ছোট ফেরাউনকে কে হত্যা করেছে?

তুতানখামেন ফারাও রাজবংশের অষ্টম রাজা। খুব অল্প বয়সে রাজা হওয়ায় তাকে ছোটদের ফেরাউনও বলা হয়। নয় বছর রাজত্ব করেছিলেন তুতেনখামেন। বড় ভাই আখেনাতেন অকালমৃত্যু হওয়ায় তখন তুতান খামেনকে রাজা করা হয়।

প্রজারা তাকে অর্ধেক মানুষ অর্ধেক দেবতা মনে করতো। কিন্তু তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক না ষড়যন্ত্রমূলক ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। ষড়যন্ত্র তত্বের লোকজনের সন্দেহ ছিল তুতেনখামেনের স্ত্রী আর দেহরক্ষী এরসঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।

কিন্তু এসব গল্প থামাতে গবেষকরা এক পর্যায়ে যুক্ত বিবৃতিও দিয়েছেন। বিবৃতি দিয়ে বলেছেন তুতেনখামান হত্যার শিকার হয়েছেন এমন প্রমান তাদের হাতে নেই। তাঁর কোন উত্তরসূরী না থাকায় ইতিহাসের একাংশ তাকে ভুলতেও বসেছিলেন।

কিন্তু একজন তরুন বৃটিশ প্রত্মতত্ত্ববিদের অনুসন্ধানে তাঁর সমাধি আবিষ্কারের পর বিশ্বজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। কারন প্রাচীনকালের কবর চোর-দস্যুরা তার কবরে লুটতরাজ চালিয়েছিল!

এরপরও বিপুল রত্মরাজি তুতেনখামেনের গোপন সমাধিতে পাওয়া গিয়েছিল। এর থেকে বিস্ময় প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। তাহলো ফারাও রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে কম সময় ক্ষমতায় ছিলেন তুতেনখামেন।

তাঁর সমাধিতেই থাকে যদি এতো রত্মরাজি থাকে! তাহলে যে সব ফারাও রাজা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন তাদের রত্মরাজির পরিমান কী রকম ছিল? তুতেনখামেনের সমাধি অনুসন্ধানের সঙ্গে জড়িতদের অনেকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।

এর কারনেও তাকে নিয়ে নানা রহস্য এখনও চলতেই আছে। ফারাও রাজাদের প্রতীকের সঙ্গে বিষাক্ত কোবরা সাপের ছবি জড়িয়ে আছে। সাপের কামড়ে, বিষাক্ত জীবানুতে, কল্পিত অভিশাপেও মৃত্যু হয়েছে তুতেনখামেনের সমাধি খোঁজার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের!

১৯২২ সালে তুতানখামেনের কবর আবিষ্কৃত হয়। প্রফেসর কার্টার নামের একজন তরুন ব্রিটিশ প্রত্মতত্ত্ববিদ তাঁর কবর আবিষ্কারে নেতৃত্ব দেন। এর আগে পর্যন্ত প্রত্মতত্ত্ববিদ গবেষকরা তাকে অনেক খুঁজছিলেন।

ছোটদের এই ফেরাউন কেন মারা গিয়েছিলেন সেটি জানার জন্যে তাঁর মমি অথবা দেহাবশেষ খোঁজা হচ্ছিল। ১৯৬৮ সালে তাঁর মমির এক্সরে করা হয়। তখন জানা যায় তাঁর হাড়গুলোতে অনেক ফাটল ছিলো।

আঘাতের চিহ্ন ছিলো মাথার পিছনের অংশে। তাঁর মৃত্যু নিয়ে এখনও নানান গবেষকের নানামত। কারও মতে ম্যালেরিয়ায় তাঁর মৃত্যূ হয়েছিল। আরেকদল মনে করেন তাঁর মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে।

আরেকদল মনে করেন ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। তাঁর মৃত্যু নিয়ে কল্পকাহিনী বন্ধ করতে ২০০২ সালে গবেষকরা সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলেন, তাকে যে হত্যা করা হয়েছে এটি প্রমান হয়নি।

মাত্র ১০ বছর বয়সে রাজা হন তুতানখামেন। যীশুর জন্মের আগে খ্রিস্টপূর্ব ১৩২৩ সাল থেকে ১৩৩১ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পর মাত্র ১৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এই ছোটদের ফেরাউনের।

প্রত্মতত্ত্ব নিয়ে দুনিয়াজুড়ে যারা গবেষনা করেন তুতেনখামেন চরিত্রটি তাদের বিশেষ মুগ্ধ করে। তাঁকে নিয়ে চালু আছে, সত্য-মিথ্যা নানান মিথ। যেমন যে ঘরে তাঁর কবর পাওয়া গিয়েছিল পাশের ঘরেই ছিল তাঁর ধন সম্পদের গুদাম!

তাঁর কবর আটকে রাখার জন্যে ব্যবহার করা হয় একটি সিলমোহর! সিলমোহরটায় লেখা ছিল তুতানখামেন! মৃত্যুর এক হাজার বছরেরও পর সন্ধান পাওয়া যায় তুতানখামেনের কবরের।

১৯২৫ সালে প্রফেসর কার্টার যখন তাঁর কফিনটি খোলেন তখন সেটির ভিতরে পাওয়ায় যায় আরও তিনটি কফিন! সেই তিনটি কফিনের দুটি এখনও কায়রো জাদুঘরে আছে।

পাঁচ হাজারের বেশি হাতের কাজ পাওয়া যায় কবরটির ভিতরে। কবরের ভিতরের দেয়ালের ছবিগুলোতে ধারনা পাওয়া যায় তুতানখামেন শিকার করতেন। স্ত্রী সেনামুনের ছবিও পাওয়া যায় সেই কবরের দেয়ালে।

রানী নেফেরতিতির মেয়ে ছিলেন এই সেনামুন। নীলনদের পশ্চিম তীরের শহর লুক্সার। এই শহরের কাছেই প্রাচীন থেবেসের সবচেয়ে পুরনো কবরস্থান। প্রাচীন ফারাওদের ২৮ জনের কবর ও মমি এখানে পাওয়া গিয়েছিল। ।

কিন্তু তখনও পাওয়া যায়নি তুতান খামেনের কবর। মিশর সরকারের অনুমতি নিয়ে দুই প্রত্মতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানী আর্ল জর্জ হাবার্ট, হাওয়ার্ড কার্টার তুতান খামেনের কবর খুঁজতে শুরু করেন।

কার্টার এর আগেও একজন মার্কিন প্রত্মতত্ত্ববিদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন। এরকারনে তিনি জানতেন অন্য ফারাও রাজাদের কবর খুঁজতে গিয়ে প্রাচীন সময়ের কিছু কুড়েঘরও পাওয়া গিয়েছিল।

হাজার বছর আগে পিরামিড আর ফারাও রাজাদের কবর তৈরির শ্রমিকরা এসব কুড়েঘরে থাকতো। অনুসন্ধান শুরুর পর এমন কিছু কুড়েঘর পেয়ে কার্টার ধারনা করেন নিশ্চয় আশেপাশে কোন রাজার কবর থাকতে পারে।

১৯২২ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হয় সেই খনন। ৩ নভেম্বর খননকারীরা হঠাৎ করে পেয়ে যান একটি সিঁড়ির ধাপ! সিঁড়ির নির্মান দেখে কার্টার ধারনা পেতে শুরু করলেন! ঠিকপথে চলছে তাঁর অনুসন্ধান!

ষোল ধাপের সিঁড়ির শেষে একটি বন্ধ দরজা! আনন্দে ও উত্তেজনায় বুক কাঁপতে থাকে ব্রিটিশ প্রফেসরের। পাওয়া গেলো দুটি সিলমোহর। ফারাও রাজাদের মমি যে সব কবরে রাখা হতো সেটির দরজা বন্ধের পর সেগুলোয় এসব সিলমোহর ব্যবহার করা হতো।

এর একটি সিল মোহর থাকতো রাজ দরবারের। ওপরটি ক্ষমতাসীন ফারাও রাজার ব্যক্তিগত সিল। কিন্তু এই কবরের দরজায় শুধু পাওয়া গেলো রাজকীয় সিল। এতে প্রফেসর কার্টার নিশ্চিত হলেন এটি কোন রাজকীয় ব্যক্তির কবর।

কিন্তু সেটি তুতেনখামেনের কিনা তখনও তা নিশ্চিত হওয়া গেলোনা। এরমধ্যে সেখানে সন্ধ্যা নেমেছে। প্রফেসর কার্টারের অভিযানে অর্থ লগ্নিকারী লর্ড কার্টার তখন লন্ডনে। কার্টার সিদ্ধান্ত নিলেন লর্ড না ফেরা পর্যন্ত তিনি দরজা খুলবেননা।

প্রবেশ পথটা তাই আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দিলেন কার্টার। ১৯২২ সালের নভেম্বর ২৩ তারিখ। লর্ড কার্নারডন, তাঁর মেয়ে লেডি ইডেলিন পৌঁছলেন লুক্সারে। তারা পৌঁছবার পর আবার খোলা হয় কবরের প্রবেশ পথ।

এবার দরজায় পাওয়া গেল তুতানখামেনের সিলমোহর! কিন্তু তখনও হতাশ হবার পালা! প্রবেশ পথটিতে ফারাও রাজাদের নাম সম্বলিত ভাঙ্গা কিছু মাটির পাত্র পাওয়া যাচ্ছিলো।

এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিলো এটি বুঝি তুতেনখামেনের সময়কার ভূ-গর্ভস্থ কোন গুদাম ঘর! কবরের দরজা খোলার পর ধারনা পাওয়া যায় হাজার বছর আগেও কোন এক কবর চোর অথবা দস্যু সেখানে ঢুকেছিল!

কিন্তু কবরের দেয়াল ফুটো করে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে বিস্ময়াভূত হয়ে পড়েন প্রফেসর কার্টার! দেয়াল ফুটো করে মোমবাতির আলোয় ভেতরটা দেখতে গিয়ে সবকিছু তাঁর কাছে সোনালী মনে হচ্ছিল!

পরে বুঝলেন আসল সত্য।ভিতরের সবকিছু সোনার তৈরি! কিছুক্ষনের জন্যে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন প্রফেসর কার্টার!

ভেতরে ঢুকতে পাওয়া গেলো ফারাও রাজাদের নানান মূল্যবান স্মারক! সোনার তৈরি সিংহাসন। বেড়ানোর সময় হাতে ব্যবহারের ছড়ি। রুমাল, তোয়ালে সহ নানান কাপড়-চোপড়।

প্রফেসর বুঝলেন চোরেরা এসেছিল ঠিক। কিন্তু অতোটা ভিতরে যায়নি বা যেতে পারেনি। বিষাক্ত সাপের দল কী তাদের তাড়া করেছিল? এমন গল্পও মিথ আকারে চালু আছে।

একটি কক্ষের শেষ প্রান্তে আরেকটি বন্ধ দরজা। দুটি বিশাল সোনার মূর্তি পাহারাদারের মতো সেই বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে! তখনই সে দরজা খুললেননা প্রফেসর কার্টার! রহস্যটা যেন জিইয়ে রাখতে চাইলেন!

১৯২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। মিশরের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে তৃতীয় দরজাটি খোলা শুরু করেন ব্রিটিশ প্রফেসর। পাথরের দরজা সরাবার পর চোখে পড়ে একটি সোনার তৈরি দেয়াল।

দরজার পুরোটা খোলার পর বোঝা গেলো দেয়ালটি একটি মন্দিরের। সেটিই ছিল তুতানখামেনের সমাধি মন্দির। কিন্তু কোন সিল ছিলোনা সেই মন্দিরের দরজায়। সেই মন্দিরের ভিতরে পাওয়া সম্পূর্ন সিল করা আরেকটি দরজা!

বন্ধ দরজার ওপাশেই শেষ শয্যায় শায়িত ছিল তুতান খামেনের শবদেহ। যথারীতি শবদেহটি মমি করা ছিল। বোঝা গেলো প্রফেসর কার্টারের দলটির আগে কেউ সেখানে কখনও প্রবেশ করেনি।

কিন্তু রহস্য প্রকাশ পেতে লেগে গেলো আরও কিছু সময়। এরমাঝে অভিযানের অর্থদাতা লর্ড কার্ণারডন রহস্যজনকভাবে মারা যান! তিনি বাড়ি গিয়ে দেখেন তার পোষা পাখি খেয়ে ফেলেছে বিষাক্ত সাপ!

সেভ করতে গিয়ে তাঁর মুখের সামান্য কেটেছিল। সেখান থেকে লিউকোমিয়ার সৃষ্টি হয়! সেখান থেকে মৃত্যু! এভাবে অভিযান সংশ্লিষ্টদের কয়েকজনের মৃত্যুর খবরে ডালপালা পায় তুতেনখামেনের অভিশাপতত্ত্ব!