কর্নেল তাহের ছিলেন আমেরিকার কমান্ডো ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম বাঙালি অফিসার। সেই কমান্ডো ট্রেনিং’এ দক্ষিন এশীয় গড়পড়তা আকারের তাহের এতোটাই ভালো করেন যে মার্কিন প্রশিক্ষকদেরও নজরে পড়েন।
তারা তাঁকে নিয়ে আলাদা ভাবতে শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে সামরিক ক্যারিয়ারে তাঁর তরতর করে বহুপথ যাবার সুযোগ ছিল। সেই তাহেরই কিনা সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে অনিশ্চিত এক যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন!
আবার একদিন সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে জড়ান রাজনীতিতে! সামরিক বাহিনীর সদস্যদের রাজনীতিতে যোগদান নিয়ে নানান মত-বক্তব্য আছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের আইয়ুব-ইয়াহিয়া যুগ, পঁচিশে মার্চের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধে বেশুমার গণহত্যার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে বাংলাদেশের মানুষের।
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, জিয়া-এরশাদ যুগ বা ১/১১’র অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের রাজনীতিতে জড়ানোকে ‘না’ বলবেন।
কিন্তু যুগে যুগে সামরিক ব্যক্তিরাইতো যুদ্ধ-রাজনীতি করেছেন। বাংলাদেশে জিয়া-এরশাদ দু’জনেই সামরিক উর্দি পড়ে রাজনীতিতে নামেন। রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তাদের সৃষ্ট দল এখনও দেশে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে টিকে আছে।
অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিষ্টার মওদুদ বা মির্জা ফখরুল-খন্দকার মোশাররফের মতো নানান সুবিধাবাদী পেশাজীবীরাতো এদের পদতলেই দেখেছেন গণতন্ত্রের ফল্গুধারা! তাদের মিছিলে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দিনও ছিলেন’।
তাই সামরিকরা প্রশ্ন তোলেন সব পেশাজীবী রাজনীতিতে নাম লেখাতে পারলে সামরিকদের দোষ কোথায়। আর এখনতো আরেক বিশেষ সময়। কেউ কেউ ক্যাথলিক মোর দ্যান পোপ! সামরিকরা অনেক রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করেন।
সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকে রাজনৈতিক নেতার মতো করেও বক্তব্য দেন! গত নির্বাচনের পর সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল আজিজ বলেছেন, এমন অবাধ নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ন নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়নি!
এই তাহের আবার ছিলেন অন্য স্বপ্ন-লক্ষ্যের মানুষ। রাজনৈতিক কারনেই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন! বাংলাদেশে তাঁর মতো এমন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবেনা। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার স্বপ্নে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তাহের।
মনে তাঁর তখন মডেল ছিল লাতিন আমেরিকার সামরিক বিপ্লবের। কারন তাহের ভাবতেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেই শুধু দেশের সামগ্রিক পরিবর্তন সম্ভব। মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ইলা মিত্র চরিত্রগুলোতো এই বঙ্গের।
আমাদের সমাজের পরিবারের গড়পড়তা অনেকে যেমন একটা চাকরির জন্যে বা বিয়ের বাজারে একজন ভালো পাত্র হবার ব্রত-উদ্দেশ্য নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তাহেরের এইম ইন লাইফতো সে রকম ছিলোনা।
এরজন্য তখনই ছুটিতে বাড়ি এলে তিনি ভাইবোনদের সামরিক প্রশিক্ষন দিতেন। ষাটের দশকেই নিজের পরিবারকে তিনি আগে বিপ্লবের ইউনিট-সংগঠন বানানোর চিন্তা করেছিলেন। তাহের ভাইবোনদের শেখাতেন অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল।
খালি হাতে যুদ্ধ, নানান যুদ্ধ সরঞ্জাম বানানোর পদ্ধতি, গেরিলা যুদ্ধের নীতি কৌশলের ওপর তাদের ক্লাস নিতেন তাহের। একজন স্টেশন মাস্টারের ছেলে ছিলেন এই পারিবারিক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষক। এই পরিবারের যুদ্ধ প্রস্তুতি তখনই শুরু হয়।
সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবারটিকে তিনি এমনভাবে তৈরি করেছিলেন যে তাঁর ভাই-বোনদের সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আরেক সময় আর জেনারেশনের সদস্যা তাহেরের রত্মগর্ভা মা আশরাফুন্নেসা মরণোত্তর চক্ষুদান করেছিলেন! ভাবা যায়!
তাঁর কর্নিয়া ধারন করে এখনও পৃথিবী দেখেন এক কৃষক! মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি উপজেলার বেতকা গ্রামের মোঃ আমজাদ হোসেনের জীবনের অন্ধকার দূর হয়েছে এই বীরমাতার চোখে। ১৯৯০ সালে এই মা মরণোত্তর চক্ষুদান করেন।
১৯৯৯ সালে মারা যান এই মা আশরাফুন্নেসা। মৃত্যুর আগে বারবার পরিবারের সদস্যদের মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন যাতে তাঁর কর্নিয়া সংগ্রহে দেরি না হয়। এই মায়ের প্রেরনাও তাঁর বীর সন্তানেরা। হাজার সন্তানের প্রেরনা এই মা।
মুক্তিযুদ্ধের আগে দেশের একাধিক বামপন্থী দলের সঙ্গে তাহেরের আলোচনা যোগাযোগ হয়েছিল। বাংলাদেশের অনেক ধান্ধাবাজের মতো সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, টেন্ডার-সম্পদ অর্জনের আশায় তাহের রাজনীতিতে যোগ দেননি।
অথচ এসব চোর-চোট্টা, তাদের দাস-দোসররাই তাহেরদের কটাক্ষ করে বলে রোমান্টিক অথবা বিভ্রান্ত বিপ্লবী! রোমান্টিক না হলে কী বিপ্লবী হওয়া যায়? তাহেরের রাজনৈতিক স্বপ্নে টেন্ডারবাজি, টাউট-বাটপারি, বিদেশে টাকা পাচারের সংযোগ নেই।
মুক্তিযুদ্ধের আগে যাদের সঙ্গে তাহেরের কথা হয় তাদের মধ্যে বদরউদ্দিন উমর, মঞ্জুরুল আহসান খান প্রমুখ যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন সিরাজ শিকদারও। তখন তাঁর এসব যোগাযোগের যোগসূত্র ছিলেন ছোট ভাই ডক্টর আনোয়ার হোসেন।
এক সময় আনোয়ার হোসেন মুগ্ধ হন সিরাজ শিকদারে। প্রকৌশলী সিরাজ শিকদার তখন আলোচিত এক বিপ্লবী নেতা। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন সিরাজ শিকদার। বাংলাদেশে এ আরেক গালি খাওয়া মানুষ!
হায়াৎ হোসেনের গল্প ‘নাফ নদীর তীরে’ পড়ুন। সিরাজ শিকদারকে জানবেন। চোখ ভিজে যাবে। বাংলাদেশের প্রথম ক্রসফায়ারের নাম সিরাজ শিকদার। অথচ তিনি পৃথিবীর কোন দেশে মাতৃভূমি লুট করা একটি টাকাও পাচার করেননি।
এখন বাংলাদেশে যে পতাকা দেখেন এটিও ১৯৬৮ সালে ঝালকাঠিতে সিরাজ শিকদারের তোলা স্বাধীন পূর্ব বাংলা’র পতাকা! এমন একটি সবুজ জমিন, মাঝখানে লাল বৃত্ত। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের সম্মেলনে পতাকা দুটি তুলে নিচে হাতবোমা বেঁধে রাখা হয়।
পুলিশ পরে পতাকাগুলো খুলে নিয়ে যায়। ঝালকাঠির মুক্তিযোদ্ধারা তথ্যটি আমাকে বলেছিলেন। এখন সব মুক্তিযোদ্ধা তথ্যটি বলবেন কিনা জানিনা। কারন এখন অনেক বুদ্ধিমানরা সুবিধামতো সম্পাদনা করে ইতিহাস বলেন!
ইতিহাসে যার যা প্রাপ্য তা তাকে দিতে চান না! একাত্তরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সবুজ জমিন মাঝখানে লাল বৃত্ত, এর মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র সহ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিল ঘরে ঘরে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দিলে সিরাজ শিকদারের ১৯৬৮ সালের পতাকা ফিরে এসেছে। যদি এর কোন স্বীকৃতি নেই। একাত্তরে ঝালকাঠির পেয়ারা বাগান সহ বিস্তীর্ন এলাকায় যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ শিকদার সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের কাছে একজন ঘৃণিত খলনায়ক!
দেশ স্বাধীন হবার আগে একবার তাহের ছুটিতে বাড়ি এলে আনোয়ার হোসেন তাঁকে সিরাজ শিকদারের কাছে নিয়ে গেলেন। দুই বিপ্লবীর মধ্যে লম্বা আলাপ হয়। বিপ্লবীদের সামরিক প্রশিক্ষনের ক্লাস নিতে শুরু করেন তাহের।
তত্ত্বীয় এবং হাতে কলমে প্রশিক্ষনের ক্লাস। কিন্তু এক পর্যায়ে সিরাজের সঙ্গে বনিবনার সমস্যা দেখা দেয়। বিপ্লবী বিপ্লবীতে এমন তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব হয়। সিরাজ বলতে লাগলেন তাহের একজন পেটিবুর্জোয়া সামরিক অফিসার। তাই তাঁর কাছ থেকে সামরিক শিক্ষা নেয়া যায়না।
আর তাহেররা ভাবলেন সিরাজ শিকদার একজন নিবেদিতপ্রাণ সাহসী বিপ্লবী হলেও তিনি সম্পূর্নরূপে একজন আত্মকেন্দ্রিক ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তি। গণতান্ত্রিকতা ও যৌথ নেতৃ্ত্বের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল নন। অতএব তিনি বাদ।
ছুটি শেষে তাহের আবার ফিরে গেলেন সেনাবাহিনীর চাকরিতে। আনোয়ার হোসেন তখন আবার ফিরে গেলেন পড়াশুনায়। ঘনিষ্ঠ হলেন ছাত্রলীগের সেই অংশের সঙ্গে যারা তখন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের কথা ভাবছিলেন।
এ অংশের নেতার নাম সিরাজুল আলম খান। কাজী আরেফ আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল কুদ্দুস মাখন সহ আরও অনেকে ছিলেন সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নধারার। শেখ ফজলুক হক মনির নেতৃত্বে তখন ছাত্রলীগের আরেক ধারা সক্রিয় ছিল।
সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বাপ্নিকদের আরেকটি তথ্য বলে রাখি। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার তখন একজন ছাত্রনেতা তখন ছিল আব্দুল হাই সাচ্চু। সিরাজুল আলম খানদের দূত হিসাবে আব্দুল হাই সাচ্চু ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে আগরতলা যাওয়া আসা করছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ত্রিপুরার নেতাদের কাছ থেকে কতটা সহায়তা পাওয়া যাবে এটা জানতে আব্দুল হাই সাচ্চুকে এভাবে তখন থেকে গোপনে আগরতলা পাঠানো হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই সাচ্চুর ইতিহাস আমাকে বলেছেন, আগরতলার সাংবাদিকরা।
উত্তাল একাত্তরের পঁচিশে মার্চের আগে ফজলুল হক হলের ছাত্রদের নিয়ে আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে গঠন করা হয় সূর্যসেন স্কোয়াড। সূর্যসেন নামটিও আনোয়ারের দেয়া। উত্তাল সেই সময়ে তাহেরের শূন্যতা অনুভব করতে পারেন আনোয়ার।
তিনি ভাবলেন তাহের এই সময়ে ঢাকায় থাকলে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্নে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ভিন্ন রকম হতো। তাঁর সঙ্গে সংযোগ হতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। কারন এমন একটি সময়ের অপেক্ষায়ইতো সেনাবাহিনীতে গিয়েছিলেন তাহের।
কিন্তু সবকিছুতো আর পরিকল্পনা মতো হয়না। এবং কোথাও কোন কিছু থেমেও থাকেনা। পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির পরদিন দু’ঘন্টার জন্যে কার্ফু শিথিল করা হয় ঢাকায়। ওই সুযোগে যে যার মতো করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান সূর্যসেন স্কোয়াডের সদস্যরা।
ঢাকা ছাড়ার আগে সবাই প্রয়োজনে দেশের জন্যে জীবন দেবার শপথ নেন। কাজলার বাড়ি হয়ে যুদ্ধে চলে যান আনোয়ার। ১৯৭১ সালের ২০ জুলাই কর্নেল তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নেন।
কিন্তু তখনই তিনি বুঝতে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের সীমাবদ্ধতা। এ যুদ্ধ নিয়ে ষাটের দশক থেকে তাহের যা ভাবছিলেন তা পেলেননা। জনযু্দ্ধের মাধ্যমে গড়ে তোলা দরকার ছিল জনগনের সেনাবাহিনী। যা হবে স্বাধীন দেশের জনগণের সেনাবাহিনীর ভিত্তি।
কিন্তু কর্নেল ওসমানীরা তা গ্রহন করলেননা। ওসমানীও ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো প্রচলিত বাহিনীর অফিসার। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করায় তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্যে ভারতে যেতেও ভয় পাচ্ছিলেন।
কারন তিনি ভাবছিলেন ভারতীয় বাহিনী তাকে চিনতে পারলে গ্রেফতার করবে। ৬৫’র যুদ্ধের শোধ নেবে। এরজন্যে তিনি ব্রাহ্মনবাড়িয়ার কসবা সীমান্তে পরবর্তী সময়ের জাসদ নেত্রী মমতাজ বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে সিদ্ধান্তহীন বসেছিলেন।
তখন তাঁকে অনেক কষ্টে আশ্বস্ত করে বলা হয় ভারতে তাঁকে গণপরিষদ সদস্য তথা এমএনএ হিসাবে পরিচয় দেয়া হবে। সেনা অফিসার হিসাবে নয়। এরপর তিনি ভারতে যেতে রাজি হন।
ওসমানী জনযুদ্ধের মুক্তিবাহিনীর কনসেপ্ট গ্রহন না করায় মুক্তিযুদ্ধের সে সময় থেকেই তাহের স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কতটা সংকটাপূর্ন হয়ে গেছে। ১১ নম্বর সেক্টরে তাহের তাঁর অনুজ আনোয়ার হোসেনকে একজন স্টাফ অফিসার নিয়োগ দেন।
আবার তাহের যুদ্ধে আহত হয় হাসপাতালে ভর্তি হলে কমান্ড থেকে আনোয়ারকে তাঁর দেখভালে সহকারী হিসাবে নিয়োগ করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পনের দিন আক্ষেপ করছিলেন তাহের। তাঁর কথা ছিল তিনি আহত না হলে পাকিস্তানিদের মুক্তিবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পনে বাধ্য করতেন।
তাঁর নিজস্ব বাহিনী, ঢাকার চারপাশ থেকে আগুয়ানবাহিনী দিয়ে ঘিরে এটি সম্ভব ছিল। সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগেরসেই ষাটের দশক থেকে এ দেশকে স্বাধীন করবার জন্য তাহেরের সঠিক চিন্তা – জনযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণের বাহিনী গড়ে তোলা, যা হবে স্বাধীন দেশের জনগণের সেনাবাহিনীর ভিত্তি – তা কর্নেল ওসমানী ও উল্লিখিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচলিত ভাবনার সেনানায়কেরা গ্রহণ করতে পারেন নি।
মুক্তিযুদ্ধের সে সময় থেকেই তাহের স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কতটা সংকটাপূর্ণ হয়ে গেছে। পর তাহের আবার দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা যোগাযোগ শুরু করেন।
এরপর কাছাকাছি রাজনৈতিক চিন্তার দল হিসাবে তিনি জাসদে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন। এক্ষেত্রে জাসদ ছিল তাঁর কাছে মন্দের ভালো। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ফুলের তোড়া দিয়ে ছবি তোলার যোগদান যেটি বোঝায় তাঁর ক্ষেত্রে তা হয়নি।
তেমন চিন্তাও তাঁর ছিলোনা। জাসদের কোন জনসভা বা কর্মসূচিতেও তিনি কখনও যোগ দেননি। ১৯৭২ সালে জাসদের জন্ম। পল্টন ময়দানে দলের সম্মেলনে একটি পদের নেতার নাম ঘোষনা করা হয়নি। সহসভাপতির পদ।
সেই সহসভাপতি যে কর্নেল তাহের তা জানতেন দলের গুটিকয়েক নেতা। তাঁর সঙ্গে মূলত যোগাযোগ রাখতেন সিরাজুল আলম খান আর হাসানুল হক ইনু। একটি পা না থাকায় যেহেতু তাঁর চলাচলে সমস্যা ছিল তাই নেতারাই পরামর্শের প্রয়োজনে তাঁর কাছে আসতেন।
নারায়নগঞ্জের স্থানীয় লোকজন বাসায় আসতেন গল্প করতেন। মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। নারায়নগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর সম্বর্ধনার নামে একাধিক সভাও করেন। সেখানে তারা তাঁকে অনেক বই উপহার দিতেন। যেমন লেনিনের বই। নানান দেশের বিপ্লবের ওপর লেখা বই।
এরমানে মুক্তিযোদ্ধা যারা তাহেরের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তাদের অনেকে গড়পড়তা চিন্তার বাইরে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। সেই বিপ্লব সফল না হওয়ায় তাহেরের কোন প্রশংসা নেই।
সেই যে সত্য, ‘যে যাহা করেন তাহারা একটি সুন্দর পরিণতি সকলের প্রশংসিত হয়। জাসদ কী ক্র্যাচের কর্নেলের ভুল পছন্দ ছিল? জাসদ কী তাঁর মতো বিপ্লবীকে ধারনে অসমর্থ্য-অক্ষম ছিল? না তিনিই ছিলেন জাসদের বোঝা? এই বিতর্ক চলতেই থাকবে।