প্রতারক সাহেদ তৈরির কারখানায়

বাংলাদেশে এক সময় টিভি বলতে ছিল বিটিভি। এর খবর মানেই ছিল সরকারের তোষামোদি। এরজন্যে এক সময় এটির নাম হয় সাহেব বিবি গোলামের বাক্স। এরপরও তখন বিটিভির জনপ্রিয়তার কারন ছিল এর কিছু মান-সম্পন্ন অনুষ্ঠানমালা।

বিটিভির ধারাবাহিক নাটক, ইত্যাদি সহ নানান অনুষ্ঠানমালা জনপ্রিয় ছিল। পূর্ন দৈর্ঘ বাংলা ছায়াছবি, সিনেমার গানের অনুষ্ঠান ‘ছায়াছন্দ’ও ছিল দর্শকপ্রিয়। কিন্তু বিটিভির খবর দেখতোনা মানুষ। খবর শুরু হলেই টিভি বন্ধ করে দিত।

এখনও দেশের মানুষ বিটিভি খবর দেখেনা। বিটিভির খবর এখন বেসরকারি চ্যানেলকে দেখাতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তখন মানুষ ইটিভির খবর দেখতো। ইটিভি এসে বাংলাদেশের টিভি দর্শকদের রূচি-স্বাদ-বিকল্প সবকিছুর অভ্যাস বদলে দিয়েছিল।

ইটিভি তথা একুশে টিভি নামের বিপ্লবের পিছনের মানুষটি ছিলেন বিলাত প্রবাসী আবু সাইয়িদ মাহমুদ। এই দূরগামী স্বপ্নবান পুরুষ তার স্বপ্নের মত করে ইটিভি গড়ে তুলেন। ইটিভি গড়তে তিনি সায়মন ড্রিংকে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকায়।

বাংলাদেশের জন্ম ঘটনার সঙ্গেও এই বিদেশি সাংবাদিক জড়িয়ে গিয়েছিলেন। পঁচিশে মার্চের গণহত্যার ছবি তিনি নিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিদেশি মিডিয়ায়। পাকিস্তানি জান্তা তখন তাঁকে এদেশ থেকে বের করে দেয়।

যাবার পর গোপনে তিনি ওই ছবিগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। সেই ছবিগুলো তখন বিশ্বমিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ায় আর বাংলাদেশের গণহত্যা লুকাতে পারেনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। এর আগে পর্যন্ত তারা বলতে চেয়েছে সব ষড়যন্ত্র!

কিন্তু সায়মন ড্রিং’এর ছবিগুলোর কারনে গণহত্যা আর বাংলাদেশের ঘটনাক্রমকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে চালাকি চালাতে পারেনি পাকিস্তান। বাংলাদেশ স্বাধীনই হয়েছে। বিশ্ব মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাঙালির নিজস্ব নতুন এক দেশ।

একুশে টিভি গড়ার সময় আবু সাইয়িদ মাহমুদ এখানে তাঁর দীর্ঘদিনের জমানো স্বপ্ন আর স্থানীয় পুঁজির সংগঠন-সমন্বয় ঘটান। আর এর নিউজ আর অনুষ্ঠানমালার টিম-কনটেন্ট গঠনের পুরো নেতৃত্ব দেন সায়মন ড্রিং’কে।

নতুন দায়িত্ব-স্বাধীনতা পেয়ে বিবিসির চাকরি ছেড়ে আসা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু এই সাংবাদিক তাঁর সমস্ত মেধা-অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটান। তাঁর ছোঁয়ায় বাংলাদেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতায় বিপ্লব ঘটায় একুশে টেলিভিশন।

বাংলাদেশের মতো দেশে টেলিভিশনের খবরও যে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হতে পারে তা করে দেখিয়েছে একুশে টেলিভিশন। এটি হয়েছিল এর কর্মীদের স্বপ্নঘর। ১৯৯৮-২০০২ পর্যন্ত নতুন এই টিভিকে নিয়ে দারুন এক সময় পার করেছে বাংলাদেশ।

দেশের মানুষের রূচি অভ্যাস শুধু নয়, মোটকথা জনজীবনেও ছাপ ফেলেছিল এই টিভি। ভাবনার বিস্তৃত জগতেও ফেলেছে প্রভাব। ‘দেশজুড়ে’র মতো সারাদেশের খবর নিয়ে অনুষ্ঠানও যে কত দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান হতে পারে, তা দেখিয়েছে একুশে।

তরুন একদল সাংবাদিকও যে দর্শক প্রিয় তারকা হতে পারেন, তা একুশে টেলিভিশন বাংলাদেশকে দেখিয়েছে-শিখিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারন করে গড়ে বেড়ে ওঠা এই টিভি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আরেক কারন প্রযুক্তিগত সমর্থন।

মানুষের ঘরে ঘরে নিয়ে যেতে এটিকে তখন টেরিস্ট্রোরিয়াল সুযোগ দেয়া হয়েছিল। ২১ বছর ক্ষমতায় ফেরা আওয়ামী লীগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বাংলাদেশের টেলিভিশন চিন্তা আর মোবাইল ফোনের বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন।

তাঁর আগে খালেদা জিয়ার বিএনপি বিটিভির চিরায়ত স্বরূপ বহাল রাখার পাশাপাশি মোবাইল ফোনের কর্তৃ্ত্ব দলীয় ব্যবসায়ী মোর্শেদ খানের নিয়ন্ত্রনে রেখে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা গ্রামীন ফোনের অনুমতি দিয়ে সেই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন ভেঙ্গে দেন।

টেরিস্টোরিয়াল সুবিধা দেয়ায় গ্রাম পর্যায়ের মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নতুনধারার টিভি চ্যানেল। খালেদা জিয়ার মতো করে তখন আওয়ামী লীগের কর্তৃ্ত্বেও বিটিভি দলীয় বেকার সাংবাদিকদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে একুশে টিভিকে টার্গেট করে। এরজন্যে বিএনপিপন্থী দু’জন সাংবাদিককে দিয়ে এর বিরুদ্ধে মামলা করানো হয়। একুশের সাংবাদিক কর্মীরা মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে কাঁদলেন।

কিন্তু কে শোনে কার কান্নার কথা। দেশ থেকে বের করে দেয়া হয় সায়মন ড্রিংকে। মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিক সায়মন ড্রিংকে ১৯৭১ সালে বের করে দিয়েছিল পাকিস্তানি জান্তা। দ্বিতীয়বার দেশ থেকে বের করে দিল পাকিস্তানপন্থী খালেদা জিয়ার সরকার!

বাংলাদেশে অবস্থানের শেষ সময় পর্যন্ত এই সাংবাদিককে হেনস্থা করা হয়! সায়মন ড্রিং’এর ভিসা-ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করার পর তাকে দেশত্যাগের সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছিল। এরপর তার বাসায় গিয়েও তাকে হেনস্থা করা হয়।

সায়মন ড্রিং’এর বাক্স পোটরা সবকিছু আবার খোলানো হলো। আবার বন্ধ করানো হলো। আবার খোলানো হলো। কিন্তু কিছুই তল্লাশী করা হলোনা। মূলত ওই সময়টায় বাড়িটায় তাকে ব্যস্ত রাখার কারন তিনি যাতে কারও সঙ্গে দেখা করতে না পারেন।

যাবার আগে তিনি শুধু তাঁর হাতে গড়ে একুশে টিভির সহকর্মীদের সঙ্গে একবার বসেছিলেন। তারা তখন শুধু কাঁদছিলেন। ধীরস্থির সায়মন ড্রিং বললেন একুশে টিভি হবে বাংলাদেশের টিভি সাংবাদিকতার ভবিষ্যতের দরজা।

এর সাংবাদিক-কর্মীরাই একদিন বাংলাদেশের টিভি সাংবাদিকতার কান্ডারি হবে। সায়মন ড্রিং’এর সেই ভবিষ্যত বানী সত্য হয়েছে। একুশে টিভির সাংবাদিক-কর্মীরাই আজ দেশের মূলধারার টিভির নেতৃত্বে। তাদের অনেক কিছুতে এখনও তাঁর ছায়া।

একুশে টিভি বন্ধের কারন হিসাবে তখন জামায়াত আর খালেদা জিয়ার ক্রোধের কথা বলা হয়েছে। সংসদ ভবনের ভিতর খালেদা জিয়ার খুঁড়িয়ে হাঁটার ঘটনা লংশটে দেখানোয় তিনি ক্ষুদ্ধ হন। পরে অবশ্য দিনে দিনে স্পষ্ট হয় আসল কারন!

মোসাদ্দেক আলী ফালুর টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠার জন্যে একুশে টেলিভিশন বন্ধ করা দরকার ছিল। তখন আরেকটি কথা ছড়ানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল এই টেলিভিশনের মালিক আসলে শেখ রেহানা। ২০০৬ সালে লন্ডন নিয়ে এর কোন সত্যতা পাইনি।

একুশের স্বপ্নপুরুষ সাইয়িদ মাহমুদ ততদিনে মারা গেছেন। সায়মিনং ড্রিং’ও তখন রুমানিয়ায় পারিবারিক দাতব্য সংস্থা পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত। খবর পেয়ে সাইয়িদ মাহমুদের ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন।

একুশের না জানা অনেক কথা তিনি আমার সঙ্গে শেয়ার করেন। শেখ রেহানার মালিকানা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে হেসে বলেন তিনিতো এখানে বাসে করে যাতায়াত করতেন। টেলিভিশন করার টাকা তিনি কোথায় পাবেন।

একুশে টেলিভিশন শূন্যস্থান পূরনের চেষ্টা করেছিল এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই। এরপর মোসাদ্দেক আলী ফালুর এনটিভি। খালেদা জিয়ার আমলে আরও দুটি টিভি চ্যানেল চালু হয় আরটিভি, চ্যানেল ওয়ান।

এদের সবাই একুশে টেলিভিশনকে নকল করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের কেউ সায়মন ড্রিং’এর একুশে টেলিভিশনের মতো হওয়া যায়নি। বাচ্চু রাজাকারদের প্রমোট করে আর যাই হোক একুশে টেলিভিশনের ধারেকাছের কিছুও হওয়া যায়না।

সাইয়িদ মাহমুদ একুশের পুঁজি যাদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে শুধু আব্দুস সালাম ছিলেন বিএনপি ঘরানার। কিন্তু তিনিও বিএনপির আক্রোশ থেকে একুশে টেলিভিশনকে বাঁচাতে পারেননি। এরপর তিনি অন্যদের শেয়ার কিনে নেন।

তিনিও সেখান থেকে ছিটকে গেছেন। এরপর যত টিভি এসেছে যাদের বেশিরভাগের নিজস্ব দর্শকগোষ্ঠী বা বাজার নেই। এর বেশিরভাগ লাভজনকও নয়। এরপরও হাতির খরচের এগুলো চালু রাখার ধান্ধা দুই নাম্বারি।

জগতের সব সম্পর্কই অর্থনৈতিক। যখন কোন পণ্যের নিজস্ব নির্দিষ্ট বাজার থাকেনা তখন অস্তিত্ব রক্ষায় এদের অনেকে অনেক ফাঁদে পড়ে বা ফাঁদ তৈরি হয়। এই ফাঁদের অংশ হিসাবে দেশে ১/১১ সৃষ্টিতে মিডিয়ার একাংশের ভূমিকা ছিল।

বিশেষ সংস্থা মিডিয়ার যাদেরকে তখন কব্জা করেছিল তাদের অনেকে ‘প্রজেক্টের’ মায়ায় এখনও তাদের কব্জায়! আজকের মহাপ্রতারক সাহেদও তাদের হাতে তৈরি। ইমদু কাহিনীর মতো সাহেদকে নিয়ে কেউ খেলছে?

কারন সাহেদকে দিয়ে তারা মিডিয়ার ভালো চরিত্রগুলো আড়াল করে দিয়েছে! দেশের হাজার হাজার সৎ মিডিয়া কর্মীর সংগ্রাম-শ্রম-ঘাম আড়াল করছে এই চক্রান্ত। জেনেশুনে এমন এক ঠগ-প্রতারককে তারা পৃষ্ঠপোষকতা কেনো দিয়েছে?

যে পৃষ্ঠপোষকতার ওপর দাঁড়িয়ে সাহেদ বেপরোয়া হয়ে মানুষ ঠকিয়েছে। এই বদনামের পুরোটা এখন মিডিয়া আর আওয়ামী লীগের ঘাড়ে! যারা এমন প্রতারককে বঙ্গভবন-গণভবন পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল তাদের বিষয়ে তদন্ত কেনো নেই?

এই ধারনা অথবা আশংকার বিষয়টি যাতে বিবেচনার বাইরে না যায়। ইমদুর বিষয়টিও সাহেদের মতো তৈরি করা ছিল। বাংলাদেশকে উত্তপ্ত করবে এক সাবেক জেনারেলের বক্তব্যও এখন ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে!

আর এক প্রতারক আইডল সাহেদ নামের পচা শামুকে পা কাটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের। অন্য সাহেদের স্রষ্টাদের ধরা হচ্ছেনা কেনো? বাংলাদেশ সাবধান। সতর্ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে তাঁর ক্ষোভ জানিয়েছেন।