ভারতের পলাতক জীবন থেকে ধরে এনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী মাজেদকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পলাতক এই আসামীর গ্রেফতার-ফাঁসি নিয়ে নানান নাটক হয়েছে। ভোলার লোকজন এই খুনির লাশ নিতে রাজি না হওয়ায় রাতের বেলা গোপনে তার লাশ দাফন করা হয়েছে সোনারগাঁওর শশুরবাড়ির গ্রামে। এসব এতোদিনে পুরনো খবর।
নতুন খবর হলো মাজেদের কলকাতার পরিবারের কান্না। বাংলাদেশে এই খুনির ডাক্তার স্ত্রীর সংসারে চার মেয়ে এক ছেলে। ছেলেটি আমেরিকায় থাকে । সামাজিক কারনে ফাঁসির আগে তার মেয়েরা তাকে শেষ দেখা দেখতেও যায়নি।
অথচ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশেবিদেশে এই মাজেদরাই ছিল কথিত দাপুটে সূর্য সন্তান! শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘায়িত হওয়াতে দেশেবিদেশে বিএনপি-জামায়াতের যেমন ছেঁড়াবেড়া অবস্থা, এই খুনিদেরও দৌড়ের ওপর থাকতে হয়েছে। একদার দাপুটে খুনি রশিদ-ডালিম কোথায় আছে তা কেউ জানেনা।
উর্দু জানতো মাজেদ। তাই সে আহমেদ আলী ছদ্মনামে কলকাতার উর্দু ভাষী মুসলিম এলাকায় থিতু হয়েছিল। পার্কস্ট্রিট আর তালতলা এলাকায় থাকতো মাজেদ। লোকজন জানতো এই লোক ইংরেজির মাষ্টার। বাড়ি বাড়ি টিউশনি করে সংসার চালায়। কলকাতার শহরতলীর এক পীরের দরগায় যাতায়াত করতো খুনি মাজেদ। অপরাধী-খুনি গোছের মানুষদের আবার এইসব ডেরা আবার বিশেষ পছন্দ।
ওই পীরের দরগায় যাতাযাত করতে করতে জরিনা নামের এক নারীকে বিয়ে করে মাজেদ। যে জরিনা ছিল বয়সে তার চেয়ে বত্রিশ বছরের ছোট। এটি ছিল জরিনারও দ্বিতীয় বিয়ে। বাইশ বছর বয়সেই প্রথম স্বামীকে হারান জরিনা। সেই সংসারে তার একটি মেয়ে ছিল। সেই প্রথম স্বামীর মৃত্যুর সাত-আট বছর বাদে মাজেদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ভেবেছিলেন ইনি বয়স্ক মানুষ। পেশায় শিক্ষক। তার একটি আশ্রয় হবে। কিন্তু এই মানুষটি যে আসলে একটা পলাতক খুনি তা ঘুনাক্ষরেই বুঝতে পারেননি জরিনা।
এই সংসারেও তাদের ছয় বছরের একটি মেয়ে আছে। এই মেয়েটির নাম হুমায়রা। পার্ক স্ট্রিটের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী। এই মেয়েটিও এখন মোবাইল ফোনে তার বাবা’র ছবি বের করে কাঁদে। কারন সেও জেনে গেছে তার বাবা আর কোনদিন আসবেনা। বাংলাদেশে খুনের অভিযোগে তার বাবাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আর কোনদিন তাকে ইংরেজি পড়াবেওনা তার মিথ্যাবাদী বাবা।
মাজেদ নিখোঁজ হবার পর স্বামীর খোঁজে পার্কস্ট্রিট থানায় জিডি করেছিলেন জরিনা। মিসিং মামলা। আর যখন শুনেছেন আসল সত্য। তার স্বামী ছিল একটা চরম মিথ্যাবাদী। পলাতক খুনের আসামী। শেখ মুজিবের মতো লোককে সে খুন করেছে। খুনের কারনে বাংলাদেশে তার ফাঁসি হয়েছে। এসব জানার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন জরিনা।
আগে থেকে তার স্নায়ু রোগ ছিল। প্রায় হাত-পায়ের বাঁধন শিথিল হয়ে পড়তো। স্বামীর আসল কাহিনী জানার পর অসুস্থতায় নিয়েছে নতুন মাত্রা। কলকাতার বাগনানের বাপের বাড়িতে তিনি এখন শয্যাশায়ী। স্বামী কথা উল্লেখ করে জরিনা বলেন লোকটা অসম্ভব রাগী ছিল। কিছু জানতে চাইলে রেগে যেত।
এসব রাগের কারন যে ছিল তা বিষাক্ত অতীত, তা এতোদিন পর এখন বুঝতে পারছেন জরিনা। তিনি যে লোকটিকে আশ্রয় করতে চেয়েছিলেন, সেই প্রতারক লোকটা তাকে ঠকিয়েছে।
জরিনার কথা স্বামী নিখোঁজ হবার পর তিনি তার খোঁজে অনেক থানা পুলিশ করেছেন। কিন্তু কেউ কোন সন্ধান দিতে পারেনি। এভাবে মাস দেড়েক পর যখন হাল ছেড়ে দেন, তখন বাংলাদেশের খবর আসে।
খবর পান তার স্বামী আহমদ আলী গ্রেফতার হয়েছে বাংলাদেশে। তার নাম আসলে মাজেদ। সে খুব বাজে লোক। ভয়ংকর রকমের এক খুনি। বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করে ভারতে পালিয়ে আসে। পরিচয় গোপন করে আহমদ আলী নাম নেয়। বাংলাদেশে ধরা পড়ার পর কলকাতার পত্র্পত্রিকাতেও তার খবর ছাপা হতে থাকে। জরিনা জানতে পারেন এই প্রতারক আহমদ আলীই আসলে খুনি আব্দুল মাজেদ।
এ পক্ষের হুমায়রা নামের এক ছয় বছরের মেয়ে ছাড়াও জরিনার প্রথম সরকারের মেয়েটির বয়স এখন ১৭-১৮। তিন জনের সংসার এখন কিভাবে চলবে সে দুশ্চিন্তায় দিশেহারা এই নারী।
বললেন, আমাদেরতো কোন দোষ নেই। আমরা একজন মানুষকে ভরসা করতে চেয়েছিলাম। লোকটা যে পলাতক একটা খুনি তা ঘুনাক্ষরে বুঝতে পারিনি। একটি চাকরি চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন করেছেন জরিনা।
কিন্তু সেখান থেকে এখনও কোন সাড়া পাননি। সাড়া পাবেন কিনা তাও তিনি জানেননা। কারন আরেক বাংলায় তিনি যে শেখ মুজিবের ফাঁসির আসামী মাজেদের ভারতীয় স্ত্রী। শেখ মুজিবের খুনি ফাঁসিতে দন্ডিত মাজেদের স্ত্রীকে মমতা কী চাকরি দেবেন? এ কথা বলতে বলতে টেলিফোনে হাহাকার করে ওঠেন কলকাতার জরিনা বেগম।