করোনার ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা অনেকটা জন্ডিস বা পায়ে ফ্র্যাকচার হওয়া রোগীর চিকিৎসার মতো। একজন জন্ডিসের রোগী যত বেশি বিশ্রামে থাকবেন তত তাড়াতাড়ি তিনি ভালো হয়ে যাবেন। জন্ডিসে আক্রান্ত আপনি বিছানায় শুয়ে যদি সারাক্ষন মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আপনি তত বিপদ বাড়াবেন। বিশ্রাম মানে পুরোপুরি বিশ্রাম। শুয়ে শুয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আপনার ব্রেনের বিশ্রাম হয়না।
ঠিক একইভাবে পায়ের ফ্রেকচারের ব্যান্ডেজ নিয়ে যতবেশি আপনি শুয়ে অথবা স্থির বিশ্রামে থাকবেন তত তাড়াতাড়ি আপনার ফ্রেকচারের বিপদ কাটবে। আর ওই সময়ে যদি আপনি যথাযথ বিশ্রামে না থাকেন তাহলে ভুগবেন দীর্ঘদিন। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম করোনা রোগী পাওয়া গিয়েছিল গত জানুয়ারিতে। মানুষকে ঘরে রাখতে পারায়, সামাজিক দূ্রত্ব কড়াকড়িভাবে মেনে চলায় এ দেশ এখন মোবাইলে এ্যাপ খুলে নিজেই খুঁজে বেড়াচ্ছে যদি কোন নতুন রোগী পাওয়া যায়!
আর বাংলাদেশের পরিস্থিতি প্রতিদিন নতুন নতুন বিপদের পথে হাঁটছে। অথচ বাংলাদেশে এ রোগটি এতোটা ছড়াবার কথা ছিলোনা। কারন বাংলাদেশে রোগটি ছড়াবার উৎস ছিলো কম। বাংলাদেশের সমাজ ইতালি-আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো বহুজাতিক না।
প্রথম যে সব প্রবাসীর মাধ্যমে এ রোগটি বাংলাদেশে ঢুকেছিল সে পরিস্থিতি বাংলাদেশ সামাল দিয়ে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু মানুষকে ঘরে রাখতে না পারায়, বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাধ্যমে এটির যে বিস্তার ঘটানো হচ্ছে, তা দ্রুত চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টসখাত দেশের মানুষজনের বিপুল প্রশংসার একখাত। প্রায় পঞ্চাশ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এ খাত। এর পাশাপাশি গড়ে তুলেছে সেলোয়ার-কামিজ-ওড়না-সেন্ডেল-লিপিস্টিকের বিশাল আরেক শিল্পখাত, গার্মেন্টস শ্রমিকরা যা কিনেন।
বিদেশে আমরা যারা থাকি তারা জানি সুপার মার্কেটে কাপড় কিনতে গেলে কাপড়ে কাপড়ে মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা দেখে আমাদের মাঝে কী অনুভব হয়। চিৎকার করে বলতে শুধু ইচ্ছে করে জয় বাংলা। আমাদের সুপারমার্কেটের ভিতরে শ্লোগান দেয়াটা সোশ্যাল নুইসেন্স, বেআইনি।
কিন্তু এই করোনার সময়ে বাংলাদেশকে যেন এই গার্মেন্টসখাতকে আমাদের আরেক নতুন করে চিনিয়েছে! এতোদিন ধরে এর মালিকরা এতো শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করলেন, বছরে একবার তাদের নিয়ে অনেকে পিকনিকও করেন, কিন্তু এখনও যেন তাদের কেউ কাউকে চেনেননা!
আমাকে একজন মালিক বললেন ছুটি পেয়ে যে এত শ্রমিক এভাবে বাড়ি চলে গেলো তা আমরা ভাবিনি বা তাদেরতো আমরা বাড়ি যেতে বলিওনি।
প্রিয় মালিক, আপনার জন্মওতো বাংলাদেশে তাইনা? বাংলাদেশের মানুষ আমরা আনন্দ অথবা শোকে, রোগে অথবা উৎসবে দারাপরিবার-স্বজনের সঙ্গে কাটাতে চাই। আমাদের গরিব মানুষজনের মধ্যে এসব আবেগসমগ্র এখনও টিকে আছে।
আর আপনাদের এসব শ্রমিকরা কোন পরিবেশে বসবাস করে এবং সেখান থেকে প্রতিদিন এসে নিজেদের জীবনজীবিকা টিকিয়ে রাখে আর আপনাদের জন্যে ডলারের কাড়িগুলো কামায় তাতো আপনারা জানেন অথবা জানেননা!
বস্তিতে অথবা মেসে একটি কক্ষে তাদের কতজন একসঙ্গে গাদাগাদি থাকেন তাতো আপনারাও জানেন। তাই এই অনিশ্চিত অবস্থায় গ্রামে চলে গেলে তারা ভালো থাকবেন ভেবেছিলেন, তাতো বাংলাদেশে জন্ম নেয়া বড় হওয়া মালিক হিসাবে আপনারাও জানেন নিশ্চয়।
যদিও এই মহামারীর আতঙ্কের এই সময়ে এরা যখন এভাবে গাদাগাদি ভিড় করে গ্রামে গেলেন, সে ছবি দেখে আমাদের সবার ভয় করেছে!
এরপর সরকারি ছুটির মধ্যে, যখন দূরপাল্লার বাস-ট্রেন-লঞ্চ সহ যখন গণপরিবহন বন্ধ, তখন সংবাদ সম্মেলন করে গার্মেন্টস মালিক, বানিজ্যমন্ত্রী বললেন স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করে কারখানা চালু করা সম্ভব!
এরপর আবার ফোনে-টেক্সট করে দাসযুগের মতো করে আদেশ করা হলো, তোরা অমুক তারিখের মধ্যে তোরা আয়, নইলে কিন্তু বেতন পাবিনা, চাকরি থাকবেনা বলে দিলাম!
কিন্তু সারাদেশ জুড়ে গণপরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় এই দাসগুলো যে কী করে আসবে তা কেউ ভাবলেননা। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, দায় এড়াতে মালিকদের মধ্যে দুই ভাগ হয়ে গেলো!
সারাদেশের মানুষ এই মহামারীর উদ্বেগ আতঙ্কের মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দেখলো বেতন আর চাকরি রক্ষায় পঙ্গপালের মতো হেঁটে ঢাকা রওয়ানা হয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক নামের বাংলাদেশের এই যুগের ভাগ্যহীন দাস-দাসীদের দল!
তখন মিডিয়ায় বিপুল সমালোচনার মুখে, একপক্ষ বললেন সব দোষ বানিজ্যমন্ত্রী আর নব্য আওয়ামী লীগার সালাম মুর্শেদিগ্রুপের! তারাই এখন এভাবে তাদের ডেকে এনে সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে।
এরপর দেশের মানুষ দেখলো গার্মেন্টস শ্রমিকরা এলাকায় এলাকায় বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করতে করতে রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদলো! মালিকরা বললো চার হাজার গার্মেন্টেসের জায়গায় আট-দশটা প্রতিষ্ঠানের বেতন নিয়ে সমস্যা হতেই পারে। এসব এমন কিছু নয়।
কিন্তু একটা দুধেল গরু যখন পাঁচ লিটার দুধ দেয়, সেই পাঁচ লিটারে এক ফোটা গোমূত্র পড়ে মিশে গেলে সেই গরুর সুনাম কোথায় হারিয়ে যায়, তা কিন্তু সেই মালিকরা বললেননা! তখন দুষাদুষিতে শ্রমিকদের আনানেয়ার মধ্যে করোনার ঝুঁকি শুধু বাড়ানোই হলো, গার্মেন্টস সেক্টর সচল হলোনা।
এখন সরকার যখন ৫ মে পর্যন্ত ছুটি দীর্ঘায়িত করছে, প্রধানমন্ত্রী যখন বলছেন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল বন্ধ থাকবে, এরমাঝে গণপরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় আবার দাসযুগের স্টাইলে শ্রমিকদের ঢাকা আনা হয়েছে। এবারও যখন শ্রমিকরা মাইলের পর মাইল হাঁটলো, তখন মালিকরা আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললেন, কী মরণ! আমরাতো শুধু ঢাকার আশেপাশে যে সব শ্রমিক থাকে তাদের আসতে বলেছি!
দূরে যারা থাকেন তাদের কষ্ট হবে, পায়ে ব্যথা করবে ভেবে দূরের শ্রমিকদের আসতে বলিনি! এসব এলোমেলো আলোচনায় কী দাঁড়ায় বুঝতে পারেন? বাংলাদেশের এই সেক্টরটি আজ পর্যন্ত মালিক-শ্রমিকদের মানবিক বোধ নিয়ে গড়ে ওঠেনি।
অথচ এই পৃথিবীর শিল্পবিকাশের সত্য, যেখানে যে শিল্পের ভিতর মানবিক বোধ ছিলোনা, মানুষকে ঠকানোর নিয়ত ছিলো, সেই শিল্প টেকেনি কোথাও।
বাংলাদেশের এই তৈরী পোশাক শিল্পের মালিকরা এখনও বলছেন শ্রমিকরা কারখানায় ঢোকার সময় তাদের হাত ধোয়াচ্ছি, পা ধোয়াচ্ছি, হাতে দিচ্ছি সুগন্ধী হ্যান্ড সেনিটাইজার! আমাদের কারখানায় শ্রমিকরা যতোক্ষন থাকবেন ততোক্ষন স্বাস্থ্যসম্মত-নিরাপদ ভালো থাকবেন!
কিন্তু এই যে বাংলাদেশের ডলার কামানো শিল্পের জীবন-জীবিকা বাঁচাতে উদগ্রীব শ্রমিকরা এখনও যেভাবে গাদাগাদি অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় বস্তির ঘরে থাকেন, যেভাবে তারা গাদাগাদি অবস্থায় এখনও কারখানায় যাতায়াত করেন!
এই মহামারীর সময়ে তাদের মাধ্যমে যদি সেই বস্তিতে রোগটি ছড়ায়, সেই পথগুলোতে রোগটই ছড়ায়, এমন কভিড নাইন্টিন পজিটিভ শ্রমিকদের মাধ্যমে সেই সব বস্তি-সেই সব পথ এবং সেই সব কারখানা লকডাউন হলে আপনাদের কার্যাদেশের গন্তব্য কোথায় থাকবে জনাব মালিক?
এই মহামারীর আতঙ্কের সময়ে যেখানে প্রতিদিন বাংলাদেশে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে বাংলাদেশের পুলিশ সহ নানাপক্ষের আন্তরিক সক্রিয় পরিশ্রমী ভূমিকা যখন মুগ্ধ হয়ে দেখি।
দেখি আন্তরিক ক্লান্তিহীন একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তখন প্রকৃত পরিণতি সম্পর্কে ভয়ডর কান্ডজ্ঞানহীন পোশাক কারখানা মালিকদের ভূমিকা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হই। আমাকে একজন মালিক বললেন, এইমাত্র এত মানুষের ভিড় ঠেলে গুলশান থেকে ফিরলাম! আপনারা রাস্তার এত মানুষ দেখেননা শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকদেরই শুধু দেখেন!
বাংলাদেশকে গৌরব দেয়া এই গার্মেন্টস মালিকরা এখন কাজ হারানোর ঝুঁকিতে ভীতসন্ত্রস্ত সত্য। বাংলাদেশের এই গার্মেন্টস শ্রমিকরা এখন জীবন-জীবিকা হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত সত্য। কিন্তু এদের সবাই যে এখন সেই সব অপরিণামদর্শী জন্ডিস বা ফ্রেকচারের রোগীর মতো সারা জাতির এতো দিন ধরে ঘরে থাকা সহ নানান সংগ্রামের সব অর্জন-সব চেষ্টা পন্ড করে দিতে চলেছেন তা কী ভাবতে পারেন?
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্মেন্টস শ্রমিকদের কারখানার ভিতরে রেখে কাজ করানোর কথা বলেছিলেন। গার্মেন্টস মালিকরা তাতে সাড়া দেননি। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সরকারি ছুটি, সামাজিক দূরত্ব সহ সারাদেশ একদিকে, গার্মেন্টসখাত যদি নিয়ন্ত্রনহীন নিজের মতো করে হাঁটে চলে দিনশেষে এই মহামারীর সময়ে বাংলাদেশের গন্তব্য কোথায়?