ইতালি প্রবাসী সেই কয়েকজনের ফুটেজ এখনও ভাইরাল হয়ে ভাসছে সোশ্যাল মিডিয়ায়! দেশে ফিরে হজ ক্যাম্পের অব্যবস্থাপনার জন্যে তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইন-পদ্ধতিকে গালিগালাজ করে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। বাংলাদেশের সবকিছু খুব-সুরত নিয়ম মাফিক হলে কি তাদের অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যান? উল্টো ইতালির মানুষজনইতো তাদের গ্রামে কামলা দিতে আসেন! যাই হোক, পরবর্তীতে জানা গেলো, এই ইতালি প্রবাসীদের কয়েকজনই দেশে প্রথম করোনার জীবানু নিয়ে আসেন। বিমান বন্দরে জ্বর যাতে ধরা না পড়ে সে জন্যে তারা বিমান থেকে নামার আগে বেশি করে প্যারাসিটামল টেবলেট খেয়ে নিয়েছিলেন! এভাবে তারা রোগটি প্রথমে ছড়িয়েছেন নিজেদের পরিবারে, পরে গ্রামে। এমনকি জেনে অথবা না জেনে প্রবাসী দুই মা-মেয়ে তখন গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের দুই বিয়ে বাড়ির ‘কন্যাদান’, ‘বধূবরন’ উভয় অনুষ্ঠানকেই পরিয়ে দেন করোনা ভাইরাসের বিষাক্ত মালা!
এরপরও তখনও এদের সংখ্যা আহামরি তেমন বড়কিছু ছিলোনা। এদের গ্রামগুলো লকডাউন করে বাংলাদেশের করোনা নিয়ন্ত্রন সম্ভব ছিলো। এবং তা করাও হচ্ছিলো। আমি একটা কথা বারবার লিখে আসছিলাম, তাহলো বাংলাদেশের করোনা মহামারী হবার সুযোগ নেই। অথবা এখন লিখতে হবে সে সুযোগ ছিলো কম। কারন বাংলাদেশের সমাজ কোন বহুজাতিক সমাজ নয়। এখানে সিংহভাগ মানুষ এক ভাষা বাংলায় কথা বলেন। এমনকি আদিবাসীরাও বাংলাটা ভালো বলেন, লিখেন, বোঝেনও।
অথচ সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, এমন কি ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুরের সমাজও বহুজাতিক। নানা দেশের শ্রমিকরা এসব দেশে কাজ করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে সৌদি আরব প্রথম উমরাহ ও পর্যটক ভিসা বন্ধ করে। এরপর মক্কা-মদিনার শুধু মসজিদ বন্ধ নয়, কার্ফুও জারি করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন সৌদি রাজ পরিবারের দেড় শতাধিক সদস্য।
একটা ছবি বেরিয়েছে! মুসলমানদের পবিত্র কাবা’র ঘরের মসজিদে এখন একজনই নামাজ পড়েন। তিনি সেখানকার পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ক্লিনার। আমেরিকা, ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন সহ যত দেশে করোনা ভাইরাস মহামারী হয়েছে, এর সবগুলো দেশের সমাজও বহুজাতিক। এসব দেশে এরমাঝে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন এসব দেশে। বিদেশের দুই শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশীর মৃত্যুও হয়েছে।
চীনের উহানে এই ভাইরাসের সংক্রমন শুরু হলেও কোন চীনা নাগরিকের মাধ্যমে এই রোগ বাংলাদেশ বা কোথাও ছড়ায়নি। কারন চীন লকডাউনের মাধ্যমে কড়াকড়িভাবেই তার নাগরিকদের নিয়ন্ত্রন করেছে। চীনা নববর্ষের ছুটিতে দেশে গিয়ে আটকাপড়া চীনা প্রকৌশলীরা বাংলাদেশে ফিরে এসে পদ্মা সেতুর কাজেও যোগ দিয়েছেন। করোনা নিয়ন্ত্রনের চীনা পদ্ধতির সাফল্যে সেই থেকে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে শ্লোগান হয়, স্টে হোম, বাড়িতেই থাকুন। এই বাড়িতে থাকার মাধ্যমেই রোগের সংক্রমন নিয়ন্ত্রন সম্ভব। চীনের পর একই পদ্ধতিতে সফল হয়েছে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড সহ আরও অনেক দেশ।
বাংলাদেশ শুরু থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ সহ সকল বাহিনীর মাধ্যমে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করেছে। এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু বেপরোয়া মানুষকে বাগে আনতে পারেনি রাষ্ট্র। বাংলাদেশের মতো গনতান্ত্রিক দেশগুলো চীনের ভাষায় সব কাজ করতে পারেওনা। মানুষ এখানে একেকজন বড়বড় অজুহাত মাষ্টার! কেউ ক্ষুধায়, কেউ নানা উছিলায় ঘরে থাকার আহবান-নির্দেশনা মানেননি। মোটকথা শুরু থেকে একদল মানুষের মিথ্যা বলার প্রবনতা পন্ড করছে সব আয়োজন।
শুরুতে ছুটি পেয়ে ঈদের ছুটির মতো ভিড় করে লোকজন যার যার গ্রামের বাড়ি যায়। সারা দুনিয়ায় যখন এই যুদ্ধ জয়ের অন্যতম প্রধান অস্ত্র ‘সামাজিক দূরত্ব’, তখন সবাই দেখেছে ফেরী ভর্তি গাদাগাদি মানুষের ভীতিকর ছবি! তখন জিজ্ঞেস করলে এই লোকজন বলছে গ্রাম তার কাছে শহরের চেয়ে নিরাপদ মনে হয়! কিন্তু তখনই মিডিয়ায় রিপোর্ট আসে বাড়িফেরা এই মানুষজনের উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সব গ্রামীন বাজার-গঞ্জ-জনপদ!
এরপর যখন সরকারের বানিজ্য মন্ত্রী ‘স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশে গার্মেন্টেসে কাজ করা যাবে’ বলে, সংবাদ সম্মেলন করেন, যখন বিশেষ কিছু গার্মেন্টেসের পক্ষে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ‘অত তারিখের মধ্যে না ফিরলে বেতন দেয়া হবেনা’ বলে হুমকি পাঠানো হয়, তখন বোঝা যায় যারা ঈদের ছুটির মতো করে বাড়ি গিয়েছিলেন তাদের সিংহভাগ মূলত গার্মেন্টস শ্রমিক!
এবার তারাই পড়ি কি মরি করে তারা ঢাকায় সহ কর্মস্থলের উদ্দেশে রওয়ানা হন। মানুষের ভিড়ের সেই ছবি আবার নতুন ভীতি ছড়ায়। কিন্তু তারা এসে বেতন পাননি। বেতনের দাবিতে আন্দোলন করার সুযোগ পান। সেই থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের বড়মাধ্যম গার্মেন্টসখাত এখন দেশে করোনা মহমারী ছড়িয়ে দেবার সম্ভাব্য ভীতির খাত!
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষজনের খাবারের ব্যবস্থায় সরকারের নানা উদ্যোগের চাইতে আবার ত্রান চুরি-চাল চুরির খবরগুলোই বেশি বেশি শিরোনাম হয়। পরিস্থিতির শিরোনাম মোটামুটি হয়ে দাঁড়ায়, ‘করোনায় মরতে রাজি, ক্ষুধায় মরতে রাজি নই’। এভাবে মানুষ করোনাকে পরোয়া না করায় এরমাঝে দূর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমন ঘটে গেছে।
সে সমস্যাটি এরমাঝে জটিল করে ফেলা হয়েছে। একজন আরেকজনকে দুষাদুষি করতেই আছেন! কতিপয় মিথ্যাবাদীর প্রতিযোগিতায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। রোগীরা মিথ্যা বলে সংক্রামিত করেছেন অনেক ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে। সিলেটের একজন চিকিৎসকের করুন মৃত্যুও হয়েছে। দেশে প্রথম এপিক সেন্টার হয়ে ওঠে নারায়নগঞ্জ। মূলত নারায়নগঞ্জ থেকে যাওয়া লোকজন এটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে গেছেন। এরপর পুরোনো ঢাকা, কেরানিগঞ্জ, এরপর গাজীপুর হয়ে উঠছে নতুন এপিক সেন্টার। এই এলাকাগুলোয় বিস্তর মানুষ মেসে বা বস্তির ঘরে তাদের গাদাগাদি থাকার বাস্তবতাই করোনা বান্ধব।
বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারাও তাদের দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করেননি। সৌদি আরব মসজিদ বন্ধ করেছে। কিন্তু ধর্মীয় নেতাদের ভয়ে বাংলাদেশ মসজিদ বন্ধের কথা বলতে পারেনি। কে মসজিদে নামাজ পড়বে কে পড়বেনা এ নিয়ে মুসল্লিদের মধ্যে মারামারিও হয়েছে। এরপরও সত্য প্রধান শহরগুলোতে শবেবরাতের ভিড় এড়ানো গেছে। কিন্তু একজন ধর্মীয় নেতার জানাজা উপলক্ষে শনিবার ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সরাইলে এই মহামারীর পিক সময়ের জন্যে যে ভীতিকর সমাবেশ ঘটেছে তাতে ফুটে উঠেছে ধর্মীয় স্পর্শকাতর ইস্যুতে রাষ্ট্রের অসহায়্ত্ব। কারন করোনা রোগীর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে এখন লকডাউন চলছে ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলায়!
এরপরওতো হাল ছেড়ে দেয়া যাবেনা। সাধারন মানুষজনের চিকিৎসা না পাবার ব্যাপক অভিযোগ-অসন্তোষের মধ্যেও চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরাই সামনে থেকে যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সবাই চিন্তিতও। কিন্তু এবার প্রথম থেকে পুলিশের যে চেহারাটি বাংলাদেশ দেখছে তা একেবারেই নতুন। শুধু মানুষকে আইন মানার কাজে ব্যস্ততা নয়, বাংলাদেশের থানাগুলোর ফটকের সামনে অভূক্ত মানুষেরা এখন খাবারের জন্যে লাইনে দাঁড়ায়! এবং তারা সেখানে খাবারও পায়! পুলিশকে ফোন, এসএমএস করলে বাড়িতে পৌঁছে যায় খাবার! রোগীকে পুলিশ হাসপাতালেও পৌঁছে দেয়!
এবং সবশেষে করোনায় মৃতের দাফন এড়াতে যখন স্বজনরা পালিয়ে যায়, পালিয়ে যায় কথিত সব মুসল্লীর পাল, তখন সেই লাশের জানাজা পড়িয়ে সেটি নিজের হাতে পরম মমতায় দাফনও করে পুলিশ! শনিবার এক টেলিভিশনে দেখছিলাম বরিশাল শহরে কর্তব্যরত সেনা সদস্যরা দায়িত্বপালনের পাশাপাশি তাদের খাবার থেকে নিরন্নদের খাবারও দেন! এই বাংলাদেশ কি হারতে পারে?
সাংবাদিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। অন্যরা তাদের ঝুঁকির কথাগুলো যেভাবে বলেন, এটাওটা না দিলে কাজ করবেনা বলেন, সাংবাদিকরা সেভাবে বলেননা। অথবা সাংবাদিকদের পেশাটাও সে রকম না। ভয়ডর এরা সেভাবে জানেননা বা সেটি জানলে এ কাজ কেউ করতেও পারবেননা। বেশিরভাগ মিডিয়া হাউসের বেতনেরও আগামাথা নেই। গার্মেন্টস কর্মীদেরও বেতন নিয়ে সাংবাদিকরা লিখেন। সাংবাদিকদের বেতন নিয়ে লেখার কেউ নেই। ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশ-মিডিয়ার উল্লেখযোগ্য সাংবাদিক এরমাঝে করোনায় আক্রান্তও হয়েছেন।
এসব নানান নেগেটিভের মধ্যেও উজ্জ্বল পজিটিভ হলো, সারা বাংলাদেশে এখন কান পাতলেই শোনা যায় দেবতার মতো একদল মানুষের পদধবনি। মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে কাজ করছেন এসব মানবিক মানুষেরা! আমার শহর কুলাউড়ার তরুন সংঘের ছেলেমেয়েরা যারা হাত পেতে ত্রান চাইতে পারেনা তাদের খুঁজে খুঁজে তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। বর্ষবরন অনুষ্ঠানের খরচের টাকায় ত্রান কিনে পহেলা বৈশাখে নওগার পত্মীতলার আদিবাসী গ্রামে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন এলাকার মানবিক ছেলেমেয়েরা। মানবতার এমন নজিরবিহীন সব মহৌৎসব এমন চলছে এখন সারা বাংলাদেশে।
জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ঘরে খাবার নেই এমন এসএমএস তিনিও পান। সঙ্গে সঙ্গে সে বাড়িতে খাবারও পৌঁছে দেয়া হয়। এমন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব যে দেশের আছে, দিন শেষে সেই দেশ কিন্তু হারবেনা। বাংলাদেশের মতো সীমিত সংখ্যক করদাতার জনবহুল দেশে মানুষের সুরক্ষায় সরকার যে সব আর্থিক সহায়তার ঘোষনা দিয়েছে, এ ব্যাপারে কাজ করছে তা কিছুদিন আগেও ছিল অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশে সে সামর্থ্যও অর্জন করেছে।
দেশের মানুষেরা এখন যে সব বেপরোয়া আচরন করছে, এর পিছনে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাও জড়িত। কারন এই সময়ে কারও মন ভালো নেই। মন যাদের ভালো নেই তারা এমন এলোপাতাড়ি আচরন করতেই পারে। অতএব মানুষকে বুঝিয়ে ঘরে ফেরাতে হবে। নিরন্নকে খাবার পৌঁছে দিতে হবে আরও কমপক্ষে পনেরো দিন। দেখবেন বাংলাদেশ যেমন সব যুদ্ধে জিতে, জিতবে এই করোনা যুদ্ধেও।