গুলতেকিনের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে নেটিজানরা এখন বিশেষ তৎপর। কারন গুলতেকিন নামটার সঙ্গে হুমায়ুন আহমেদের নাম জড়িত। বাংলাদেশের সমকালীন বাংলা সাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্রের সম্রাট দিকপালটির নাম হুমায়ুন আহমেদ। তাঁর কারনে একটি প্রজন্ম নতুন করে বই পড়তে, নাটক-সিনেমা দেখতে শুরু করেছিল। এদের অনেকের কাছে আবার হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্র সম্ভার একদিকে, কিন্তু তাঁর ব্যক্তি জীবন, দ্বিতীয় বিয়ে বিতর্ক যেন আরেক দিকে। হুমায়ুন জীবনচরিতে তাঁর ভক্তকূল আবার পুরুষতন্ত্র-নারীবাদী দু’ভাগে বিভক্ত! হুমায়ুন আহমেদ যে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন পুরুষতন্ত্রবাদীরা এর ঘোর সমর্থক। পুরুষ মানুষ সে আবার মুসলমান পুরুষ, দুটা কেন চারটি পর্যন্ত বিয়ে করতেই পারেন। নারীবাদীরা এর ঘোরবিরোধী। হুমায়ুন সাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্রের নারী ভক্তদের সিংহভাগ গুলতেকিন ইস্যুতে তাকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারেননি। গুলতেকিন নামটি তখন থেকে তাদের কাছে বিশেষ স্পর্শকোমল-ভালোবাসার। নিজের নাটক-সিনেমার নায়িকা শাওনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। কিন্তু এই পক্ষের কাছে শুরু থেকেই শাওন চরিত্রটি খলনায়িকার। হুমায়ুনচরিতের ট্র্যাজিক নায়িকার নামটি গুলতেকিন।
হুমায়ুন আহমেদের পাশাপাশি এই পরিবারের স্বনামখ্যাত জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব নামের আরও উজ্জ্বল দুটি চরিত্র আমাদের সামনে আছে। কিন্তু জাফর ইকবাল এবং আহসান হাবীবের ব্যক্তি-পারিবারিক জীবন নিয়ে কোথাও কোন বিতর্ক-কানাঘুষা নেই। বরং হুমায়ুন পরিবারের বিয়ে সংক্রান্ত নানা বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে এই দু’জনকে বিব্রত মনে হয়েছে। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারনে ভাইঝি তথা হুমায়ুন কন্যা শীলার সঙ্গে আসিফ নজরুলের বিয়ে নিয়ে জাফর ইকবাল তাৎক্ষনিক কঠিন একটি মন্তব্যও করেন। পুরুষতন্ত্রবাদীদের ধারনা হুমায়ুন আহমেদ-গুলতেকিন-শাওন, শীলা-আসিফ নজরুল, গুলতেকিন-আফতাব আহমদের বিয়ে নিয়ে এত আলোচনা-বিতর্কের কারন প্রথাগত বাঙালি মানস! অনুসরনযোগ্য প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে কোন বিতর্ক এই বাঙালি মানস আশা করেনা। এরা যে দেবতা নন, সবারই যে একটি ব্যক্তি জীবন, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ আছে তা এই মানস মানতে চায় না অথবা মানতে অভ্যস্ত না। জনশ্রুতির যে সব কাহিনী জানা-শোনা যায়, উল্টো পিঠের কথাগুলো সবাই জানেনা বা জানতেও চায় না। অথবা এসব নিয়ে অনেকের হাতে গবেষনা করার মতো বিস্তর বেকার সময়!
গুলতেকিন নামটা প্রথম শুনি নব্বুই দশকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের দুই ছাত্রী সাংবাদিক হতে সেগুনবাগিচার সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম অফিসে আসতেন। গুলতেকিন ছিলেন তাদের সহপাঠিনী। সেই দু’জনের কাছেও তখন গুলতেকিনের পরিচিতি হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী। ঘরে ছোট বাচ্চাদের রেখে গুলতেকিনের পড়াশুনায় ফেরার গল্পটি ছিল মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো। সেই দু’জনের কিন্তু আর সাংবাদিক হয়ে ওঠা হয়নি। তাদের একজন এখন কানাডা প্রবাসী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। অপরজন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ব্রিসবেনে স্থায়ীভাবে থাকেন। ভালো চাকরি করেন। হুমায়ুন-গুলতেকিনের ঘর যখন ভাঙ্গলো তখন ভেবেছি নিজস্ব সৃষ্টির জগত নিয়ে ব্যস্ত হুমায়ুনের গৃহকোনে তখনই কী গড়তে শুরু করেছিল গুলতেকিনের বিচ্ছিন্নতা-একাকিত্ব-বিষন্নতার ডালপালা? সে কারনেই তখন সংসার রক্ষার পাশাপাশি পড়াশুনায় ফিরে নীরবে নিজস্ব ক্যারিয়ার সংগঠনে মন দিয়েছিলেন গুলতেকিন? হয়তো তাই অথবা হয়তো তা নয়।
সংসারটা ভেঙ্গে যাবার পরও কিন্তু গুলতেকিন কোথাও হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে ভালোমন্দ কিছু বলেননি। এরজন্যে হুমায়ুন ভক্ত তথা সিংহভাগ নারী পাঠক-ভক্তদের বড় অংশের মনমত তখন গুলতেকিনের পক্ষে যায়। গুলতেকিন হয় একটি চাপা দীর্ঘশ্বাস অথবা নীরব কান্নার নাম । হুমায়ুন আহমেদের তখনকার একটি মন্তব্য এখনও মনে পড়ে। মিডিয়ায় টানাটানিতে তখন তিনি বলেছিলেন তাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে এখন কঠিন একটি সময়। তাদের সমর্থন দিতে হবে। মেয়ে শীলার প্রায় সমবয়সী শাওন হন হুমায়ুন আহমেদের নবপরীনিতা। শাওন-শীলা একসঙ্গে হুমায়ুন আহমেদের নাটকে-সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন। ওই ঘটনায় ধাক্কা খায় চেনা বাঙালি মানস। তবে হুমায়ুন আহমেদ ঠান্ডা মাথায় ওই পরিস্থিতি সামাল দেন। খুব স্বাভাবিক ছেলেমেয়েরা তখন নীরবে তাদের মায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়। সন্তানদের থিতু করে এক পর্যায়ে গুলতেকিন পাড়ি দেন আমেরিকায়। ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে সেখানেই চলে যান হুমায়ুন আহমেদ। শাওন তাদের দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে আমেরিকায় হন হুমায়ুনের চিকিৎসা সঙ্গিনী। এই চিকিৎসা সংগ্রামের কোথাও প্রকাশ্যে ছিলেননা গুলতেকিন, তাঁর সন্তানেরা। একটি বাঙালি ভাঙ্গা সংসারের নীরব দ্বন্দ্ব-কান্নাগুলো অবশ্য তখন লুকানো যায়নি।
ছেলে নুহাশের সঙ্গে একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল হুমায়ুন আহমেদের। হুমায়ুন সাহিত্যের হিমুগণ সবাই নুহাশের বয়সীরাই । অথবা সব হিমু যেন একেকজন নুহাশ। লেখার প্রয়োজনে মাঝে মাঝে নুহাশের সঙ্গে কথা বলে তরুন মানসের নানা কিছু জেনে নিতেন হুমায়ুন। মাঝে মাঝে মনে হতো নুহাশই বুঝি হুমায়ুনের ভাঙ্গা ও নতুন দুটি সংসারের সেতুবন্ধন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে নিউইয়র্কের চিকিৎসকদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে শেষবারের মতো ঢাকা বেড়িয়ে যান হুমায়ুন আহমেদ। নুহাশের নামে গড়া নুহাশ পল্লীতেও যান। নুহাশ, তাঁর বোনেরা তখন কী নুহাশ পল্লীতে গেছে? কেউ জানেনা। মৃত্যুশয্যায় শায়িত হুমায়ুনকে শেষ দেখা দেখতে নিউইয়র্ক যান আসাদুজ্জামান নূর, জাফর ইকবাল। দু’জন তাঁর কেবিন থেকে বেরিয়ে কান্না লুকোতে পারেননি। গুলতেকিনও তখন আমেরিকায়। নিজের থেকে তাঁর সেখানে যাবার সুযোগ কী ছিল? হুমায়ুন কী কোনদিন তাঁকে ডেকেছেন? অথবা ডাকা’র মতো মুখ-পরিবেশ তাঁর ছিল? মৃত্যু পর্যন্ত হুমায়ুন ভক্তদের মনে প্রশ্নগুলো ছিল। গুলতেকিন হয়তো হুমায়ুনকে ক্ষমা করেছেন। বাঙালি মানসের প্রায় সব নারীই তাই করেন। কিন্তু হুমায়ুন ভক্তরা গুলতেকিন ইস্যুতে তাঁকে ক্ষমা করেছেন কী?
ঢাকায় হুমায়ুনের লাশ আসার দিন হিমু সেজে বিমান বন্দরে গিয়েছিলেন নুহাশ। তাঁর শেষকৃত্যে জনসমুদ্র হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় নুহাসের লেখা পড়ে তখন মানুষ কেঁদেছে। গুলতেকিন আমেরিকা থেকে এসে হুমায়ুনের এক স্মরনসভায় যোগ দেন। আবার ফিরে যান আমেরিকায়। ক্রমশ প্রকাশ পায় চাপা দিয়ে রাখা নীরব কিছু দ্বন্দ্ব। কারন যশ-খ্যাতির সঙ্গে বিপুল সম্পদও রেখে গেছেন সাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্রের সম্রাট হুমায়ুন। নুহাশ পল্লীর চাবি নেই নুহাশের হাতে। শাওনের হাতে এ চাবির কর্তৃ্ত্ব। হুমায়ুন সাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্রের উত্তরাধিকার কপি রাইট কর্তৃ্ত্ব নিয়ে একা একা সিদ্ধান্ত-বক্তব্য দিচ্ছিলেন শাওন। এক পর্যায়ে নুহাশেরা চার ভাইবোন একটি বিবৃতি দিয়ে জানান দেন হুমায়ুন সাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্রের উত্তরাধিকার কপি রাইটে তাদেরও কর্তৃ্ত্ব আছ। কেউ যেন এ নিয়ে একা একা শুধু শাওনের সঙ্গে কোন চুক্তি-লেনদেন না করেন। বুদ্ধিমতী শাওন তখন আর এ নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়াননি। চুপ মেরে যান। কিন্তু ওয়াকিফহালরা জানেন মৃত্যুর পরও হুমায়ুন সাহিত্যের সব পুনঃমুদ্রন হয়েছে এবং হচ্ছে শাওনের জ্ঞাতসারে। হুমায়ুন সম্পদের আয়ের সবকিছু শাওনের একাউন্টেই জমা হয় এবং হচ্ছে।
ছাপ্পান্ন বছর বয়সী গুলতেকিন আবার এসেছেন আলোচনায়। আফতাব আহমেদ নামের একজন দীর্ঘদিনের বন্ধুকে তিনি বিয়ে করেছেন। সরকারি আমলা আফতাব নিজেও একজন লেখক। দশ বছর আগে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। নুহাশ ঘোষনা দিয়ে বলেছেন মায়ের বিয়ের আয়োজন করেছেন তার সন্তানেরা। বাঙালি মানসে এই বয়সীদের বিয়ে কোন আনন্দের খবর নয়। গুলতেকিনের ক্ষেত্রেতো নয়ই। হুমায়ুনের সঙ্গে সংসারটি ভেঙ্গে না গেলে আর দশজন বাঙালি বিধবা নারীর মতো তিনিও হয়তো এই বয়সে এভাবে বিয়ের কথা ভাবতেননা। এখানে দু’জন একা মানুষ আফতাব-গুলতেকিন দুই বন্ধু হয়তো জীবনের বাকি দিনগুলোর জন্যে একজন সঙ্গী বেছে নিয়েছেন। এতদিন দু’জনে ছিলেন বন্ধু। পাশ্চাত্যে এমন দুই বন্ধু পার্টনার হিসাবেও জীবন কাটিয়ে দেন। বাংলাদেশের সমাজ তা অনুমোদন করেনা। তাই তাদের বিয়ে করতে হয়েছে। ছেলে নুহাশের বক্তব্যে স্পষ্ট এটি তাদের মায়ের একাকিত্বের অবসানের উদ্যোগ। কিন্তু নেটিজানদের অনেকে নানা কটাক্ষের হুল ফোটাচ্ছেন। বিশেষ করে তসলিমা নাসরিনের কটাক্ষের পর এসব হুলের ধার বেশ বেড়েছে। বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যের সম্রাট হুমায়ুন জীবন নাটকের ট্র্যাজিক নায়িকা গুলতেকিন। তাঁর বাকি জীবনটা শান্তিতে যদি কাটে তাঁকে তাতে সমর্থন দিন। গুলতেকিন ভালো থাকলে ওপারে হুমায়ুন আহমেদও ভালো থাকবেন।