পরিবহন মাফিয়া রাঙার কাছ থেকে শহীদ নূর হোসেনকে সার্টিফিকেট নিতে হবেনা

শহীদ নূর হোসেনকে মাদকাসক্ত হেরোইনখোর  ইয়াবাখোর দাবি করে বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে আলোচনায় আসার চেষ্টা করলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙা! ধৃষ্ট এই আচরনের মাধ্যমে নিজের জাত চেনালেন দেশের অন্যতম এই পরিবহন মাফিয়া। বাংলাদেশের রাজনৈতিক এতিম, ধান্ধাবাজ ছাড়া কোন সুস্থ রাজনীতিক ক্ষমতা দখলকারী জিয়া-এরশাদের মতো সামরিক শাসকের পিছনে রাজনীতি করতে যায়নি। রাঙাও তাদের একজন। আর তিনিতো ছিলেন রংপুরের জেলা পর্যায়ের একজন সুবিধাবাদী ডিগবাজি বিশারদ নেতা। তার নেতা এরশাদ ছিলেন স্বঘোষিত বহুগামীদের একজন। এমন ব্যক্তিদের কী সব সাপ্লাইর গুণে জাপার নেতারা পদ পেতেন তা দলটিতে ওপেন সিক্রেট। এখন মৌচাকে যখন ঢিল ছুঁড়েছেন তখন দেশের অন্যতম পরিবহন মাফিয়ার এ দিকটিও সামনে চলে আসতে পারে। তার মাপের একজন ধান্ধাবাজের কাছ থেকে শহীদ নূর হোসেনের জন্যে সার্টিফিকেট নিতে হবেনা। ধৃষ্ট উচ্চারনের জন্যে রাঙাকে জবাবদিহি করাতে হবে। এই দায়িত্ব নিতে হবে যুবলীগকে। নূর হোসেন গণতন্ত্রের বেদীতে প্রাণ দেয়া যুবলীগের শ্রেষ্ঠ শহীদ।

নভেম্বরের ১০ তারিখ দিনটি বাংলাদেশে শহীদ নূর হোসেন দিবস হিসাবে পালিত হয়। ১৯৮৭ সালের এ দিনে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে বুকে স্বৈরাচার নিপাত যাক’, পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে একটি জীবন্ত পোষ্টার হয়ে মিছিলে এসেছিলেন নূর হোসেন। সেদিন ছিল ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি। এরশাদের পতন ঘটাতে সারাদেশ থেকে তিন জোটের নেতাকর্মীরা এসে চারদিক থেকে ঢাকাকে অবরুদ্ধ করার কথা ছিল। কিন্তু ঢাকার বাইরের নেতাকর্মীরা যাতে ঢাকায় আসতে না পারে সে জন্যে সামরিক স্বৈরাচার ঢাকামুখি সব বাস-ট্রেন-লঞ্চ-ফেরী বন্ধ করে দিয়ে নিজেই অবরুদ্ধ করে দেয় রাজধানীকে। সেদিনের মিছিলের জীবন্ত পোষ্টার নূর হোসেনকে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান এই শহীদকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘রোদের অক্ষরে লেখা নাম’।

কৌতুককর বিষয় হচ্ছে নূর হোসেনের আত্মত্যাগের দিনটিকে এখন ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসাবে পালন করে পতিত স্বৈরাচারীর দল! এই ১০ নভেম্বর জাতীয় পার্টির আলোচনা সভায় গণতন্ত্রের জন্যে প্রাণ দেয়া যুবককে নিয়ে ঔদ্ধ্যত্ত্বের মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব পরিবহন মাফিয়া রাঙা। সেই আলোচনায় রাঙা দাবি করেছেন নূর হোসেনকে এরশাদের বাহিনী হত্যা করেনি! কারন পুলিশ নাকি তখন এ ধরনের গুলি ব্যবহার করতোনা! নূর হোসেনকে মাদকাসক্ত, হেরোইনোর-ইয়াবাখোর বলে ধৃষ্ট মন্তব্যও করেছে এই পরিবহন মাফিয়া! দাঁড়ান রাঙা, আমি এর জবাব দিচ্ছি। কারন আমি সেদিন রাজপথে ছিলাম। আপনি ছিলেননা। সেদিন রাজপথে আসার সাহস আপনার-আপনাদের কারো ছিলোনা। জনরোষে দিগম্বর হয়ে যেতেন। তখন আপনাদের অনেকে হয় এমন দিগম্বর হয়েছেন, অথবা পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এখন একেকজন সেজেছেন গণতন্ত্রের বড়বড় নেতা!

আমি তখন ঢাকার নবীন এক রিপোর্টার। সাপ্তাহিক বিচিন্তায় কাজ করি। ছোট একটি ইয়াসিকা ক্যামেরা হাতে আমি সেদিন মাঠের অবস্থা দেখতে বেরিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ জুড়ে চলছিল খন্ড খন্ড মিছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আট দল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাত দল আর বাম ঘরানার পাঁচ দলের নেতৃত্বে ছিল চলছিল সেই যুগপৎ আন্দোলন। সিপিবি, আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশাল তখন আট দলীয় জোটে ছিল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বিভিন্ন খন্ড মিছিলের অগ্রভাগে একজন নূর হোসেনকে দেখে আমি চমকে উঠি। কারন এর আগে কোন মিছিলে আমি এভাবে কাউকে দেখিনি। মুখে খোচা খোচা দাঁড়ি। কোকড়ানো চুল। পরনে জিন্সের প্যান্ট আর কেডস। পরনের ফুলহাতা শার্টটা কোমরে বাঁধা থাকায় সাদা রঙে বুকে-পিঠের লেখাগুলো উজ্জ্বল ভাসছিল। বুকের লেখার একটা শব্দ ভুল বানানে লেখা। ‘নিপাত’ বানানটা লেখা ছিল ‘নীপাত’।

কখনো বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কখনো জিপিও’র সামনের জিরো পয়েন্ট এলাকায় মিছিলের সামনে দৌড়ে অস্থির শ্লোগান দিচ্ছিলেন নূর হোসেন। শেখ হাসিনা সেখানে পৌঁছলে তাঁর গাড়ি ধরে শ্লোগান দিতে থাকেন আর চিৎকার করে বলতে থাকেন, আপা আজ স্বৈরাচারের বিদায় হতেই হবে। শেখ হাসিনা তাকে কাছে ডাকেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,  ‘তুমি শার্টটা পরে নাও। নইলে ওরা তোমাকে টার্গেট করে গুলি করতে পারে’। কিন্তু নূর হোসেনের সেই একই চিৎকার! না আপা আজ স্বৈরাচারের বিদায় হতেই হবে। সে এক তেজদীপ্ত উচ্চারন সৃষ্টি সুখের উল্লাসী যুবকের। যে দেখেনি সে সেই পরিবেশ-পরিস্থিতি কল্পনায় ভাবতে পারবেনা। শেখ হাসিনার গাড়ি জিপিও এলাকা ছেড়ে রওয়ানা হতেই মিছিলে লাঠি চার্জ গুলি শুরু হয়। আমরা তখন ঢুকে যাই বায়তুল মোকাররম মার্কেটের ভিতর। তখনই শুনি নূর হোসেনকে গুলি করা হয়েছে। রাতেই খবর পাই গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে হাসপাতালে নেবার পথে পুলিশ ছিনিয়ে নিয়ে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। ওই অবস্থায় পুলিশের গাড়িতেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশ তাঁকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়েছে।

পরের দিনের পত্রিকায় গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনের ছবি দেখে চোখ ভিজে আসে। আগের দিন মিছিলে তাকে কিভাবে দেখেছি আর এ কোন ছবি। এক কিশোর তাকে কোলে করে রিকশায় তোলার চেষ্টা করছিল। আমার তখন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার ইচ্ছা জাগে। ছবির এই কিশোরকে খুঁজে বের করে ইন্টারভ্যু করতে হবে। কারন এই কিশোর নূর হোসেনের শেষ সময়গুলো সম্পর্কে জানে। ছবির কিশোরকে খুঁজে বের করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির যুব নেতা নূরুল ইসলাম ছোটন ভাই। ছেলেটির বাসা গোড়ানে। ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতার ছোট ভাই ছেলেটি। নাম সুমন। গোড়ানের বাসায় সুমন আমাকে বললো সেই নূর হোসেনকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে টেনেহিঁচড়ে একটি রিকশায় তোলে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল নূর হোসেনের শরীর। রক্তে ভিজে যায় সুমনেরর শার্ট-প্যান্ট। তখনও কথা বলছিলেন নূর হোসেন। তখনও বিড়বিড় করে বলছিলেন স্বৈরাচারী এরশাদকে আজ যেতেই হবে। কি এক দীপ্ত শপথ! গুলিবিদ্ধ হবার আগে যিনি শেখ হাসিনাকেও যে কথা বলছিলেন।

 সুমন আমাকে বলে সে রিকশায় করে নূর হোসেনকে নিয়ে বেশি দূর যেতে পারেনি। পুলিশ রিকশা থামিয়ে গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে কিশোর। আমাকে সে বলে, আমি যদি তাকে হাসপাতালে নিতে পারতাম তাহলে তাকে বাঁচাতে পারতাম। এরপর পুলিশ গোপনে জুরাইন কবরস্থানে নূর হোসেনের দেহ কবরস্থ করে। অনেক দিন তার কবরের কাছে কাউকে যেতে দেয়া হয়নি। আর এখন জাতীয় পার্টির নেতারা বলেন নূর হোসেনকে তারা হত্যা করেনি! তাহলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কেনো পুলিশ সেদিন তাকে কেনো ছিনিয়ে নিয়েছিল? কেনো তার মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে নেয়নি? কেনো রাতের বেলা গোপনে তাকে কবরস্থ করেছিল জুরাইন কবরস্থানে? কেনো তার কবরের কাছে অনেক দিন কাউকে যেতে দেয়া হয়নি?

তখন নূর হোসেনের মা-বাবাকে খুঁজে আমি ইন্টারভ্যু করেছিলাম। পুরনো ঢাকার বনগ্রামের গলির ভিতর ঘিঞ্জি একটি এক কক্ষের বাসায় পরিবারটি গাদাগাদি করে থাকতো। একটা মাত্র চৌকি। কেউ থাকতো চৌকির ওপরে। কেউ নীচে। নূর হোসেনের বাবা মজিবর রহমান তখন ঢাকায় অটো চালাতেন। আমাকে তিনি বলেন অভাবের সংসারে ক্লাস এইটে ওঠার পর আর নূর হোসেনের পড়াশুনা এগোয়নি। এটা সেটা কাজ করে সংসারে সাপোর্ট দিত। এই গিঞ্জি ঘরে সে থাকতে চাইতোনা। এখানে সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে থাকতো। বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার প্রতি অন্তঃপ্রাণ নূর হোসেন যুবলীগের সঙ্গে সক্রিয় জড়িত ছিল। শেখ হাসিনা পরে এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ান। নূর হোসেনের ভাই আলী হোসেনকে তাঁর গাড়ি চালকের চাকরি দেন। মিরপুরে একটি প্লট দিয়ে বাড়ি তৈরি করে পরিবারটিকে তিনি বনগ্রামের গিঞ্জি ঘর থেকে তুলে এনেছিলেন।

এরশাদের পতনের পর আমরা সেই শিল্পী ইকরামকে খুঁজে বের করেছিলাম। যিনি নূর হোসেনের পিঠে বুকে লিখে দিয়েছিলেন সেই অমর কবিতাখানি। ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার  নিপাত যাক’। আমাদের সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মের জন্যে সেই ইন্টারভ্যুটি করেন পল্লব মোহাইমেন। পল্লব এখন প্রথম আলোয় কাজ করেন। জামালপুর থেকে পড়াশুনা আর সাংবাদিকতা করতে ঢাকায় আসা পল্লবের সেটি ছিল প্রথম রিপোর্ট। সেই শিল্পী মূলত সাইনবোর্ড লিখেন। নূর হোসেন যখন কথাগুলো তাঁর বুকে পিঠে লিখে দিতে বলেন তখন তিনি প্রথমে রাজি হননি। কারন কোন মানুষের বুকে পিঠে এর আগে তিনি কখনো লিখেননি। ছোট ব্যবসা তাঁর। এরশাদ নিয়ে তাঁর ভয়ও মনে কাজ করেছে। কিন্তু নূর হোসেনের চাপাচাপিতে তিনি পরে রাজি হন। নূর হোসেনের বুকে ভুল বানাতে ‘নীপাত’ লিখেছিলেন কেনো? ইকরাম বলেন নূর হোসেন তাঁর দোকানের লাগোয়া দেয়ালে চক দিয়ে যেভাবে লিখেছিলেন, তিনি সেভাবেই হুবহু বুকে পিঠে লিখে দিয়েছিলেন। বানানটা ভুল লিখেছিলেন নূর হোসেনই। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করা নূর হোসেন ভুল বানানে তাঁর মনের কথাগুলো লিখতেই পারেন। কিন্তু তাঁর শপথেতো কোন কপটতা ছিলোনা। কে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি জীবন্ত পোষ্টার হয়ে গণতন্ত্রের জন্যে মিছিলে এসে মরতে পারে?

আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক পাপ ধারন করে জাতীয় পার্টি দলটি এখনও টিকে আছে বলে এর মহাসচিব নামধারী পরিবহন মাফিয়া রাঙা আজ শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে ঔদ্ধ্যত্ত্বের মন্তব্য করার সাহস পায়। স্বৈরাচারের দল জাতীয় পার্টি এখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র। এই অপরাধটি শুরু হয় বিএনপির হাতে। এরশাদের পতনের পর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আর সংগ্রামী ছাত্রজোটের সিদ্ধান্ত ছিল স্বৈরাচারের কোন দোসরকে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় দেবেনা। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে বিএনপি এম কে আনোয়ার, কেরামত আলীকে দলে জায়গা দেয়। এমপি করে মন্ত্রীও করে। জাতীয় পার্টি জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি প্রথম চারদলীয় জোট গঠন করে। অস্থির এরশাদ সেখান থেকে বেরিয়ে গেলে নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে দিয়ে গঠন করানো হয় পৃথক জাতীয় পার্টি। মৃত নাজিউর পুত্র আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বে এই খন্ডটি এখনও বিএনপির সঙ্গে আছে। আর জাতীয় পার্টির মূলধারাটি আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। নূর হোসেনকে নিয়ে রাঙার বদমায়েশি উক্তির জন্যে তাকে জবাবদিহি না করালে জনগন আওয়ামী লীগকে ছেড়ে কথা বলবেনা।