আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকি বলে বাংলাদেশের সঙ্গে এ দেশটির করোনা যুদ্ধকালীন নানাকিছুর তুলনামূলক চিত্রটিই শুধু জানি। আমি এদেশের যেখানে থাকি অর্থাৎ এর নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যে এখনও প্রতিদিন গড়ে তিরিশ হাজারের বেশি টেস্ট হয়।
এই তিরিশ হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করে এখন পজিটিভ রোগী কোন দিন ১ বা কোন দিন ৩-৪ জন পাওয়া যায়। করোনার দ্বিতীয় প্রবাহে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে আক্রান্ত রাজ্য ভিক্টোরিয়া। সেখানকার সংক্রমনও নিয়ন্ত্রনে চলে এসেছে।
ভিকটোরিয়া রাজ্য এবং এর রাজধানী মেলবোর্নে লকডাউনের নানা স্টেজ সেখানে অনুসরন-বাস্তবায়ন করে এখন প্রতিদিনের সংক্রমনের সংখ্যা দেড়শ’র নীচে নামিয়ে আনা হয়েছে। এখনও রাতে কার্ফু চলে মেলবোর্নে।
আগষ্টের ১০ তারিখ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় মোট ৩ হাজার ৫১৯ জন করোনা রোগী পাওয়া যায়। এর ৯৯ শতাংশই মেলবোর্নে। গত জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায়।
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এই মহাদেশে মহামারীর এ রোগে ৫১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। একাধিক জন আক্রান্ত হলেও কোন বাংলাদেশি করোনায় মারা যাননি। এসব মৃত্যুর ৪১৩ জনই মারা গেছেন দ্বিতীয় প্রবাহে।
শুধুমাত্র বৃদ্ধনিবাসগুলোতেই মারা গেছেন ৩৩৫ জন। বাংলাদেশের দুদকের মতো অস্ট্রেলিয়ার দুর্নীতি দমন সহ নানাকিছুর জবাবদিহির প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েল কমিশন। স্বাধীন এই প্রতিষ্ঠান জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে যে কাউকে ডাকতে পারে।
দেশের বৃদ্ধনিবাসগুলোতে এতো মৃত্যুর জন্যে সরকারকে দায়ী করেছে অস্ট্রেলিয়ার রয়েল কমিশন। এই কমিশনের তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় করোনা থেকে বৃদ্ধনিবাসগুলোকে রক্ষার সরকারি প্রস্তুতি যথাযথ ছিলোনা।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এর দায় স্বীকার করেছেন। রয়েল কমিশনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে স্কট মরিসন এরজন্যে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা চেয়েছেন বৃদ্ধনিবাসে করোনায় মৃতদের পরিবারবর্গের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন।
অস্ট্রেলিয়ার টনি এবোট সরকারের ইমিগ্রশন মন্ত্রী ছিলেন মরিসন। ম্যালকম টার্নবুল সরকারে তাকে ট্রেজারার করা হয়। আগের পোর্টফোলিওগুলোর মতো এই করোনা তাকে দেশের একজন সফল প্রধানমন্ত্রী হিসাবেও চিহ্নিত করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোতে দেখানো হয়েছে এখন দেশটায় নির্বাচন হলে বিপুলভাবে জিতে আবার ক্ষমতায় আসবেন স্কট মরিসন। অস্ট্রেলিয়ার পাশের দেশ নিউজিল্যান্ডের জেসিকা আরড্রেনেরও একই অবস্থা।
করোনা মোকাবেলার সাফল্যে তাঁর জনপ্রিয়তাও বিপুল বেড়েছে। প্রথম থেকে এই করোনা যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার বড় কৌশলটি হচ্ছে বেশি বেশি টেস্ট। আড়াই কোটি মানুষের দেশে এরমাঝে প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষের টেস্ট হয়ে গেছে।
দেশের সব হাসপাতালের মতো প্রায় সব বেসরকারি মেডিক্যাল সেন্টারেও এখন টেস্টের ব্যবস্থা আছে। পথে পথে বিয়ে বাড়ির মতো সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে টেস্ট বাড়াতে সদা তৎপর এই দেশ। আপনি গাড়িতে বসে থেকেই নমুনা দিয়ে চলে যেতে পারবেন।
কোথাও একজন করোনা পজিটিভ রোগী পাওয়া গেলে শুরু হয় কন্টাক্ট ট্রেসিং। এ রোগী কোথায় কোথায় গেছে বা কার কার সংস্পর্শে এসেছে। তাদেরও টেস্ট করা হচ্ছে। এরজন্যে এখন রেষ্টুরেন্ট-মসজিদে ঢুকতেও নাম ফোন নাম্বার লিখতে হয়।
করোনা পরিস্থিতির কারনে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বানিজ্য সহ নানাকিছুতে অস্ট্রেলিয়াও এখন কঠিন সময় পার করছে। শিক্ষাও এদেশের ব্যবসার বড় একটি পণ্য। ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক ছাত্ররা আসতে পারছেননা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনলাইন ক্লাস চলছে। কিন্তু আমার রাজ্য নিউসাউথ ওয়েলসে স্কুল অনেক আগেই খুলে দেয়া হয়েছে। কারন স্কুল বন্ধ থাকলে বাবা-মা’র কাজে যেতে সমস্যা হয়। তখন তাদেরকেও নির্ভর করতে হয় সরকারি ভাতার ওপর।
এদেশের বেশিরভাগ মানুষ আবার এই ভাতা নির্ভর জীবন পছন্দ করেননা। ভাতার পরিমানও পর্যাপ্ত নয়। কম জনসংখ্যার এদেশে বিস্তর বাস-ট্রেনের ব্যবস্থা থাকায় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদ যাতায়াতও সম্ভব।
স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাস-ট্রেনের ভাড়াও দেয় সরকার। এদেশের প্রাইমারী স্কুল ক্লাস সিক্স এবং হাইস্কুল দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত। শুরুর দিকে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে প্রতিটি স্কুল খোলা হয়।
এরপর সপ্তাহে একদিন, সপ্তাহে একদিনের বেশি এভাবে চালু করে শুরু করা হয় ফুল ভলিয়্যুমের ক্লাস। এরমাঝেও স্কুলেও চালু আছে নানান নিয়ম সতর্কতা। এক সেকশনের ছাত্র আরেক সেকশনের ছাত্র বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায়ও বসতে পারেনা।
কোন একটি স্কুলের কোন একজন ছাত্রের করোনা পজিটিভ চিহ্নিত হলে সেই স্কুল বন্ধ রাখা হয় নির্দিষ্ট সময়। ওই সময়কে স্কুলটি ক্লিন-জীবানুমুক্ত করা হয়। ছাত্রদের ক্লাস তখন হয় অনলাইনে। এভাবে জীবন কোথাও থেমে নেই।
গত জানুয়ারিতে প্রথম করোনা রোগী যখন এদেশে প্রথম শনাক্ত হয় তখন নানাকিছু বন্ধ করে দেয়া এ দেশটির প্রতি সপ্তাহে ৪ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বিপর্যস্ত হয়েছে করোনা মহামারীতে।
এখনও ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষকে দিতে হচ্ছে সরকারি ভাতা। বেকারদের জব সিকার ভাতা এখন প্রতি দুই সপ্তাহে ১১শ ডলার। এই করোনায় নতুন একটি ভাতার সূচনা করা হয় জব কিপার। যা প্রতি দুই সপ্তাহে ১৫শ ডলার।
যেমন একজন মালিক ব্যবসা চালু রেখেছেন কিন্তু কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেননা, তাদের বেতন সরকার জব কিপার শিরোনামে দিচ্ছে। করোনায় অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিমান সংস্থা কোয়ান্টাস, ভার্জিন এয়ারলাইন্সও বসে গেছে।
তাদের অনেক কর্মীকে বিকল্প কাজ দেয়া হয়েছে সুপার মার্কেটগুলোতে। আমি বাংলাদেশ বিমানে কাজ করি, তাই আমি দোকানে কেন কাজ করবো এমন বলার মতো লাটবাহাদুররা সব দেশে থাকেননা। থাকতে পারেননা।
কারন সপ্তাহ শেষে সংসার চালাতে হাজার ডলার লাগে। এখন এমন কোয়ান্টাস সহ নানান সরকারী প্রতিষ্ঠানের জব কিপার পেমেন্টের লোকজনকে জায়গা করে দিতে কাজ হারিয়েছেন অনেক বিদেশি ছাত্র।
আজও তারা কাজ ফিরে না পাওয়ায় কষ্টে আছেন। সব দেশইতো সবার আগে তাদের নাগরিক স্বার্থ নিয়ে ভাবে। এই মহামারী মোকাবেলার আর্থিক সঙ্গতি বাংলাদেশের ছিলোনা। সরকারেরও না নাগরিকদেরও না।
এরজন্যে বাংলাদেশে শুরুতেই কম টেস্ট দিয়ে যুদ্ধ শুরু করা হয়। বেশি টেস্টের সামর্থ্য অবকাঠামো কিছুই বাংলাদেশের ছিলোনা। এরজন্যে বাংলাদেশ কখনও জানতেই পারেনি এর করোনার পিক টাইম কখন। লকডাউনকে বলা হয়েছে ছুটি!
গণপরিবহন বন্ধ রেখে আবার গার্মেন্টস খুলে দেয়া হয়েছে! মহামারীর সময় এমন নানান এলোমেলো আচরন করেছে বাংলাদেশ! টেস্টের ভোগান্তি, ভঙ্গুর স্বাস্থ্যখাত, দূর্নীতিপ্রবণ তৃণমূল সরকারের ভালো কাজগুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করেছেন প্রায় চব্বিশ ঘন্টা। কিন্তু তাঁকে মনে হয়েছে একা। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় কাউকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী মনে হয়নি। প্রথম দিকে মানুষকে সাহায্য করতে মানুষ যেভাবে এগিয়ে এসেছে তাও দিনে দিনে মিইয়ে আসে।
কারন যারা সহায়তা করবেন তাদেরও হাতের টাকা ফুরিয়ে আসে। ৫০ লাখ মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে দিতে গিয়েও তা শান্তিতে দেয়া যায়নি। এই আড়াই হাজার টাকার ভাগ নিতেও হা করে ছিল দেশের লোভী-দুর্নীতিবাজেরা!
বিকাশের কিছু দোকানে পাঁচশ টাকা ফি’র নামে রেখে ২ হাজার টাকা দেবার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা কেউ দেখেনি। দুই ঈদে বাড়ি যাওয়া আসায় করোনা ছড়িয়ে গেছে সবখানে।
স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি কিট স্বল্পতায় টেস্টে টাকা দিতে হবে বলায় টেস্ট প্রবনতা পথ হারিয়েছে বাংলাদেশে। মুহুর্মুহু বন্যার হানায় সবকিছু এখন এলোমেলো। জন্ম থেকে লড়াকু মানুষের দেশে করোনায় মৃত্যু সংক্রমনের চেয়ে কম।
কিন্তু এই মহামারী বাংলাদেশ থেকে আর কবে কিভাবে যাবে তা কেউ জানেনা। অস্ট্রেলিয়ার উদ্বেগ এখনও এই মহামারীর ভ্যাকসিন নেই। অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের তিন কোটি ডোজের অর্ডার দিয়ে রেখেছে এই দেশ। বলেছেন সব নাগরিককে ভ্যাকসিন ফ্রি দেবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন ভ্যাকসিন লাগবেনা। করোনা এমনি এমনি চলে যাবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেরি হয়ে গেছে। টাকারও ব্যবস্থা নেই। আর ডিম আগে না মুরগি আগে বিতর্কের মতো চীন বা ভারত বিতর্কের মধ্যে দিন পার করছে আল্লাহর ওয়াস্তে চলা দেশ বাংলাদেশ!