মুসলমানদের পূণ্যভূমি, আল্লাহর ঘরের দেশ সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশি নারীর লাশও আসে। এ নিয়ে বাংলাদেশের নানা মিডিয়ার খবর পড়ি, নিউজ দেখি। আমি এসব রিপোর্টের ভিন্ন একটি দিক নিয়ে আলাপ করবো। অস্ট্রেলিয়ায় সৌদি আরবের অনেক ছাত্রছাত্রী পড়েন। তাদের অনেকের সঙ্গেও আমার এ নিয়ে আলাপ হয়। আমার ক্লাসের সৌদি সহপাঠীরা আমার বাংলাদেশি পরিচয় জেনে এক-দু’দিন পরই বলার চেষ্টা করতো বাংলাদেশি শ্রমিকরা তাদের দেশে নানান সমস্যার সৃষ্টি করছে। এরা কোন আইন মানেনা বা মানতে চায় না। আমি তাদেরকে বলতাম তুমি যে অস্ট্রেলিয়া এসেছো আইএলটিএস দিয়ে উচ্চ স্কোর নিয়ে এসেছো। বা এখানে আসার পর বিপুল ব্যয়ে ইংরেজি শিখছো। কিন্তু সৌদি আরবে যারা শ্রমিক হিসাবে যায় তাদেরতো আইএলটিএস দিয়ে যেতে হয়না। আর তারা তোমার দেশে গিয়ে যে সব কাজ করে সে সব কাজ তোমরাতো করোনা। যে মজুরি তাদের দাও এই মজুরিতে তোমরা কেউ কাজ করবেনা। কাজেই তার ক্লাসের সঙ্গে তুমি কিভাবে নিজেকে মেলাও। এই যুক্তি তারা মানতো। একদিন একটি সৌদি মেয়ে বললো তাদের বাড়িতে একজন বাংলাদেশি গৃহকর্মী আছেন। যে তাকে সন্তানের মতো ভালোবাসতো। তার বাবা-মা’ও তাঁর কাজ-রান্না খুব প্রশংসা করেন। বিশেষ করে তার বানানো পিয়াজো খুবই উপাদেয় হয়। সে যেদিন পিয়াজো বানায় সেদিন তারা আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দেন। তারাও তার রান্নাকরা খাবার খুব পছন্দ ক
সৌদি আরবে বাংলাদেশের প্রায় আড়াই লক্ষ গৃহকর্মী আছেন। যে খারাপ খবরগুলো আসে এর বাইরেও ভালো অনেক খবর আছে। অনেকে বলতে পারেন যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলোই বা ঘটবে কেনো। কারন সৌদি আরব দেশটার নাম বলতে বাংলাদেশের সিংহভাগ লোকজনের মনে একটি পূণ্য পূণ্য ভাব আসে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবেনা আদতে সৌদি আরব তা নয়। মুসলমানদের পবিত্র ভূমির অনেক অন্ধকার দিকও আছে। সে দেশের যুবরাজ আরেক দেশের দূতাবাসে একজন প্রতিথযশা সাংবাদিক খুনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শুধু খুন নয় তার লাশও গায়েব করা হয়েছে! আর সেদেশের কাছে চাওয়া হয় সুবিচার! দেশে আপনি আপনার গরিব প্রতিবেশীর সঙ্গে কি আচরন করেন? বাংলাদেশতো সৌদি আরবের কাছে গরিব মিসকিনদের দেশ। আপনি জেনেশুনেইতো সে দেশে যাচ্ছেন। যে দেশ স্বেচ্ছাচারিতায় দুনিয়াকে পাত্তা দেয় কম, আমেরিকাও তাদের ঘাটায়না, আর তারা বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আমল পাত্তা দেবে এটি নিয়ে অত সহজ হিসাব করা ভুল হবে।
বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের সিংহভাগ সৌদি আরবে থাকেন। প্রবাসী পেশাজীবীদের বড় অংশও থাকেন মরুর দেশটায়। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের বড় অংশ সেখান থেকে আসে। এখন আবার সৌদি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক নেবার নতুন শর্ত দিচ্ছে। একজন নারী শ্রমিক দিলে সে একজন পুরুষ শ্রমিক নেবে। এর কারন সৌদি নারীদের এখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ বাড়ছে। এরজন্যে ঘর সামলানোর জন্যে তাদের আরও বেশি গৃহকর্মী লাগবে। বাংলাদেশের গৃহকর্মী তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ন কারন এরা ধর্মে মুসলিম এবং এদের কম মজুরিতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সহ বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের বড় একটি অংশের কমন পছন্দ ঘরেবাইরে দুই নাম্বারি যাই করুক খাবার টেবিলে হালাল মাংস খোঁজে। তাও আবার মুসলমান গৃহকর্মীর রান্না করা খাবার। সুবিধামতো এরা বিসমিল্লাহ বলে ধর্ষন অথবা বলাৎকারও করে। কারো দূর্ভাগ্য হলে এই অভিজ্ঞতা নিতে সৌদি আরব যাওয়া লাগেনা। দেশেও অহরহ হয়।
কাজেই শ্রমবাজারটি ধরে রাখতে চাইলে তাদের মতো করে ভাবতে হবে। আপনি যখন বাসায় কাজের লোক নেন আপনার মতো করে নেন। আপনার মনমতো না হলে বের করে দেন। আবার বাংলাদেশে বসে ঢালাও ভাববেননা গৃহকর্মী মানেই সৌদি মুসলমানদের কাছে যৌনকর্মী। ধনাঢ্য সৌদিদের এমন বদঅভ্যাস যাদের আছে তারা এরজন্য প্রায় ড্রাইভ করে বাহরাইন চলে যায়। অনেকে চলে যায় লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। এরজন্যে রাশিয়া সহ নানা দেশের সুন্দরী যৌনকর্মীরা ফ্লাইট চার্টার্ড করে আসে। খুব নিম্নরূচির যারা গৃহকর্মীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে বা নানা দূর্ব্যবহার করে এদের সঙ্গে সবাইকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবেনা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রমিক-গৃহকর্মীদের জীবন নিয়ে কাজ করার আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। এর বড় অনেক সমস্যা বাংলাদেশের ভিতরেই। কারন বাংলাদেশের শ্রমবাজারটি অগোছালো দূর্নীতিগ্রস্ত। মধ্যপ্রাচ্যে যে টাকায় বাংলাদেশের লোকজন যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা সেখানে আয় করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের লোকজন বিদেশে যাওয়া নিয়ে অনেক প্রস্তুতি নেয় কিন্তু কাজের প্রস্তুতি সে তুলনায় খুবই কম। সবচেয়ে কম ভাষা প্রস্তুতি। আরবি ভালো না জানলে সেখানে ভালো কাজ পাওয়া কঠিন। যেমন শুধু ইয়েস নো ভেরিগুড বলতে পারলেই অস্ট্রেলিয়ায় ভালো কাজ পাবেননা। সবার কাজের লোক লাগে। স্মার্ট। ভাষায় স্কিলড লোকজনের কাজের অভাব হয়না।
বিদেশের যে কোন জায়গায় কেউ একজন আপনাকে চাকরি দিতে পারবে, কিন্তু চাকরিটি করতে হবে আপনাকে, চাকরি বা কাজটি ধরে রাখতে হবে আপনাকে। বাংলাদেশের শ্রমিক অথবা গৃহকর্মীরা শুরুতেই যে ধাক্কা খান তাহলো তারা ভালো আরবি বলতে পারেননা। একজন আরবিভাষীর কথার এক্সেন্ট তাদের বেশিরভাগই বোঝেননা। কাজেই শুরু থেকেই একটা বললে এদের বেশিরভাগ কাজ করেন আরেকটা। এতে করে শুরুতেই তার প্রতি গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর ভুল একটা ইম্প্রেশন সৃষ্টি হয়। বুদ্ধিমতিরা এ অবস্থা কিছুদিনের মধ্যে কাটিয়ে উঠতে পারেন। যারা পারেননা তাদের নিয়েই নানা ভোগান্তির গল্প সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বসে আপনারা যে গল্পটি পান এর বেশিরভাগ অর্ধেক সত্য। আপনি রিপোর্ট করছেন কিন্তু কাউন্টার চেক করছেননা। অথবা সে একসেসও আপনার নেই। কারন আপনিওতো আরবি জানেননা। মিশরে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইন্টারভ্যু করতে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্রদের সহায়তা যদি না পেতাম আমি কাজই করতে পারতামনা। কারন তারা আরবি ছাড়া কিছু জানেনা। কুড়িটা দেশের ভাষা আরবি। অন্যকিছু না জানলেও তাদের চলে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের একেকটি দেশে রিপোর্ট করতে গিয়ে বিপদে পড়ে শপথ নিতাম এবার দেশে ফিরে গিয়ে অর্থ সহ আরবি শিখবো। কিন্তু দেশে এসে নানা ব্যস্ততায় ভুলে যেতাম সে শপথ। এটিইতো আমাদের জীবন।
বিদেশের কাজের বাজারের আরেক সত্য অনেকে জানেননা তাহলো কাজে থাকা অবস্থায় ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু মরিয়মের মাকে কখন কোন সময় ফোন করা উচিত তা মরিয়ম বা মরিয়মের বাপও জানেননা। দেশের মিডিয়ায় রিপোর্ট হয় ফোনে কথা বলতেও দেয়না। কিন্তু এই সমস্যার সূত্রপাত কোথা থেকে তা খতিয়ে দেখা হয়না। আপনার বাসার কাজের লোকটিকে কাজের সময় ফোন নিয়ে ব্যস্ত দেখলে আপনি কী প্রতিক্রিয়া দেখান? আরেক কথা শ্রম ঘন্টার মেয়াদ মানা হয়না। বাংলাদেশের বাসাবাড়িতে যে সব কাজের লোক থাকে তাদের কী কোন শ্রমঘন্টা আছে? বাংলাদেশের কৃষক, সাংবাদিক, আবাসিক গৃহকর্মী এদের কারোই শ্রমঘন্টা, সাপ্তাহিক ছুটির বালাই নেই। ২০০৬ সালে লেবাননে দেখেছি বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা দিনে আটঘন্টা করে সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ করেন। ছুটির দিনে কাজ করলে আলাদা মজুরি। অথবা ছুটির দিনে তারা অন্যত্র কাজ করেন। ২০০৬ সালে দেখা লেবাননে কাউকে মাসে তিনশ ডলারের নিচে বেতন দেয়া যেতোনা। ভূমধ্য সাগরপাড়ের দেশটি অবশ্য কট্টর আর দেশ না।
সেখানকার গৃহকর্মীরা নিজেরা আলাদা বাড়িভাড়া করে থাকেন। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে যদি আপনি ফ্রি থাকা-খাওয়ার সুযোগ খোঁজেন এরসঙ্গে আলাদা সব উটকো সমস্যা চলতেই পারে। সৌদি আরবে গৃহকর্তা পাসপোর্ট আটকে রাখে এমন একটি খবর বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রায় দেখি। কেনো রাখে সে সম্পর্কে অনেকের ধারনা কম। গৃহকর্মীরা যেহেতু বাসায় থাকেন সে কারনে অনেকে চুরির ভয় করেন। চুরি করে পালিয়ে যাবার ভয় করেন। গরিব লোকজন সম্পর্কে ধনী লোকজনের এটি সহজাত অথবা কমন ধারনা। আবার যে গৃহকর্মী বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন তার প্রতি আচরনও ভিন্ন হয়। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার সম্পর্কে একটা কথা আমি প্রায় লিখি, তাহলো বাংলাদেশ যদি নিজেদের মাদ্রাসায় পড়া ছেলেমেয়েদের সেখানকার কাজের বাজারে পাঠাতো তারা অনেক ভালো করতো। কারন তারা আরবি জানে। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ এ নিয়ে এখনও প্রস্তুত নয়। কবে প্রস্তুত হবে তাও কেউ জানেনা। সবাই শুধু পড়ছেন! কিন্তু কী পড়ছেন কাজের বাজার আছে কিনা কেউ জানেনা। মাদ্রাসায় পড়লেতো অনেকের ভাব থাকে আল্লায় দেবে। কিন্তু সব মুসলিম দেশের মুসল্লিরাতো কাজ করেই খান।
মিশরের কায়রোর সাইয়্যেদেনা এলাকায় হযরত মোহাম্মদের (দঃ) বংশধররা থাকেন। এদের প্রায় সবার পছন্দের পেশা শিক্ষকতা। এরা রাজনীতিতে জড়াননা। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে যান। ব্যস এটুকুই। কিন্তু সবাই কাজ করে খান। কিন্তু বাংলাদেশের হুজুরদের অনেকে দেশে বসে লিল্লাহ-সদকা-জাকাত খাবেন কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে কামলা খাটতে যাবেননা। হযরত মোহাম্মদের (দঃ) বংশ লতিকার কিছু একটা বের করতে পারলেতো বাড়িতে মাজারই খুলে বসতেন। বাংলাদেশের অনেকে ভাবেন মাদ্রাসায় পড়া মেয়ে কেনো মধ্যপ্রাচ্যের বাসাবাড়িতে কাজ করতে যাবে। অথচ দেশে তাদের কাজের বাজার খুবই সীমিত। তাদের পরিবারের অনেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব কাজই করেন। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শ্রেনী বৈষম্য শেখায়। শ্রমের মর্যাদা শেখায় না।
মধ্যপ্রাচ্য তথা বাংলাদেশের সৌদি শ্রমবাজার সম্পর্কে আগামীতে আরও খারাপ খবর আসতে পারে। কারন সিরিয়া থেকে সম্প্রতি তারা একলক্ষ জনশক্তি নিয়েছে। ভাষা সংস্কৃতির কারনে সিরিয়ান আরবরা তাদের কাছে বেশি গ্রহনযোগ্য। বাংলাদেশের লোকজন যে নানা অভিযোগে ফেরত পাঠানো হচ্ছে এর অন্যতম কারন সৌদিরা এখন আরব জনশক্তির দিকে ঝুঁকছে। অদক্ষ জনশক্তির বাজার শুধুই সংকুচিত হচ্ছে। ভাষাগত স্কিল না বাড়ালে এই সংকট শুধুই জটিল হবে। অস্ট্রেলিয়ার বাসাবাড়িতে কেউ কাজের লোক রাখেনা। কারন ঘন্টায় সতের-আঠার ডলার দিয়ে গৃহকর্মী বা গাড়িচালক রাখার সামর্থ্য এদেশের লোকজনের নেই। গৃহকর্মীর ধারনাটিই এখন পর্যন্ত মানুষ ঠকানোর বর্বর দেশগুলোয় চালু আছে। কাজেই আপনি তাদের দেশে গেলে জেনেশুনে যাবেন। আপনাকে কেউ দাওয়াত দিয়ে হাতেপায়ে ধরে নিচ্ছেনা। বিদেশ না গিয়ে দেশে সবজি চাষ এখন অনেক লাভজনক। সৌদি আরব বর্বর দেশ বলেইতো সেখানে ধর্ম এসেছে। যে দেশে মানবাধিকারের বালাই নেই সে দেশে মানবাধিকার খুঁজতে যাওয়াটাই হাস্যকর।