আজ আমাদের আম্মা শহীদ জননীর জন্মদিন

শহীদ জননীকে আমাদের প্রজন্মের সাংবাদিকরা সবাই আম্মা ডাকতাম। তাঁকে আমাদের সবার আম্মা ডাকার বিশেষ একটি কারন ছিল। শহীদ রুমির সহযোদ্ধা ছিলেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাদেক হোসেন খোকা প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা।

যুদ্ধ শেষে তারা সবাই ফিরে এসেছেন। কিন্তু শহীদ রুমি ফেরেননি। তখন শহীদ জননীর কান্না থামাতে সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে আম্মা ডাকতে শুরু করেন। তাঁর পদবী-বিশেষন হয়ে যায় শহীদ জননী।

বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী শহীদ জননীকে আম্মা ডাকেন তাই তাঁর হাউসের শাহরিয়ার কবির থেকে শুরু করে সব সাংবাদিক-কর্মীরাও তাকে আম্মা ডাকতেন। বিচিত্রা থেকে বেরিয়ে সে হাউসের মিনার মাহমুদ বের করেন নতুন পত্রিকা বিচিন্তা। একই হাউসের শিল্পী মাসুক হেলালও ছিলেন বিচিন্তা হাউসের প্রায় সর্বক্ষনিক এক চরিত্র। তাদের প্রভাবে আমরা সবাই শহীদ জননীকে ডাকতে শুরু করি আম্মা।

কিন্তু যখন তাকে আমি আম্মা ডাকতে শুরু করেছি তখনও তাঁকে সামনাসামনি দেখিনি। তখনও জানতামনা এই আম্মার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটি যে কত আপন। কত গভীর।

৪১/২ দিলুরোডে রেল লাইন লাগোয়া এক ভবনে বিচিন্তার অফিস ছিল। সে অফিসে আম্মা প্রায় ফোন করতেন। মিনার মাহমুদ যখন অফিসে থাকতেননা আমাদের যে কেউ ফোন ধরতাম। তখন বুঝতাম বিচিন্তার প্রতিটি পাতা, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি নাম আম্মার মুখস্ত।

তিনি তখন আমাদের রিপোর্ট, আমরা খেয়েছি কিনা, কী খেয়েছি, মিনার খেয়েছে কিনা, সে ঠিকমতো ঘুমায় কিনা এসব নিয়ে গল্প শুরু করে দিতেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বিচিন্তার সার্কুলেশন বাড়ে।

আমাদের বিচিন্তা পত্রিকাটি আন্দোলনের অন্য রকম একটি কেন্দ্র ছিল। তারুন্যের সাংবাদিকদের অন্যতম নিউক্লিয়াসের নাম হয় বিচিন্তা। আমাদের একদল সাংবাদিক থাকতাম সেই অফিসেই।

বিচিন্তা অফিস কাম রেসিডেন্টসদের জন্যে বাজার তিন বেলা রান্না হতো। আমাদের একজন ইলিয়াস চরিত্র ছিল। যে ধানমন্ডির ম্যাডামের বাড়ি থেকে টিফিন ক্যারিয়ার বোঝাই করে নিয়ে আসতো নানান তরকারি। তিনি ছিলেন বিচিন্তার অর্থের উৎস।

বিচিন্তা অফিসের প্রথম আবাসিক সাংবাদিক ছিলাম আমি। দ্বিতীয় আমিনুর রশীদ এবং তৃতীয় আবাসিক সাংবাদিক আনোয়ার শাহাদাত। এভাবে একে একে আরও অনেকে সেখানে আসা থাকা শুরু করেন। 

 ঢাকা শহরে আমাদের এসব আবাসিক সাংবাদিকের তখনও কোন আলাদা বাসা বা ঠিকানা ছিলোনা। বিচিন্তা আমাদের কাছে ছিল একটি বিপ্লবের নাম।

যেহেতু এটি একটি ব্যাচেলর হাউস, এখানে নিয়মিত রান্না হয়, তাই দুপুরে এখানে খেতে আসতেন ঢাকার অনেক ব্যাচেলর সাংবাদিক, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা সহ অনেকে।

যেদিন পত্রিকার পেষ্টিং হতো সে দিন খাবার পাঠাতেন আজকের চ্যানেল আইর ফরিদুর রহমান সাগর। তখন তিনি আমাদের কাছে খাবার দাবার পিঠাঘর আর ইমপ্রেস ভিডিওর সাগর ভাই। সপ্তাহের এই একদিন আমরা সবাই ভালো খেতাম।

কোন কোন দিন দুপুরের খাবারের লোকসংখ্যা কুড়ি-পঁচিশজনও হয়ে যেতো। এই খাবারের দলে প্রায় নিয়মিত থাকতেন আবিদ রহমান, মাসুক হেলাল,  আফরোজা সুলতানা, আমান উদ দৌলা, মানিক রহমান, অশোক কর্মকার সহ অনেকে।

 কখনও কখনও যোগ দিতেন ইরাজ আহমেদ, সৌমি মুস্তাফা, আশরাফ কায়সার, জিল্লুর রহমান, আসিফ নজরুল, নুরুল ইসলাম ছোটন সহ আরও অনেকে। মাঝে মাঝে মোজাম্মেল বাবু, জাহাঙ্গির সাত্তার টিঙ্কু সহ আরও অনেকে চলে আসতেন।

এই খাওয়াদাওয়ার সময় আম্মা প্রায় ফোন করে জানতে চাইতেন আজকের খাবারের মেন্যু কী। তখন ফোন যে ধরতেন আম্মা তাঁর সঙ্গেও গল্প জুড়ে দিতেন। অফিসে মিনার ভাই থাকলে আমরা তাকে ফোন বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতাম খাবারের আড্ডায়।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় গুলিবর্ষনকে কেন্দ্র ‘চট্টগ্রামের গণহত্যা এবং নিরোর বাঁশি’ শিরোনামে বিচিন্তায় যে প্রচ্ছদ রিপোর্ট ছাপা-প্রচ্ছদ আঁকা হয়, এর অপরাধে বিচিন্তা বন্ধ করে দেয় স্বৈরাচারী এরশাদ।

 বিচিন্তা সম্পাদক মিনার মাহমুদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তখন আম্মার উদ্বেগ-ফোন করা সব বেড়ে যায়। আমরা কী করছি আমাদের চলছে কী করে তা তিনি খোঁজ নিতেন ঘন্টায় ঘন্টায়।

সে বছর একুশের বইমেলায় বিচিন্তার একটি স্টল নেয়া হয়। সেখানে বিক্রি হতো বিচিন্তার পুরনো সংখ্যা। মিনার মাহমুদের বই ‘মনে পড়ে রুবি রায়’।

আদতে এসব বিক্রির চাইতে পাঠকের সঙ্গে বিচিন্তা পরিবারের যোগাযোগটাই সেখানে ছিল মূখ্য। সেখানে বিচিন্তার স্টলে প্রতিদিন আসতেন আম্মা। মূলত তখনই আম্মার সঙ্গে আমাদের অনেকের প্রথম সামনাসামনি দেখা হয়।

সুতি শাড়ি পরা আম্মা আসতেন প্রায় প্রতিদিন বিকালে। ছোটকরে চুল কাটা, ক্যান্সার আক্রান্ত এক দূঃখিনী মায়ের মুখ। তখনই আম্মাকে অনেক অনেক ভালোবাসতে শুরু করি আমরা।

এখানে আমাদের খোঁজ নিয়ে আম্মা চলে যেতেন সন্ধানী প্রকাশনীর স্টলে। সন্ধানী থেকে বের হওয়া তাঁর বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ কয়েক বছর ধরে তখন মেলার বেস্ট সেলার।

ধীরে ধীরে আমাদের বিচিন্তা পরিবারটিও ভেঙ্গে যায়। আমরা বিভিন্ন পত্রিকায় গিয়ে যোগ দেই। কিন্তু আম্মার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটি অটুট থাকে। তাঁর এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি ‘ক্ষনিকায়’ গেলেই হাত ধরে বসিয়ে দিতেন খাবার টেবিলে।

আম্মা জানতেন আমাদের ভবঘুরে ব্যাচেলর গ্রুপের খাবারের জায়গা-টাকা প্রায় থাকতোনা। ঘরে হাড়িতে যাই থাকতো তা প্লেটে ঢেলে দিয়ে পাশে বসে আমাদের নানাজনের খোঁজ খবর জানতে চাইতেন আম্মা।

 এরশাদের পতনের পর একটি ঘটনা। টিএসসি, শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠনের বিজয় উৎসব চলছিল। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসব ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

আমাদের আম্মা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন। এর দু’দিন আগে সেই বিজয় ডামোঢোলের মধ্যে পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামায়াতের আমীর ঘোষনা করা হয়।

একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে দেখে পাকিস্তানে পালিয়ে যায় গোলাম আযম।  এরপর সেখানে থেকে এবং মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে পূ্র্ব পাকিস্তান উদ্ধারের ক্যাম্পেন করছিল এই জামায়াতি নরপশু।

 বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়ার আমলে সে পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে ফিরে আসে। তখন থেকেই সে পাকিস্তানি নাগরিক পরিচয়ে বাংলাদেশেই থাকছিল। আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমীর করে জামায়াতে ইসামী বাংলাদেশ গঠন করা হলেও এর নেপথ্যের আমীর ছিল গোলাম আযম।

এরশাদের পতনের পর সবাই যখন বিজয় উৎসব নিয়ে ব্যস্ত তখন কৌশল করে জামায়াতের আমীর ঘোষনা করা হয় গোলাম আযমকে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তখন উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়াও ছিলোনা।

কিন্তু শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সেই বিজয় সমাবেশে প্রথম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিস্ফোরিত হন শহীদ জননী।

তিনি সেখানে প্রশ্ন রেখে বলেন তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এটা কী করে সম্ভব? একটা খুনি পাকিস্তানি নাগরিক এখানে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়?

 যে লোকটি প্রত্যক্ষভাবে এসব হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। আম্মা সেখানে তেজোদ্বীপ্ত উচ্চারনে বলেন, আমি আমার মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের আদেশ দিচ্ছি, তোমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলো।

সেই সমাবেশের আগে আমি আম্মাকে এ রকম গোছানো জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে দেখিনি শুনিনি। আমার হাতে ছোট পেন্সিল ব্যাটারির একটি ক্যাসেট রেকর্ডার ছিল। সেই সমাবেশে বক্তৃতা দিতে দিতে আম্মা মাঝে মাঝে আমার ক্যাসেট রেকর্ডারের দিকে তাকাচ্ছিলেন।

 কারন আজকের দিনের মতো এত জনজনে ক্যাসেট রেকর্ডার তখন সব সাংবাদিকের হাতে থাকতোনা। তখনতো মোবাইল ফোনের কথাও আমরা জানিনি দেখিওনি।

কিন্তু আমার জীবনের যে কত বড় ভুল সেদিন করেছি তা পরে বুঝেছি। আমার ক্যাসেট রেকর্ডারের ব্যাটারি ছিল পুরনো। ব্যবহৃত। সে কারনে সেগুলোয় যে আম্মার বক্তৃতা রেকর্ড হয়নি তা বুঝতে পারার পর আক্ষেপের শেষ ছিলোনা। আমি আজও বয়ে বেড়াই সেই আক্ষেপ।

 সেই সমাবেশের পর আম্মা আমাকে বলছিলেন তুই আমাকে রেকর্ডের একটি কপি দিস। কিন্তু ঘটনা বলার পর তিনি চুপ মেরে যান। রাগে একটা বকাও দিয়েছিলেন।

আমার ক্যাসেট রেকর্ডার সেদিন বিট্রে করলেও বাংলাদেশ কিন্তু আম্মার সঙ্গে বিট্রে করেনি। মূলত সেদিনের পর থেকে শুরু হয়ে যায় গোলাম আযম সহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমের নতুন উদ্যোগ।

সিদ্ধেশ্বরীর আমিনাবাদ কলোনীতে ছিল কর্নেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামানের বাসা। তাদের আগেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কেন্দ্র নামের একটি সংগঠন ছিল। এই সংগঠন একটি সাড়া জাগানো প্রকাশনা ছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’ নামের ।

 ডঃ আহমেদ শরীফ, বিচারপতি কে এম সোবহান, শওকত আলী, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন সহ আরও অনেকের উদ্যোগে আম্মাকে সামনে রেখে শুরু হয় লাগাতার ধারাবাহিক বৈঠক।

আমাদের জুনিয়র সাংবাদিকদের এই দল তখন প্রত্যক্ষভাবে কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও আম্মা আর শাহরিয়ার কবির ভাইর ইচ্ছায় আমরা নিয়মিত সেই বৈঠকগুলোয় থাকতাম।

সেই বৈঠকগুলোর ধারবাহিকতায় আম্মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে প্রধান করে গঠিত হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে নতুন সংগঠন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

সংগঠনের ১০১ সদস্যের প্রথম আহবায়ক কমিটিতে আমরা আম্মার সন্তান জুনিয়র সাংবাদিকরাও ছিলাম সদস্য।

শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে বৈঠক করে অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ নামে তখন একই উদ্দেশে আরেকটি সংগঠন গড়া হয়। পরে দুটি সংগঠন নিয়ে গড়া হয় জাতীয় সমন্বয় কমিটি।

যুদ্ধাপরাধদের বিচারের আন্দোলনের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের ইচ্ছা ছিল কবি সুফিয়া কামাল জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান হবেন। আমরা সবাই তখন সুফিয়া কামালকে ডাকতাম সুফিয়া খালা।

তখন সুফিয়া খালা সংগঠনের প্রধান হিসাবে শহীদ জননীর নাম প্রস্তাব করে বলেন জাহানারার ছেলে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ। তাই সে এই সংগঠনের প্রধান হলে ভালো হবে। তাছাড়া আমি এখন বেশ অসুস্থও।

মূলত তখন সুফিয়া খালার ইচ্ছাতেই শহীদ জননী হন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সংগঠন জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেত্রী। তখন থেকে ২৬ শে মার্চ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকি বিচারের প্রস্তুতি চলতে থাকে।

তখন আমাদের সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম নামের একটি পত্রিকা ছিল। ৭৬ সেগুন বাগিচায় ছিল এই পত্রিকার অফিস। বিচিন্তার মতো এই অফিসও ছিল আবাসিক। প্রতিদিন বাজার-রান্না-খাওয়া হতো অফিসেই।

প্রভাষ আমিন, রোকন রহমানের নেতৃত্বে প্রিয় প্রজন্ম অফিস চলতো। মিন্টু আনোয়ার, জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল, মীর মাসরুর জামান রনি, জুলফিকার আলি মাণিক, নঈম তারিখ, অম্লান দেওয়ান, ইমন শিকদার, ফজলুর রহমান, হাফিজুর রহমান কার্জন, নজরুল কবির, বিপ্লব হমান, পল্লব মোহাইমেন, প্রিসিলা রাজ, নাফিস আহসান, মেহেদি হাসান, মানস ঘোষ, উত্তম সেন, সাঈদ খন্দকার, তামান্না রহমান, নাহিদ কবির সহ একদল সৃষ্টি সুখের উল্লাসী সারাক্ষন মাতিয়ে রাখতেন প্রিয় প্রজন্ম অফিস।

সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব নাজিম উদ্দিন মোস্তান সময় পেলেই চলে আসতেন। চারন সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন ঢাকায় এলেই চলে আসতেন প্রিয় প্রজন্ম অফিসে । এখানে তারা তরুনদের নিয়ে করতেন সাংবাদিকতার ক্লাস।

নঈম নিজাম রাজনীতিকদের নিয়ে আসতেন প্রিয় প্রজন্ম পার্লামেন্টে। তসলিমা নাসরিন লিখতে শুরু করেন ‘আমার মেয়েবেলা’।

সঞ্জিব চৌধুরী প্রিয় প্রজন্মের মাঝের দুইপাতা নিয়ে বের করতেন ‘অনু প্রজন্ম’। তখন থেকে গান গাইতে গাইতে জনপ্রিয় হতে থাকেন দলছুটের সঞ্জিব চৌধুরী।

 কিন্তু প্রিয় প্রজন্মের সবার বড় পরিচয় আমরা সবাই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান, তাঁর আন্দোলনের সৈনিক। আমি যেহেতু আম্মা ডাকতাম, প্রিয় প্রজন্ম পরিবারের সবাই তাকে ডাকতো আম্মা। এভাবে আমাদের যত পত্রিকা, সাংবাদিক বাড়ে,  আম্মার তত সন্তানও বাড়ে।

একদিন আমান উদ দৌলা আমাদের অফিসে এসে বললেন আম্মার একজন বিশ্বস্ত সর্বক্ষনিক কর্মী দরকার। যে আম্মার প্রেস সেক্রেটারির মতোও কাজ করবে।

আমরা জুলফিকার আলি মাণিকের নাম প্রস্তাব করলে আমান ভাই তখনই তাকে নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের ক্ষনিকায় চলে গেলেন। প্রিয় প্রজন্ম তখন আম্মার আন্দোলনের মুখপত্র, ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করেছে।  

আমার আনন্দ ছিল অন্যখানে। পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস সংগ্রহ করতে করতে এই বিচারের জন্যেইতো আমি নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝে আমার হাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদতেন।

বাংলাদেশে সাধারন খুনের বিচার হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের হত্যার কেনো বিচার হবেনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কেনো বিচার হবেনা এ প্রশ্নগুলো তারা করতেন।

তখন এসব বিচারের স্বপ্ন দেখতাম। এভাবে বিচারের পক্ষে দেশের গুনীজনদের সঙ্গে এভাবে কাজ করতে পারবো ভাবিনি।

ঠিক হয় ছাব্বিশে মার্চে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে গোলাম আযমের প্রতীকি বিচারের আয়োজন করা হবে।

গণআদালতের বিচারে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের গণহত্যায় গোলাম আযমের অপরাধ মৃত্যুদন্ডতূল্য ঘোষনা করে সরকারকে বলা হবে তার বিচার করো। কিন্তু বিএনপি তখন এমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করলো যেন গোলাম আযমের না, খালেদা জিয়ার বিচার হয়ে যাচ্ছে!

বিচার পন্ড করতে মরিয়া হয়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয় সোহরাওয়ার্দি উদ্যান এলাকায়। গুজব রটে যে কোন সময় গ্রেফতার করা হতে পারে আম্মা জাহানারা ইমামকে। সে জন্যে গণআদালতের আগের রাতে আমাদের আম্মার বাসা ক্ষনিকায় পাহারা বসানোর উদ্যোগও নিতে হয়েছে।

 আমাদের প্রিয় প্রজন্মের পরিকল্পনা হয় সেই ছাব্বিশে মার্চে আমরা গোলাম আযমের বিচারের রায় নিয়ে একটি টেলিগ্রাম পত্রিকা বের করবো। প্রভাষ আমিন, রোকন রহমানের নেতৃত্বে কাজ চলছিল টেলিগ্রামের।

তখন কিছু পত্রিকার বাইরে ঢাকার খুব কম বাড়িতে কম্পিউটারে কম্পোজের ব্যবস্থা ছিল। শেখ হাসিনা তখনও ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বারের বাড়িতে থাকতেন। নিরাপত্তার কারনে তখন গণআদালতের ফাইন্যাল কাজকর্মের কম্পোজ হচ্ছিল বত্রিশ নাম্বার রোডের বাড়ির কম্পিউটারে।

সেই টেলিগ্রাম প্রস্তুতির রাতে প্রিয় প্রজন্ম অফিসে আসেন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা জাহাঙ্গির সাত্তার টিঙ্কু। আমাদের এসে বলেন তোমরা শুনলাম টেলিগ্রাম বের করবা। একটা সিডি দিয়ে গেলেন টিঙ্কু ভাই। যেটি আমাদের টেলিগ্রামের কাজ এগিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে।

গণআদালতের দিন মানুষের জনস্রোতে ভেস্তে গেলো খালেদা জিয়ার ১৪৪ ধারা। আবার প্রমান হলো বাধা দিলে মানুষ বাধা মানেনা। বাধা ভেঙ্গে সৃষ্টি করে জনসমুদ্র।

 শহীদ জননীর পাশে সেই বিচারের আদালতে বিচারকের সেই প্যানেলে বিচারপতি কে এম সোবহান, শওকত আলী, গাজীউল হক, কাজী আরেফ আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক, সৈয়দ হাসান ইমাম সহ উজ্জ্বল নেতৃবৃন্দ ছিলেন।

সে দিনের জনসমুদ্রে গণআদালতের বিচার অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা বেরিয়ে যাবার সময় অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন মানুষের হাতে হাতে প্রিয় প্রজন্মের টেলিগ্রামের শিরোনাম ‘গোলাম আজমের ফাঁসি’।

 সেই থেকে আমরা গণতদন্ত কমিশনের আয়োজনেও কাজ করেছি। প্রিয় প্রজন্মের সাংবাদিকরা বাংলাদেশের এলাকায় এলাকায় ঘুরে তুলে এনেছেন যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধী নেতাদের আমলনামা।

দেলোয়ার হোসেন সাঈদির একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বৃত্তান্ত, মতিউর রহমান নিজামী যে মইত্যা রাজাকার, কাদের মোল্লার নাম যে তখন ছিল কসাই কাদের এসবের বৃত্তান্ত প্রিয় প্রজন্মের সাংবাদিকদের সংগ্রহ করা।

শহীদ জননীর এক সাংবাদিক সন্তান তাঁর এভাবে মৃত্যুর জন্যেও দায়ী। একজন আটকে দিয়েছিলেন গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট। সেটির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্যান্সার তাঁর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

তাই কয়েকদফা ডাক্তারের এপোয়েন্ট পিছিয়ে তিনি যখন আমেরিকায় গেলেন তখন আর তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়ায় খালেদা জিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ মাথায় নিয়ে প্রান দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের শহীদ জননী। আমাদের আম্মা।

বিমান বন্দরে জাতীয় পতাকায় মোড়ানো লাশ গ্রহনের পর তাঁর লাশ আমরা বহনের সুযোগ পেয়েছিলাম সন্তানেরা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শহীদ জননীর স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়েছে শেখ হাসিনার হাতে। আবার বলি, এ বিচারের স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু স্বপ্ন যে এভাবে সত্য হবে তা ভাবতামনা। শুভ জন্মদিন আম্মা। অনেক কৃতজ্ঞতা প্রিয় প্রধানমন্ত্রী।

আজ আমাদের আম্মার ৯১ তম জন্মবার্ষিকী। অনেক ভালো থাকবেন আম্মা।