অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যে আমি থাকি। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার সবচেয়ে বেশি মানুষ থাকেন এ রাজ্যে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী-মৃত্যুও এ রাজ্যে বেশি। এখন পর্যন্ত ৬০১৩ জন করোনা রোগী চিহ্নিত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। মারা গেছেন ৫০ জন। নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যে আক্রান্ত ২৭৩৪ জন। এখানে ২১ জন এখন পর্যন্ত মৃত্যুবরন করেছেন। এক মহামারী রোগ আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। রুবি প্রিন্সেস এ রাজ্যে এখন এক অভিশপ্ত প্রমোদতরীর নাম। এই এক প্রমোদ তরীর মাধ্যমেই একক উৎসে সবচেয়ে বেশি করোনা ভাইরাসের রোগীর সৃষ্টি এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
আমি একটি রাতের পালার কাজ করি। বিকাল ৫ টা থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত। বাসা থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব ২৮ কিঃমিঃ। এর আগে বিকাল বেলায় আমার কাজে পৌঁছতে মাঝে মাঝে দেড় ঘন্টা লেগে যেত। করোনা পরিস্থিতির কারনে রাস্তায় এখন গাড়ি কম। চল্লিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই। পথঘাট সব মাঝে মাঝে বেশ ভুতুড়েও মনে হয়। উজ্জ্বল উচ্ছল এক শহরকে যেন গলা চেপে ধরেছে মহামারীর আতঙ্ক। বুধবার কাজে যাবার আগে এক চক্কর গিয়েছিলাম সিডনির বাঙ্গালি এলাকা লাকেম্বায়। করোনা দুর্যোগে অনেক লোকজনের মতো প্রিয় প্রজন্ম অনেক বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীও এখানে চাকরি হারিয়েছে। আগে লাকেম্বায় পা রাখলেই তাদের অনেকের সঙ্গে দেখা হতো। এখন সে চেহারা লাকেম্বার নেই।
বাংলাদেশি রেষ্টুরেন্ট সব জৌলুস হারিয়েছে। কারন বাঙ্গালি রেষ্টুরেন্টে আড্ডা জমিয়ে খেতে ভালোবাসে। টেইকওয়ে সার্ভিস এখানে নিষ্প্রভ। কিন্তু করোনা সতর্কতায় এদেশের সরকার বার-রেষ্টুরেন্ট সবকিছুতে বসে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করেছে। একসঙ্গে দু’জনের বেশি জমায়েতও এখানে নিষিদ্ধ। আইন ভাঙ্গলে হাজার ডলারের বেশি জরিমানা হয়। তাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বেরুনো বাদ দিয়েছেন। সাম্প্রতিক চাকরি হারানো এক বাংলাদেশি ছাত্রকে কিছু বাজার দেবার কেনাকাটা শেষে তার বাসার সামনে যেতেই ফোন করলে বললো সে চাকরির খোঁজে বেরিয়েছে। দেখা হলোনা।
অতএব আবার ড্রাইভ শুরু কাজের উদ্দেশে। হাতে সময় থাকলে পথের কোন একটি সুপারমার্কেটে মাঝে মধ্যে ঢু মারি। আজও থেমেছি উইনস্টনহিল শপিং সেন্টারে। আমাদের এখানে ছোট দোকানের চাইতে সুপারমার্কেটে দুধ সহ অনেক ভোগ্যপন্য তুলনামূলক সস্তা। করোনার ছায়া এখন সবখানে। অনেক দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য দেশের টেলিভিশনগুলোতে প্রায় ফিলার হিসাবে দেখানো হয়। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জনগনকে বাগানে হুমড়ি খেয়ে না পড়তে অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। তাঁর বক্তব্য সামর্থ্যবানরা বেশি কিনে মজুদ করতে গেলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এতে দরিদ্র মানুষের সমস্যা বাড়ে।
এই দুর্যোগে প্যানিক বায়িং অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। লবন, চিনি, তেল, টয়লেট টিস্যু, পেপার টাওয়েল, হ্যান্ড সেনিটাইজারের এলাকাগুলো অনেক সুপার মার্কেটেই শুন্য দেখি প্রায়। কাজেই যখন যে শপিংমলে এসব দেখি কিনে রাখি গাড়িতে। যার ঘরে যেটি নেই তাকে যদি সহায়তা করা যায়। এসব সুপার মার্কেটে ঢুকতে কড়াকড়ি মানতে হয় সামাজিক দূরত্বের নীতিমালা। ঢোকার পথ বেরুবার পথ আলাদা মার্ক করা। সুপার মার্কেটে ঢোকার পথে হাসিমুখ অভ্যর্থনা কর্মী এগিয়ে দিচ্ছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার অথবা এন্টিব্যাকটেরিয়াল টিস্যু রুমাল। ট্রলি নিরাপদ করে সংগ্রহ করার ব্যবস্থাও ভিতরে।
পন্য সংকটে সুপার মার্কেটগুলো পড়লেও এগুলোয় পন্যের দাম বাড়েনি। রেশনিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন একজন এক প্যাকেটের বেশি টয়লেট টিস্যু কিনতে পারেননা। এক প্যাকেটে থাকে ২৪ পিস টয়লেট টিস্যু। পেপার টাওয়েলও রেশনিং করা একজনে এক প্যাকেট। হ্যান্ড সেনিটাইজার খুব কম সুপারমার্কেটে এখন কিনতে পাওয়া যায়। পরিচিত প্রিয় প্রজন্ম অনেকের ঘরে অনেক সংকট থাকলেও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারেনা। নিতেও চায় না। জোর করে দিয়ে আসতে হয়। সবাই চায় একটা জব। নতুনদের জব পাওয়া এখন বেশ কঠিন। সাহস দিয়ে কাউন্সিলিং করে তাদের মন চাঙ্গা রাখতে হয়। এত খারাপ সময় আমরা অস্ট্রেলিয়ায় এর আগে দেখিনি। সবাইকে একটাই কথা বলতে হয়। এই খারাপ সময় থাকবেনা। সাহস হারাতে নেই। সাহস হারানো তারুন্যের মানায়না।
এখন এদেশের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা করছে অনলাইনে। স্কুল খোলা। যাদের অভিভাবকরা কাজ করেন তাদের অনেকের বাচ্চারা এখনও স্কুলে যায়। আবার বাবা-মা’কে কাজে আগ্রহী করলে তাদের বাচ্চাদের চাইল্ড কেয়ারের পুরো খরচ সরকার দিচ্ছে। ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের এই চাইল্ড কেয়ার ফ্যাসিলিটি বেশি কাজে দিচ্ছে। এদেশে প্রতি দশ সপ্তাহ পরপর দুই সপ্তাহের জন্যে স্কুল ছুটি থাকে। এই স্কুল হলিডের সময় অভিভাবকরা বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যান। ইস্টার-স্কুল হলিডের আগে শেষ ক্লাস ছিল বুধবার। এবার আর কেউ ছুটি কাটাতে কোথাও যাবেননা। ইস্টারে ডিম্বাকৃতি চকলেট কিনে সবাই বাড়ি যাচ্ছেন। কিন্তু ইস্টারে কেউ এবার গির্জার প্রার্থনায় যাবেননা। কারন সব গির্জায় এখন তালা ঝুলছে। কারন এখন যে করোনা সময়। ঘর থেকে বেরুলেই মৃত্যুভয়। এখানে এখন আমরাও ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুই। হ্যান্ড সেনিটাইজার দিয়ে নিরাপদ করার চেষ্টা করি নিজের দুই হাত।
প্রতিদিন সকালে আমার সঙ্গে একজন বাংলাদেশি ছাত্র কাজ থেকে বাড়ি ফিরে যান। পাশাপাশি আসনে বসতে আমরা মুখে মাস্ক পরে নেই। গ্ল্যাবস পরে নেই হাতে। বাংলাদেশের টেলিভিশনের কোন অনুষ্ঠান অথবা এবিসি রেডিওর খবর শুনতে শুনতে বাড়ি যেতে যেতে আমরা জেনে নেই করোনোর আপডেট। জীবনের নানান অভ্যাস এমন আমাদের বদলে গেছে। বাংলাদেশে করোনা নিয়ে অনেক আলাপ হচ্ছে, কিন্তু লোকজন নিষেধ মানছেনা। ভিড় করে এখানে সেখানে যাচ্ছে, আড্ডা মারছে। নানান অজুহাত দিচ্ছে। অথচ মানুষ বাড়িতে না থাকলে এ রোগের সংক্রমন কেউ ঠেকাতে থামাতে পারবেনা।
মানুষকে ঘরে রেখে রেখে কড়াকড়িভাবে সামাজিক দূরত্ব মানতে বাধ্য করায় অস্ট্রেলিয়া সুফল পাচ্ছে। সংক্রমন ২% হারে কমে আসছে। করোনায় চাকরি হারানো অস্ট্রেলিয়ানরা মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ব্যাংক একাউন্টে সরকারি সহায়তা হিসাবে সপ্তাহে সাড়ে সাতশ ডলার করে পাবেন। বেকারদের জব সিকার নামের একটি পেমেন্টের ব্যবস্থা অস্ট্রেলিয়ায় আগেই ছিল। এখন করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে নতুন একটি পেমেন্টের নামকরন করা হয়েছে জব কিপার। অস্ট্রেলিয়ার সংসদ বুধবার এ ব্যাপারে ১৩০ বিলিয়ন ডলারের বিশেষ স্টিমুলেজ প্যাকেজ পাশ করেছে।