ক্লিওপ্যাট্রার রূপ রাজত্বের দখল নিতে বারবার যুদ্ধও হয়েছে আলেকজান্দ্রিয়ায়

সাবেক  স্ত্রী ফুলভিয়ার অক্টোভিয়ানের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে প্রেমিকা ক্লিওপ্যাট্রার জন্যে প্রান দিয়েছেন মার্ক অ্যান্টনি। ক্লিওপ্যাট্রাও প্রান দেন তাঁর সঙ্গে। এরসবই ঘটেছে আলেকজান্দ্রিয়ার রাজপ্রাসাদে।

ইতিহাসে নজির নেই এমন দ্বিতীয় কোন ট্র্যাজিক ঘটনার। এই ট্র্যাজিডির জন্যে রোমের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর গৃহযুদ্ধকে দায়ী করা হয়। গৃহযুদ্ধের নায়ক পম্পে। সিজারের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ।

জনসাধারণকে পম্পেই বোঝান তিনি অবিচারের শিকার। তার সঙ্গে হাত মিলান অ্যান্টনির সাবেক স্ত্রীর ভাই। পম্পে প্রচার চালান অকারনে তার পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে তার এই বিদ্রোহ।

জুলিয়াস সিজার জানতে পারেন তার বিরোধীরা পম্পের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। অথচ দেশের এই দুর্দিনে রূপসী ক্লিওপ্যাট্রার সঙ্গে ভোগবিলাসে মত্ত অ্যান্টনি! পড়ে আছেন আলেকজান্দ্রিয়ার রাজপ্রাসাদে।

এ অবস্থায় সিজার কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তার একান্ত বিশ্বস্ত একজন দূতকে মিশরে পাঠান। অনেক টানাপড়েনের পর সিজার তাতে সফল হন।

খ্রিস্টের জন্মের উনপঞ্চাশ বছর আগে এভাবে রোমনগরীতে এমন এক গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। পম্পের পরাজয়ের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটে। ক্লিওপ্যাট্রার দেশ আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশে পালিয়ে যান পম্পে।

তখনও কিন্তু বিজয়ীর মতো হুংকার তুলছিলেন জুলিয়াস সিজার! একটাই তাঁর উদ্দেশ্য। শত্রুর বিনাশ। সিজার নতুন আদেশ দেন অনুসারীদের।

পম্পেকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। যে কোন মূল্যে। সিজারের অনুসারীরা জানলো ক্লিওপ্যাট্রার দেশে পালিয়ে যাচ্ছে পম্পে। তারা তার অপেক্ষায় ওঁত পেতে থাকলো।

 সেখানে পৌঁছামাত্র সিজারের অনুসারীরা ছুরিকাঘাতে হত্যা করল পম্পেকে। আর তখন দূতের মাধ্যমে  ক্লিওপ্যাট্রাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন সিজার। প্রস্তাব শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন মিশর সুন্দরী।

শুরু হলো নতুন আরেক অধ্যায় টলেমি রানীর জীবনে। আবার একজন নতুন স্বামী! সিজারের সমর্থনে এভাবে আরও একবার নিজের সিংহাসন নিরাপদ করতে চাইলেন ক্লিওপ্যাট্রা।

এভাবে শাসন করতে থাকলেন মিশর। ইতিহাসের এই সুন্দরী রানীর জীবনের প্রেম-দ্বন্দ্ব কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্লিওপ্যাট্রা যখন রোমে অবস্থান করছিলেন তখন তাঁকে নিয়ে নতুন এক কানাঘুঁষা চলছিন রাজপ্রাসাদে!

অধস্তন এক জেনারেলের সঙ্গে তাঁর লিভটুগেদারের কানাঘুঁষা! এর মধ্যেই আরেক ঘটনা ঘটলো। এক পুত্রসন্তান হলো ক্লিওপেট্রার। আলেকজান্দ্রিয়ার লোকজন তার নাম দিল সিজারিঅন। ক্লিওপেট্রা বলতেন, টলেমি সিজার।

 কিন্তু সিজারের উত্তরাধিকারী ও ভাগ্নে অক্টোভিয়ান এটা  মেনে নেননি। সিজার বলতে থাকলেন সিজারিঅন তারই সন্তান। অনেকেই ভাবলেন, এটা সিজারের এক ধরনের চক্রান্ত।

একেতো তিনি একজন বিদেশি, এর ওপর বিবাহিত হয়েও ক্লিওপ্যাট্রার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন। কাজেই এটা কোনো নৈতিকতার মধ্যেই পড়ে না। তখন নানাদিক থেকে নানান সমস্যায় জড়াতে থাকলেন ক্লিওপ্যাট্রাও।

 চুয়াল্লিশ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের কোনো এক উৎসবের দিনে ইতিহাসের এ পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল। রোমের সিনেট বিল্ডিংয়ের সামনে ছুরিকাঘাতে নিহত হন সিজার। ইতিহাসে তাঁর হত্যা ষড়যন্ত্রও লেখা হয়েছে।

 বলা হয়, ব্রুটাসের নেতৃত্বে ক্যাসিয়াস, ট্রিবোনিয়াস, কেস্কাসহ ৬০ জন সিনেট সদস্যের প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সিজার প্রান হারান। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর রোম থেকে পালিয়ে যান ক্লিওপ্যাট্রা।

 চলে আসেন জন্মভূমি আলেকজান্দ্রিয়ায়। মৃত্যুর আগে সিজার তাঁর ছেলে বা প্রিয়তমা ক্লিওপ্যাট্রাকে কোনো কিছু উইল করে দিয়ে যেতে পারেননি। এটি তাঁর ছেলের জীবনকে নিয়ে যায় চরম এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে।

আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরার সময় ক্লিওপ্যাট্রার সঙ্গে ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্বামী অর্থাৎ পরবর্তী ভাই টলেমি-১৪। তখন তিনিও প্রান হারান। এতে করে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন চার বছর বয়সী সিজারিঅনই!

আলেকজান্দ্রিয়া ফিরে ক্লিওপ্যাট্রা দেখলেন সমগ্রী নগরী দুর্ভিক্ষ আর মহামারিতে পর্যুদস্ত। আলেকজান্দ্রিয়ার সেই এই দুর্ভিক্ষ আর মহামারী অনেক দিন ধরে চলেছে। সিজারিঅনের স্বীকৃতি আনতে চার পদাতিক সৈন্যকে রোম পাঠিয়েছিলেন ক্লিওপ্যাট্রা।

কিন্তু তারা সেখানে পৌঁছতে পারেননি উপায়ন্তর না দেখে বিশাল এক নৌবহর সাজিয়ে মার্ক অ্যান্টনি ও  অক্টোভিয়ানের উদ্দেশে নোঙর তোলেন ক্লিওপ্যাট্রা। কিন্তু ঝড়ের কবলে পড়ে পন্ড হয় সে যাত্রা।

রোম নগরীর কর্তৃ্ত্ব দ্বন্দ্বে ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াস নিহত হলে পরবর্তী কর্ণধার হিসেবে এন্টনি, অক্টোভিয়ান ও লেপিডাসই হবেন পরবর্তী বিজয়ী। ক্লিওপ্যাট্রা  ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন কে হবেন তাঁর জন্যে বেশি নির্ভরযোগ্য।

এক সময় অক্টোভিয়ান ভীষণ অসুস্থ হয়ে ফেরত গেলেন ইতালি। অ্যান্টনি ক্লিওপ্যাট্রার দেখভালের দায়িত্বেই থাকলেন। ৪১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মার্ক এ্যান্টনির পক্ষ থেকে টারসাস সফরের দাওয়াত পেলেন মিশর সুন্দরী রানী ক্লিওপ্যাট্রা।

অ্যান্টনিকে কিভাবে পেতে হবে তা এরমাঝে জেনে গিয়েছিলেন ক্লিওপ্যাট্রা। মিশর সুন্দরী অ্যান্টনির কৌশল ও কর্মপরিকল্পনাও জানতেন। মদ আর নারীতে ভীষন দূর্বল এই রোম সেনাপতি। সে উচ্ছৃঙ্খল এবং উচ্চাভিলাষী।

অর্থনৈতিক দুরবস্থার  তখন শেষ সীমায় উপনীত মিশর। এরপরও অ্যান্টনির বিপুল সংবর্ধনার আয়োজন করলেন ক্লিওপ্যাট্রা। সেই সংবর্ধনাকে তিনি এমনভাবে সাজালেন  যা এর আগে কেউ কোনোদিন  দেখেনি!

  নিজেকে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির মতো সাজালেন ক্লিওপ্যাট্রা। নগরের প্রবেশপথে একদল প্রায় উলঙ্গ নর্তকী অ্যান্টনির অভ্যর্থনায় দাঁড়িয়ে থাকলো। একজন দূর্বল মানুষকে আকৃষ্ট করতে এসবই ছিল যথেষ্ট।

ক্লিওপ্যাট্রা ভাবলেন নীলরক্তের অ্যান্টনি আরেকজন নীলরক্ত টলেমীয় রানীর ধ্যান-ধারণাকে পছন্দ করবেই। এন্টনির সাবেক স্ত্রী বা বর্তমান স্ত্রী ফুলভিয়া সবাইতো নি্তান্তই  মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত।

ক্লিওপ্যাট্রার পরিকল্পনা সফল হয়। অ্যান্টনি আর ক্লিওপেট্রা খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ৪১’র শীত মৌসুম পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয়ায় কাটালেন। এ সময় যা চাইতেন তাই পেতেন ক্লিওপ্যাট্রা।

কিন্তু এরপরেও যেন অ্যান্টনির ওপর  খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারছিলেননা ক্লিওপ্যাট্রা! আসলে তখন একবারেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন মিশর সুন্দরী। অ্যান্টনি চেয়েছিলেন অর্থসম্পদ।

আর ক্লিওপ্যাট্রার উদারতা ছিল মূলত যেখানে লাভের ব্যাপার থাকত সেখানে। মার্ক অ্যান্টনি ৪০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে স্বদেশে ফিরে যান। ক্লিওপ্যাট্রার সঙ্গে আর তার দেখা হয়নি।

এ দিকে ভাই অক্টোভিয়ানের বিরুদ্ধে জমিজমা সংক্রান্ত বিরাট একটা আন্দোলনের মুখে পড়েন অ্যান্টনির স্ত্রী ফুলভিয়া। এর মধ্যে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন ফুলভিয়া। এবং তিনি মারা যান।

ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে সেই শরতেই অক্টোভিয়ানের বোন ফুলভিয়াকে বিয়ে করেন অ্যান্টনি।  খুবই সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি রমণী ছিলেন ফুলভিয়া। অ্যান্টনির সঙ্গে বিয়ের খুব অল্পদিন আগে তিনি বিধবা হন।

আগের পক্ষে তাঁর তিন  সন্তান ছিল। আর তখনই আলেকজান্দ্রিয়ায়  মার্ক অ্যান্টনির ঔরসে ছেলে মেয়েসহ যমজ সন্তান প্রসব করেন ক্লিওপ্যাট্রা। অ্যান্টনি-অক্টোভিয়া দম্পতির প্রথম সন্তান হলো মেয়ে।

অথচ তখন যদি ফুলভিয়ার গর্ভে ছেলে সন্তানের জন্ম হতো তাহলে হয়তো ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিত। মার্ক অ্যান্টনি আর ক্লিওপ্যাট্রার প্রেমের কথা তখন রাজ্যের প্রধান আলোচ্য বিষয়।

 এরই মধ্যে দু’জনের সম্পর্ক যেন অনেকটা ফিকে হয়ে এলো। এতে করে এলোমেলো হয়ে চলতে লাগলো ক্লিওপ্যাট্রার জীবন। তবুও ক্লিওপ্যাট্রার জন্য অনেক কিছুই করেছেন মার্ক অ্যান্টনি।  

পার্থিয়ানের সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য অ্যান্টনি গ্রিস ছেড়ে ইতালি গেলেন। এরমাঝে  আরো একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন ফুলভিয়া। অ্যান্টনি জানালেন, কন্যাসন্তান জন্মদানের ব্যাপারটি তিনি মেনে নিয়েছেন।

বিদ্রোহী অক্টোভিয়ানের সঙ্গে এখনো শান্তি স্থাপনে রোমে অবস্থান করাই তার জন্য যুক্তযুক্ত হবে। অ্যান্টনির নামেই অ্যান্টনি-ক্লিওপ্যাট্রা দম্পতির যমজ সন্তানের অফিসিয়াল স্বীকৃত ছিল। নামও দেয়া হয়েছিল সেভাবেই।

 আলেকজান্ডার হেলিওস ও ক্লিওপ্যাট্রা সেলিনি। রাজ্য ভাগ করলেন গিয়ে মার্ক অ্যান্টনি। ক্লিওপ্যাট্রাকে দিলেন বিশাল কৃষিক্ষেত্র। দূর্ভিক্ষ মহামারীতে বিপর্যস্ত মিশরের জন্য ক্লিওপ্যাট্রার এটি খুবই দরকার ছিল।

সাইপ্রাস, সিলিসিয়ান বেলাভূমি, ফোনিসিয়া, কোয়েলি-সিরিয়া, জুদিয়া এবং আরব ভূখন্ডও ক্লিওপ্যাট্রাকে দেয়া হয়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করে দেয়া হয় মিশরকে।  

মিশরের জন্যে গঠন করা পৃথক বিশাল নৌবহর। পাথিয়ানের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা ছিল অ্যান্টনির পরিকল্পনা। এজন্য তাঁর ক্লিওপেট্রার সমর্থন দরকার ছিল। কিন্তু ৩৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পার্থিয়ানের সঙ্গে যুদ্ধে  হেরে যান ক্লিওপ্যাট্রা।

সেই যুদ্ধে পরাজয়ের কারনে ক্লিওপ্যাট্রার প্রতি অ্যান্টনির ঋণের পরিমাণ যেন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় আরো বেড়ে গেল। তখন জন্ম হয় তাদের তৃতীয় সন্তানেরও।

ক্লিওপ্যাট্রা সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ, কাপড়-চোপড়, খাবার-দাবার, বেতনভাতা ইত্যাদি নিয়ে দেখা করলেন অ্যান্টনির সঙ্গ। ৩৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের প্রথম দিকে ক্লিওপ্যাট্রাকে নিয়ে আবার মিশরে ফিরে এলেন অ্যান্টনি।