মিশর গেলে মুসার পাহাড়ে যাবেন না তা কী করে হয়। এর আরেক নাম তুর পাহাড়। সিনাই উপদ্বীপের সেন্ট ক্যাথরিন শহরে এ পাহাড়ের অবস্থান। মুসলমান, খ্রিস্টান উভয় ধর্মের মানুষ যার যার মতো করে এ পাহাড়কে পবিত্র মনে করেন।
কায়রো থেকে সেখানে যাবার দুটি পথ আছে। সোজা পথটির দূরত্ব ছিল ৪৩০ কিঃমিঃ। শারমুশ শাইখ হয়ে গেলে ৭৪০ কিঃমিঃ দূর হয়।
কোরানের আত-ত্বীন সুরায় বলা আছে এ পাহাড়ের মাহাত্ব্যের কথা। বলা হয় মুসা নবী এখানে নবুওত পেয়েছিলেন। হযরত মুসা (আঃ)। আল্লাহকে দেখতে চেয়ে একটি আলোর বিকিরন দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন মুসা নবী!
পাহাড় পুড়ে নাকি সেখানে সুরমার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল! মরভূমির বেদুইনদের কাছে এ পাহাড়ের নাম মুসার পাহাড়। আরেক নাম জাবাল মুসা। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২২৮৫ মিটার উঁচু পাহাড় এই পাহাড়।
এতো উপরে ওঠার পথ আছে দুটি । আপনি পায়ে হেঁটে যেতে পারেন। অথবা যেতে পারেন বেদুইনদের উঠের পিঠে চড়ে। আমি হেঁটে গিয়েছিলাম। সঙ্গে অনেক লোকজন ছিল। তারা নানা দেশের পর্যটক। আমিই ছিলাম একমাত্র বাংলাদেশি।
আমাদের দলটির পায়ে হেঁটে যেতে যেতে চূড়ায় উঠতে প্রায় তিন-চার ঘন্টার মতো সময় লেগে গিয়েছিল। গরমের সময় বলে আমরা মধ্যরাতের দিকে রওয়ানা হওয়া হয়েছিলাম। তাতে সূর্যোদয়ের আগেই সেখানে পৌঁছা সম্ভব হয়।
সকালের সূর্যোদয়ের সময় পাহাড়ের চূড়ো থেকে গোটা এলাকাটি দেখার অনুভূতিই ছিল আলাদা। ওই সময়টায় যারা যাবেন তারা সঙ্গে বাড়তি একাধিক পোশাক-টাওয়েল আর পর্যাপ্ত পানি সঙ্গে নেবার চেষ্টা করবেন।
কারন তাপমাত্রা সেখানে গরমে চল্লিশ বিয়াল্লিশ ডিগ্রী পর্যন্ত চড়ে। মরুভূমির গরমে সারা শরীর কাপড়ে ঢেকে রাখা উত্তম। নতুবা বোধ করবেন গা পুড়ে যাচ্ছে। আরবরা যে এতো জোব্বা জোব্বা কাপড় পড়ে এর কারন কিন্তু তাই।
পাহাড়ে চড়া নামার সময় ক্লান্তিতে পাথরে বসে পড়লে সেখানেও বেদুইন হকারদের কাছে পানীয় কিনে খেতে পারবেন। সমস্যায় পড়বেননা।
পূর্নিমার রাতে মুসা নবীর পাহাড় দেখার অভিজ্ঞতার কথা আমি শুনেছি। যিনি বলেছেন তার নাকি বিশেষ একটি অনুভব হয়েছিল মরুভূমির রাতের সেই পর্বত চূড়ায়।
মুসা নবীকে তখন বিশেষ সোভাগ্যবান মনে হয়। যিনি এমন ভরা পূর্নিমার চাঁদ দেখার বিশেষ একটি পাহাড়ের সন্ধান পেয়েছিলেন।
তুর পাহাড়ের চূড়ায় আছে একটি গুহা। সেটি এখন বেশ যত্মে বাঁধানো। গল্পটি এমন এই গুহায় বসেই আল্লাহর কথা ভাবতেন মুসা নবী। হযরত মুসা (আঃ)। আল্লাহর ধ্যান করতেন।
এতে আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে নবুওত দেন। এই তুর পাহাড়ের কথা আছে বাইবেলেও। সে কারনে মুসলমান, খ্রিস্টান দুই ধর্মের পর্যটক, তীর্থযাত্রীদের কাছে তুর পাহাড়ের ধর্মীয় ও পর্যটন গুরুত্ব।
মিশরের পর্যটন দপ্তর দুই ধর্মের তীর্থ যাত্রীদের প্রার্থনার সুবিধার কথা মাথায় রেখে সেখানে পৃথক দুটি প্রার্থনা কক্ষ নির্মান করে রেখেছে।
দুই সম্প্রদায় সেখানে গিয়ে যার যার ধর্মের নাম লেখা দেখে নির্মিত নির্ধারিত প্রার্থনা কক্ষে ঢোকেন। যার যার স্রষ্টার নামে প্রার্থনা করেন। আর এর মাধ্যমে দু’পক্ষ থেকেই পাউন্ড কামায় ট্যুরিজম বোর্ড। ইজিপশিয়ান পাউন্ড।
এ দেশটায় আসার পর থেকে ইজিপশিয়ান ট্যুরিজম বোর্ডের কামাই করার সাজানো ব্যবস্থাদি যত দেখছি তত মুগ্ধ হচ্ছি। পিরামিড, ফেরাউনের মমি দেখিয়ে এরা যেমন কামায় তেমন কেমন ইমাম হোসেনের মস্তকের মাজারে।
এখানে আবার তুর পাহাড়ে। সব জায়গাতে আবার কিছু কমন রেপ্লিকা কিনতে পাওয়া যায়। পিরামিড, ফেরাউন, তার রানীর মূর্তির রেপ্লিকা। নানান বাহারী তসবিহও সব জায়গায় পাওয়া যায়। মুসলমান-খ্রিস্টান দু’পক্ষের প্রার্থনাতেই তসবিহ ব্যবহার হয়।
মুসলমানরা বিশ্বাস করে তুর পাহাড় ভস্মীভূত হয়ে সুরমার সৃষ্টি হয়েছিল। যা পবিত্র বিবেচনায় মুসলমানরা চোখে কাজলের মতো ব্যবহার করেন। তুর পাহাড়ের সেই চূড়াতেও মুসলমান পর্যটক-তীর্থযাত্রীদের চোখে সুরমা দেবার ব্যবস্থা আছে।
যদিও আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্কলার আমাকে বলেছিলেন তুর পাহাড় জ্বলে সুরমা হয়েছিল এর কোন ভিত্তি নেই। সুরমা একটি খনিজ। ইসলামের ইতিহাসে আছে মক্কার কাছের হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানের মাধ্যমে নবুওত পান হযরত মোহাম্মদ (দঃ)।
আর হযরত মুসা (আঃ) নবুওত পান তুর পাহাড়ের আরাধনায়। মুসা নবী তখন আল্লাহকে দেখতে এসেছিলেন।
আল্লাহ তখন তাকে বলেন তুমি আমাকে দেখতে পাবেনা। তুমি বরং পাহাড়ের দিকে তাকাও। তোমার দৃষ্টি যদি স্থির থাকে তাহলে তুমি হয়তো আমাকে দেখতে পাবে। অতঃপর আল্লাহ পাহাড়ের বিকিরন ঘটালে পাহাড় চূর্ন-বিচূর্ন হয়ে যান।
তাতেই জ্ঞান হারান মুসা নবী। তুর পাহাড় ট্যুরের গাইডরা এ গল্পগুলো ভক্তি শ্রদ্ধার উচ্চারনেই বলেন। ট্যুর প্যাকেজে এই গাইডও একটি অন্তর্ভূক্ত চরিত্র।
তুর পাহাড়ের কাছের আরেক পাহাড়ের নাম সানত কার্তিন। দক্ষিন সিনাই এলাকায় অবস্থিত এই পাহাড়টিকে বলা হয় মিশরের সবচেয়ে উচু পাহাড়। মুসা পাহাড়ের সঙ্গে লাগানো এই পাহাড় খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্র।
বলা হয় এটি ছিল খ্রিস্টান যাজকদের আবাসস্থল। সারা বিশ্ব থেকে খ্রিস্টান যাজকরা এসে এখানে প্রার্থনা করতেন। সোনালী রঙের পাহাড়টি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩৬০০ মিটার উঁচুতে।
দ্য বার্নিং বুশ নামের একটি গাছ আছে সিনাই পাহাড়ের পাদদেশে। মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি তিন ধর্মের মানুষের কাছে এই গাছকে পবিত্র বলা হয়। দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের ছোট ঝোঁপ গাছের মতো।
হাজার হাজার বছর ধরে সারা বছর সারা পৃথিবীর তিন ধর্মের পর্যটক তীর্থ যাত্রীরা দেখতে আসেন এই জ্বলন্ত গাছ নামের বার্নিং বুশ। বলা হয় কখনো শুকোয়না এ গাছের পাতা। এটিকেও এক ধরনের মিথ মনে করা হয়।