১৯৭১ সালের ১৭ মেহেরপুরের বৈদ্যেরনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের যে শপথ হয়েছে তা কিন্তু চুয়াডাঙ্গা শহরে হবার কথা ছিল। কিন্তু চুয়াডাঙ্গার হ্যাবা ডাক্তারের এক বোকামির কারনে চুয়াডাঙ্গা সে ইতিহাসের অংশ হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। হ্যাবা ডাক্তারের ভালো নাম ডাঃ আসাবুল হক। তিনি তখন চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ভুল করে শপথের গোপন সংবাদটি তিনি একজন বিদেশি সাংবাদিককে বলে দেন। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ সরকারের নামে বানানো সিলমোহরের সিল সহ তিনি ওই বিদেশি সাংবাদিকের পাসপোর্টে বাংলাদেশের ভিসাও দিয়েছিলেন!
আবেগে উত্তেজনায় সেই বিদেশি সাংবাদিক এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট হিসাবে খবরটি তার বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করে দিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহর দখল করে নেয়। চুয়াডাঙ্গা বঞ্চিত হয় একটি ঐতিহাসিক ঘটনার শহর হবার গৌরব থেকে। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে বোকা লোকজনকে হাবাগোবা বলে কটাক্ষ করা হয়। ডাক্তার আসাবুল হকের নামটি হাবা না হয়ে হ্যাবা ডাক্তার নামের আড়ালে হারিয়ে যায়। এরপর আর মেহেরপুরের বৈদ্যেরনাথতলার শপথ অনুষ্ঠানের সঙ্গে আসাবুল হককে আর সংযু্ক্ত রাখা হয়নি।
অতঃপর মেহেরপুরের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পান চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ সভাপতি এ্যাডভোকেট ইউনুস আলী। এই ভদ্রলোক এখন বেঁচে আছেন কিনা জানিনা। আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় চুয়াডাঙ্গার বাড়িতে তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়। শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি নানা তথ্য তাঁর কাছেই পাওয়া। অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে ইউনুস আলী প্রথম যে সমস্যায় পড়েন তাহলো এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের কোন অবকাঠামোই ওই গ্রামে ছিলোনা। গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যে সব চেয়ার পাওয়া যায় সেগুলোর কোনটির হাতল নেইতো কোনটির আবার এক বা দুই পায়াই নেই! যেগুলোর পায়া নেই সেগুলোর নীচে ইট রেখে সেগুলোয় বসার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
এভাবে আশেপাশের কয়েক গ্রামের বাড়ি থেকে চৌকি, বেঞ্চ যা যেখানে পাওয়া গেছে তা দিয়ে মঞ্চ তৈরি ও বসার ব্যবস্থা করা হয়। মোটকথা যার বাড়িতে যা ছিল তা নিয়েই বাড়ির লোকজন অনুষ্ঠান আয়োজন সহায়তায় এগিয়ে আসেন। এরজন্যে অনেকে স্বেচ্ছাশ্রমও দেন। আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশতো এভাবেই অনেক মানুষজনের তিলতিল পরিশ্রমে গড়া। এভাবে মোটামুটি অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা করতে করতে নতুন এক দুশ্চিন্তা দেখা দেয়! নতুন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গাইতে জানে এমন কাউকে সেই তল্লাটে খুঁজে পাওয়া গেলোনা!
খবর পাওয়া গেলো সীমান্তের ওপারের কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের ক্লাস এইটের এক ছাত্রী গানটি জানে। মেয়েটিকে আনতে লোক পাঠানো হয় সীমান্তের ওপারে।রাত হবার আগেই মেয়েটির বাবা মেয়েটিকে নিয়ে আসেন। রাতে গ্রামের এক গৃহস্থের বাড়িতে সেই অতিথি গায়িকা মেয়েটি ও তার বাবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অনুষ্ঠানেও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত কোন বাংলাদেশি গাননি! গেয়েছেন একজন ভারতীয় বাঙ্গালি! আমি আর সাংবাদিক ইরতিজা নাসিম আলী একবার সেই মেয়েটিকে খুঁজতে কৃষ্ণনগর গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই মেয়েটির হদিশ কেউ দিতে পারেননি। ‘হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবেনা’। তারানা হালিমের প্রথম স্বামী এই ইরতিজা নাসিম আলী। এক সময় বার্তা সংস্থা ইউএনবিতে কাজ করতেন। প্রোব বার্তা সংস্থা নামের একটি নিউজ এজেন্সিও তাঁর ছিল।
এদিকে এই শপথ নিয়ে কলকাতায় আরেক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়! ১৬ এপ্রিল বিকালে কলকাতা প্রেসক্লাবে যান ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম। তিনি তখন তাজউদ্দিন আহমদের বিশেষ সহকারী। তাজউদ্দিন আহমদ, ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম কলকাতা পৌঁছবার পর এই দু’জনকে গোপনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যান বিএসএফ এর তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার গোলক বসু। কলকাতার মিডিয়ার লোকজন যাতে বুঝে না ফেলেন এরজন্যে নিয়মিত প্যাসেঞ্জার ফ্লাইটে না নিয়ে তাদেরকে সেনাবাহিনীর একটি মালবাহী বিমানে করে নেয়া হয়। এই দু’জন বঙ্গবন্ধুর একটি বার্তা ইন্দিরাকে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে ভারতের সহায়তা চান।
ইন্দিরা গান্ধী তখন বাংলাদেশের এমপিএ, এমএনএ যারা ভারতে পৌঁছেছেন তাদেরকে নিয়ে একটি প্রবাসী সরকার গঠনের পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুসারেই এপ্রিলের ১০ তারিখে আগরতলা সার্কিট হাউসে এমপিএ, এমএনএদের এক বৈঠকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রবাসী বিপ্লবী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। আগরতলার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। চুয়াডাঙ্গায় সেই সরকারের শপথ অনুষ্ঠান ভন্ডুল হয়ে গেলে সেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় মেহেরপুরের বৈদ্যেরনাথতলায়। মেহেরপুর তখন চুয়াডাঙ্গা মহকুমার একটি ইউনিয়ন মাত্র।
১৬ এপ্রিল ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম কলকাতা প্রেসক্লাবে গিয়ে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের একটি অনুষ্ঠান হবে। সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে গাড়ি আসবে। কাজেই সাংবাদিক যারা সেই অনুষ্ঠানে যেতে চান তারা যেন সকাল সাড়ে ৬ টার মধ্যে প্রেসক্লাবে উপস্থিত থাকেন। এ কথা বলেই ঝড়ের বেগে সেখান থেকে বেরিয়ে চলে যান ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম! বাংলাদেশ সরকারের কী অনুষ্ঠান, কোথায় অনুষ্ঠান, এসবের কিছুই তিনি খোলাসা করলেননা! আজকের মতো মোবাইল ফোন তখন নেই। তাই ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম বা বাংলাদেশের কারও সঙ্গে কেউ কোন যোগাযোগ করে আসল খবর কেউ নিশ্চিতও করতে পারলেননা। কিন্তু প্রেসক্লাবে উপস্থিত সাংবাদিকের মুখে মুখে খবরটি চাউর হয়ে যায় পুরো কলকাতার মিডিয়া পাড়ায়। সকালে এসে যদি গাড়ি ধরতে না পারেন সে উত্তেজনায় সাংবাদিকদের অনেকে আর বাড়িই গেলেননা। রাত কাটালেন প্রেসক্লাবেই।
১৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৬ টায় তিনটি গাড়ি আসে কলকাতা প্রেসক্লাবে। প্রথম গাড়িতে ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম বসেছিলেন। তিন গাড়িতে সাংবাদিকরা পড়ি কি মরি করে ওঠে গাদাগাদি করে বসেন। গাড়ি তিনটি চলতে থাকে। যশোর রোড ধরে গাড়ি তিনটি চলতে থাকে সীমান্তের উদ্দেশে। শুধু কলকাতার সাংবাদিক না, কলকাতায় থাকা কিছু বিদেশি সাংবাদিকও ছিলেন সেই দলে।
এরমাঝে বৈদ্যেরনাথতলার অনুষ্ঠানস্থলে চলে আরেক প্রস্তুতি। আমার তথ্যদাতা এ্যাডভোকেট ইউনুস আলীর মতে বিদেশি সাংবাদিকদের আস্থা অর্জনের জন্যে তখন কৌশলগত অভিনয়ের আশ্রয়ও নিতে হয়েছিল!
কী ছিল সেই অভিনয়? বাংলাদেশ সরকারের যারা শপথ নেবেন তারা ভোরেই বৈদ্যেরনাথতলায় গিয়ে পৌঁছেন। অনুষ্ঠানস্থল থেকে একটু দূরে ঝোঁপের মধ্যে ছিল একটি পরিত্যক্ত ইপিআর ক্যাম্প। ইপিআর মানে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস। তৎকালীন সীমান্ত রক্ষী দলের নাম। বৈদ্যেরনাথতলা পৌঁছবার পর শপথ যারা নেবেন সেই নেতাদের সেই ইপিআর ক্যাম্পে বসিয়ে রাখা হয়। সে কারনে বিদেশি সাংবাদিকরা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে দেখেন বাংলাদেশের নেতারা বাংলাদেশের ভিতর থেকে হেঁটে আসছেন! শপথ অনুষ্ঠান শেষে সেই নেতারা আবার হাঁটতে হাঁটতে চলে যান সেই ইপিআর ক্যাম্পে। বিদেশি সাংবাদিকরা দেখলেন বাংলাদেশের নেতারা চলে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ভেতরে!
এরপর নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে বিদেশি সাংবাদিকদের সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের বহন করা গাড়িগুলো চলতে শুরু করে কলকাতার উদ্দেশে। উত্তেজনায় সাংবাদিকরাও তখন কাঁপছেন! যার যার নিউজের লাইন মেলাচ্ছেন! কারন তারা ততোক্ষনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী! নতুন বাংলাদেশ সরকারের জন্মের ঐতিহাসিক ঘটনার। বিদেশি সাংবাদিকরা অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগের আধাঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশের নেতারাও কলকাতা রওয়ানা হয়ে যান। এর আধাঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী পৌঁছে যায় বৈদ্যেরনাথতলায়। আক্রোশে তারা তছনছ করে গোটা এলাকা! মুহূর্তে লন্ডভন্ড হয় বাংলাদেশের সেই জন্ম জনপদ।
কিন্তু এসবতো তখন পাকিদের অনর্থক গর্জন! কারন ততোক্ষনে জন্ম হয়ে গেছে নতুন বাংলাদেশের। তখন আর এসব তর্জন গর্জনে কী একটি নবাগত রাষ্ট্রের জন্ম পাল্টায়? বৈদ্যেরনাথতলার নাম পাল্টে এর নাম হয় মুজিবনগর। এখন প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস হিসাবে পালন করা হয়। আমার ‘একাত্তরের কলকাতা’ গ্রন্থে মুজিবনগর সরকারের জন্মের এ কাহিনী মুদ্রিত আছে।
মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস মুজিবনগর সরকারের কেউ আর সেই শপথ অনুষ্ঠানস্থলে যাননি বা সে পরিবেশও ছিলোনা। মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করতে কলকাতায় আসা বিদেশি সাংবাদিকরা মাঝে মাঝে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় দেখতে চাইতেন। বৈদ্যেরনাথতলার আমবাগানের ভিতর জমিদার যুগের পরিত্যক্ত একটি দ্বিতল ভবন ছিল। বিদেশি সাংবাদিকদের দূর থেকে দেখাতে সেই সময় দু’জন মুক্তিযোদ্ধাকে সশস্ত্র অবস্থায় পাহারায় দাঁড় করানো হতো সেই ভবনের বারান্দায়। দূর থেকে সেটি দেখিয়ে বলা হতো নিরাপত্তার কারনে তাদের সেখানে নেয়া যাবেনা। বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল দেখাতে নিয়ে যাওয়া হতো কুড়িগ্রামের রৌমারী-রাজিবপুরে। ব্রহ্মপুত্রে মূলভূমি বিচ্ছিন্ন রৌমারী-রাজিবপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কখনোই যেতে সাহস পায়নি। মুক্তির গান’ ছবির শুটিং’ও হয়েছে ওই এলাকায়।