যুগান্তরে ছাপা একটি খবরে বলা হয় করোনা ভাইরাস নিয়ে সংকটজনক পরিস্থিতিতে ব্রিটেনে এখন ১৫ লক্ষ লোক অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। খবরটা শেয়ার করতেই ব্রিটেনবাসী আমার কিছু নিকটজন ক্ষেপে আগুন হন। তাদের বক্তব্য ব্রিটেনে অত অত সংখ্যক মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা দেয়া হচ্ছে। অতএব এসব মনগড়া খবর না ছড়িয়ে এই অবস্থায় বাংলাদেশে কত লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যাবে তা খোঁজ করতে বলা হয়।
আমরা যারা এসব কল্যান রাষ্ট্রের নাগরিক তারা সরকারি নানা সুযোগ সুবিধায় উপকৃত, তারা প্রদীপের আড়ালের অন্ধকার দিক সম্পর্কে তেমন জানিনা বা খোঁজও নেইনা। আমাদের এসব দেশে কত অবৈধ মানুষ আছেন থাকেন, গৃহহীন কত মানুষ এদেশের রাস্তায় ঘুমান তাদের খোঁজ কী আমরা জানি? একটা ঘটনা বলি। অস্ট্রেলিয়া আসার পর সিডনির জর্জ স্ট্রিটে অভাবী লোকজনের খাবার দেয়া হয় এমন একটি কেন্দ্রে একদিন ঢু মারলাম। যেটি প্রতিদিন সকাল আটটায় খোলে বিকাল চারটায় বন্ধ হয়ে যায়। অভাবী লোকজন লাইনে এখানে ঢোকে সকালের নাস্তার প্যাকেট বুঝে নেয়। ডাইনিং টেবিলে বসে খেয়ে সেখানকার স্নানাগারে গোসল করতে ঢোকে। কাপড় ধোয়া শুকোনোর সুবিধাদি কাজে লাগায়।
এরপর সেখানে টিভি দেখে পত্রিকা পড়তে পড়তে অপেক্ষা করে দুপুরের খাবারের। সেটি খেয়ে আয়েশ করে কিছু সময়। আমি তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে খাওয়ায় তারা খুব খুশি হয়েছিল। ‘সিডনির সরাইখানা’ শিরোনামের সে রিপোর্টটি জনকন্ঠে তখন ছাপাও হয়। সেখানকার এক কর্মকর্তা আমাকে বলেন তাদের ফিডিং সেন্টারটি শুধু সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত খোলা থাকে। তাহলে শনি-রবিবার এরা কোথায় খায়? আমাকে তিনি বলেছিলেন, গরিব মানুষের বুদ্ধি বেশি হয়। শনি-রবিবার এমন কোন কেন্দ্র খোলা থাকে তা নিশ্চয় তারা জানে। এই দুর্যোগে খবর নিতে গিয়ে জানতে পারি সংক্রমনের ভয়ে সেই কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এমন অভাবী মানুষজন এইসব দেশেও ঢের আছেন। উজ্জ্বল এসব দেশ-শহরের গৃহহীন বিস্তর মানুষ এখানকার রাস্তায়-পার্কের বেঞ্চেও ঘুমায়। এটা বিলাত-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া সব জায়গারই সত্য। সিডনির একজন অভিবাসন এনজিও কর্মী আমাকে একদিন মজা করে বলেছিলেন, এসব দেশে অবৈধদের মধ্যে সাদা চামড়ার লোক বেশি। তাদের কেউ সন্দেহও করেনা। অভিযোগ না পেলে পুলিশ তাদের জিজ্ঞেসও করেনা। করোনার সংকটজনক এই সময়ে এখন এসব দেশের আশ্রয়প্রার্থী, আবেদন জমা দিয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন, তাদের এখন মেডিকেয়ার-কাজের অনুমতি আছে। কিন্তু এই সংকটে কাজ হারিয়ে তারা এখন বেকার, হতভম্ব জীবন কাটাচ্ছেন। কারন তারা এখন কোন সরকারি সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছেননা। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো তাদের নাগরিক-স্থায়ী বাসিন্দাদের কল্যানেই শুধু দায়বদ্ধ।
অস্ট্রেলিয়ায় বিদেশি ছাত্রের সংখ্যা পাঁচলক্ষের বেশি। এখানে আসার আগে তারা ব্যাংকে বিপুল টাকা থাকার হিসাব দেখিয়ে নিজেদের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সন্তান পরিচয় দিয়ে ভিসা পেয়েছেন। তাদের বেশিরভাগ এই সংকটে বেকার হয়ে গেছেন। তাদের কান্নার খবর আমরা যারা নিরাপদ ভালো আছি তারা খুব কম জানি। সিডনির নানাজন তাদের নানাভাবে সহায়তার চেষ্টা করছেন। লাকেম্বার এক রেষ্টুরেন্ট মালিক বলেছেন তিনি তার কর্মীদের রেষ্টুরেন্টের দোতলায় ফ্রি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যাতে তারা এই সময়ে অন্তত টিকে থাকেন। উল্লেখ্য করোনা ভাইরাস সংক্রমনের ভয়ে অস্ট্রেলিয়ার সব রেষ্টুরেন্টও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর কোনটিতে শুধু টেইকওয়ে সার্ভিস চালু আছে।
এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি। এই সংকটে বাংলাদেশে কত লক্ষ লোক না খেয়ে মারা জানেন? এই আশায় যে শকুনেরা অপেক্ষা করছেন তাদেরকে বলছি। তারা হতাশ হবেন। চুয়াত্তরে সদ্য স্বাধীন দেশে আজকের মতো অত খাদ্য মজুদ ছিলোনা। চুয়াত্তরের দূর্ভিক্ষের পিছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রও ছিল। কুড়িগ্রামের বাসন্তিকে জাল পরিয়ে আফতাব আহমদ নামের যে ফটোগ্রাফার সাজানো ছবিটি তুলেছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মাথা নিচুঁ করেই হেঁটেছেন। আপনারা খেয়াল করছেন কিনা জানিনা, বাংলাদেশের মিডিয়ায় এখনও তেমন কিছু অশুভ শক্তি সক্রিয়। এরা সফল হবেনা। বাংলাদেশে অন্তত খাবারের অভাবে কেউ মারা যাবেনা।
এই আত্মবিশ্বাসের কারন শুনুন। বাংলাদেশের মানুষ দুর্যোগে একতাবদ্ধ এবং মানবিক হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ ছিলেন পরিবারে বেয়াড়া, অবাধ্য, বেকবেঞ্চার হিসাবে চিহ্নিত ঘরপালোনো ছেলে। মেধাবী-মা-বাবার বাধ্য অনুগত ছেলে খুব কম যুদ্ধে গেছে। স্বার্থ-ধান্ধার চিন্তায় কেউ অন্তত জীবনবাজির যুদ্ধে যেতে পারেনা। স্বার্থ-ধান্ধাবাজরাই মুক্তিযুদ্ধের পর নিজেদের গুছিয়ে নেয়। আর জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা অনেকে অবহেলায় পিছনে পড়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে এখনও কোটা আন্দোলন জয়ী হয় সত্য, কিন্তু তাদের প্রতি সহমর্মী মানুষ এখনও কম যায়নি।
আরো কিছু কারনে এখানে এই দূর্যোগেও কেউ না খেয়ে মারা যাবেনা। কারনসমূহ শুনুন। ১৯৮৮-১৯৯৮ সালে ঢাকায় ও দেশে বড় এবং দীর্ঘমেয়াদি দুটি বন্যা হয়। অপরাধের হার তখন শূ্ন্যের ঘরে নেমে এসেছিল। কারন অপরাধ যারা করতো তারাও তখন ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল মানুষ বাঁচনোর ত্রান কার্যক্রমে। এখনও খোঁজ নিয়ে দেখুন। পাড়া মহল্লার এমন চিহ্নিতরাই এখন ত্রান কার্যক্রমের পুরোভাগে কাজ করছে। এবার মানুষ বাঁচাতে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীর পাশাপাশি পুলিশ সহ সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের ভূমিকাটি ব্যতিক্রমী এবং মনকাড়া। খবর পেলেই পুলিশ এখন বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেয়, সন্তানসম্ভবা নারীকে পৌঁছে দেয় হাসপাতালে, এমন ঘটনা বাংলাদেশ এর আগে কী কখনো দেখেছে? বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে অভাবীরা তাদের দুর্দশার কথা জানালেও তাদের ঘরে খাবার পৌঁছে যাচ্ছে! মানুষকে খাবার দিচ্ছে সেনাবাহিনী-নৌ-বিমান বাহিনীর-কোষ্ট গার্ড-আনসারের সদস্যরা। এই বাংলাদেশ হারবেনা। এই বাংলাদেশে কেউ না খেয়ে মরবেনা।
নড়াইল থেকে মাশরাফির বাবা আমাদের স্বপন ভাই মাঝে মাঝে ফোন করেন। মাশরাফির নানান ত্রান কার্যক্রমের বাইরে এই বাবা সারাবছরই নানান কল্যান কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত থাকেন। আমি একবার তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ যখন ফোনে নানাকিছু বলছিলেন আমি তাঁর প্রশংসা করছিলাম কিন্তু তাঁকে কোন অঙ্গীকার করছিলামনা। কারন তাকে সহায়তার জন্যে বাংলাদেশে অনেক মানুষ আছেন, কিন্তু আমাদের শহর কুলাউড়ায় জাতীয় তরুন সংঘের কাজে হাত বাড়াতে মানুষ বিস্তর নেই।
তরুন সংঘের ফয়সল একদিন তাদের প্যাকেট বানানোর ছবি দেখাতে দেখাতে বললো, যারা অভাবের কথা বলতে পারেননা, লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রান নিতে পারেননা এমন একশ পরিবারকে ত্রান পৌঁছাতে তাদের তেত্রিশ হাজার টাকার মতো লেগেছে। ফয়সলকে বললাম আরও একশ প্যাকেটের ব্যবস্থা করতে। তাঁর কাছে টাকা পৌঁছে যাবে। আবেগে কেঁদে ফেলে আমার শৈশবের খেলা সাথী। সিডনিতে আমার সঙ্গে যে দু’জন কাজ করেন তাদের বললাম বাংলাদেশে টাকা পাঠাচ্ছি। তাদের নেক্সট পেমেন্ট থেকেও একশ ডলার করে সেই প্যাকেটে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তারা সায় দিয়ে বলেন এমন সময় যদি মানুষের কাজে না লাগি তবে আর কবে লাগবো। এই যে আমাদের সামাজিক বন্ধন, দেশেবিদেশে এমন শুভাকাংখী মানবিক মানুষজন যে বাংলাদেশের আছে সে দেশের লোক কী না খেয়ে মরবে? কখোনোই নয়।
আরেকটি বড় কারনে বাংলাদেশের লোকজন এই সংকটেও না খেয়ে মরবেনা। জাতীয় পার্টির নেতারা জানেন তাদের স্যার এরশাদ সংকটের সময়ও কোথায় কোন নারীর টানে নিখোঁজ হয়ে যেতেন! বিএনপির লোকজন জানেন তাদের ম্যাডাম ক্ষমতায় থাকতে তাঁর ঘুম ভাঙ্গতো কখন! যতোক্ষন ম্যাডামের ঘুম না ভাঙ্গতো ততোক্ষন সেই সরকার-দলও জাগতোনা! কিন্তু বাংলাদেশের এই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাতো ঘুমানইনা। তাঁর বদনাম হলো সবকিছুতে তিনি নাক গলান! এই মূহুর্তের সারা দুনিয়ার করোনা যুদ্ধের নেতৃত্বে থাকা সরকার প্রধানদের মধ্যে শেখ হাসিনার মতো দ্বিতীয় কাউকে পাবেননা যিনি সর্বক্ষনিক সবকিছুর সঙ্গে জড়িত, সে কারনে সব সিদ্ধান্ত আসছে দ্রুত। চাউল চোরদের খবর দিচ্ছেন? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেতো পাচ্ছেন তাদেরকে গ্রেফতারের খবর। এটাইতো আমাদের সমাজ। মানুষ আইন মানতে চায় না বলে এখানে করোনার সংক্রমনও বাড়ছে। কিন্তু এরপরও এই মানুষ যেভাবে মাস্ক পরা হাত ধোয়া শিখেছে, দেখবেন এর অনেক ইতিবাচক ফল আসবে আগামীতে। এই যুদ্ধে আমাদের বাংলাদেশ হারবেনা।