড়িতে বসে টেলিভিশনে দেখেছেন। এসব ফাঁসি দেখে দেশের মানুষ খুশি হয়। শুধু খালেদা জিয়া ছাড়া! ২০০১ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার বিচার আটকে দিয়েছিলেন! মনে করেছিলেন, সারা জীবন ক্ষমতায় থাকবেন, আর তার এসব প্রিয় খুনিদের কোনদিন ফাঁসিও হবেনা! ২০০৬ সালের নভেম্বরে ক্ষমতার গনেশ উল্টে গেলে তার সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়!
খালেদার আগে তার স্বামী জিয়ার হাতে মাজেদ সহ বঙ্গবন্ধুর এসব খুনিদের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক পদায়ন শুরু হয়। একটি বিশেষ বিমানে করে বাংলাদেশ থেকে সব খুনিকে একসঙ্গে নিরাপদে ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হন। সেখান থেকে তাদের কূটনৈতিক পদায়ন করা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে! তাদের সবাইকে বিদেশে নিয়ে যেতে বিদেশি দূতাবাসে প্রাইজ পোষ্টিং’এ জিয়ার পক্ষে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন শমসের মোবিন চৌধুরী! ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা সেই শমশের মোবিনও এখন আর বিএনপি করেননা!জিয়া যুগের নতুন প্রজন্মকে শেখানো হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান! তখন অবশ্য ‘জাতির পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু’ এসব বলা নিষিদ্ধ ছিল! বলা হতো ‘শেখ মুজিব’! দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ‘শেখ মুজিবের হত্যাকান্ড’ একটি ‘ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন!’ আর এই খুনিদের বলা হতো ‘জাতির একদল সূর্যসন্তান!’ যারা এই ‘ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন’ ঘটিয়েছে! জাতির পিতার হত্যাকান্ডের বিচারতো বহুদূর! তখনকার প্রজন্মকে শেখানো হয়েছে, ‘সামরিক অভ্যুত্থান সফল হলে বিচার হয়না’, ‘ব্যর্থ হলে বিচার হয়না’!
পচাত্তরের হত্যাকান্ডকে এমন ‘সফল অভ্যুত্থান’ বলতে চাইতেন জিয়া! তার আমলে একের পর এক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে শতশত মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছেন জিয়া! আর তিনি যখন নিহত হলেন তার হত্যাকান্ডের বিচার করতে দিলেননা খালেদা জিয়া! উল্টো মেজর মঞ্জুরকে হত্যা করতে দিয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে গেলেন ওসি কুদ্দুস! মঞ্জুর হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে এরশাদকে আসামী করে মামলা করেছিলেন তার(মঞ্জুরের) ভাই। রাজনৈতিক হিসাব নিকাশে সেই বিচারও আর শেষ হয়নি।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে বিচার শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার। ‘সফল সামরিক অভ্যুত্থানের বিচার হয়না’ এই তত্ত্ব পাল্টে যায়। নতুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত করতে পারে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যাকান্ড কোন সামরিক অভ্যুত্থান ছিলনা। সেটি ছিল সেনা বাহিনীর একদল বিপদগামী সদস্যদের হত্যাকান্ড। দেশের প্রচলিত আইনে বিচার শেষ করতে করতে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। পর্যাপ্ত বিচারপতি নেই এই অজুহাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার আটকে দেন খালেদা জিয়া। অতঃপর খুনি ফারুকদের যে ফাঁসি হয়েছে এর কারন, খালেদা জিয়া আর ক্ষমতায় আসতে পারেননি। একই কারনে আজ ফাঁসির দড়ির সামনে খুনি মাজেদ। রবি বা সোমবার ঝুলবে খুনি! দন্ড সাময়িক স্থগিত হয়ে বাড়িতে থাকায় খালেদা জিয়াও এই ফাঁসির খবর দেখতে পারবেন টেলিভিশনে।