সিলেটি ভাষায় একটা টার্ম আছে ‘উছলি গেছে’ বা ‘উছলি যাওয়া’! আইন-কানুন বা কোন পরামর্শ অবজ্ঞা করে অন্যের এবং নিজের জন্যে ক্ষতিকর অপরিনামদর্শী প্রবনতা উল্লেখ করতে দেখলে বয়স্করা অনুজদের উদ্দেশে টার্মটি ব্যবহার করে বলেন, ‘তুমি উছলি গেছোনিরেবা’!
করোনা মহামারীর এই সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র-সরকার-চিকিৎসক ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারীদের নির্দেশ-পরামর্শ উপেক্ষা করছে দেশের বড় অংশ! এই সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর অপরিনামদর্শী ভূমিকার উল্লেখ করতে গিয়ে সিলেটি ভাষার এই টার্মটিও ব্যবহার করা যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে এই বিপদের সময়ও মানুষ এমন আত্মঘাতী বেপরোয়া ভূমিকা কেনো নিয়েছে বা দেখাচ্ছে? মহামারীর মৃত্যুর হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে এখন কী করে মানুষ এভাবে ভিড় করে বিপদজ্জনক কায়দায় ঈদ শপিং’এ যেতে পারলো?
মহামারীর সংক্রমনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে এখন এরা ঈদে বাড়ি যাওয়া নিয়ে বেপরোয়া হয়ে গেলো কেনো? যখন মহামারী বাংলাদেশে চূড়ার দিকে হাঁটছে প্রতিদিন! সংক্রমন বাড়ছে। মৃত্যু বাড়ছে।
এমন বিপদজ্জনক সময়ে এই অপরিামদর্শীরা এমন ভিড়ের ভিতর করে বাড়ি যেতে গিয়ে তারা নিজেরা সংক্রমিত হবার ঝুঁকিকে কবুল করেছেন! একই সঙ্গে গ্রামে বাবা-মা-পরিজনের সদস্যদের জন্যে তারা ঈদ আনন্দও নিয়ে গেলেননা!
এবার তারা মহামারীর বাহক হিসাবে বাড়ি গেছেন! এরমাঝে তাদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হতভাগ্য পরিবারগুলোর ঈদ সংখ্যা সংক্রমনের খবর আসা শুরু করেছে। সংক্রমন নিয়ে এরা এলাকার পর্যটন কেন্দ্রগুলোয়ও ঘুরতে গিয়েছিলেন!
অতঃপর বাড়ি থেকে ফেরার পথে এরা সংক্রমনের বাকি কাজটা করবেন! কেনো আমাদের বাংলাদেশটা এমন হয়ে গেলো? এ নিয়ে দেশের মানুষের কাছে কারনের চেয়ে অজুহাত বেশি শুনি! সরকার এই করেছে সরকার সেই করেছে!
তা জনাব আপনি কী করেছেন বা করছেন? মানুষ হিসাবে দেশের একজন সুনাগরিক হিসাবে আপনার কী নিজস্ব কোন প্রভাব বা ভূমিকাই কী নেবার নেই? আসলে আপনার প্রভাব-ক্ষমতা সম্পর্কেও আপনি জানেননা। অথবা উদাসীন!
এই যে এখন যারা প্রতিদিন এই মহামারী ছড়িয়ে দিচ্ছে, এদের মধ্যেতো আপনারও পরিবারের সদস্য এবং নিকটজনরাও আছেন। এদের মাধ্যমে মহামারীর সংক্রমনের কারনে আপনি কী নিরাপদ থাকবেন?
নতুন হটস্পট চট্টগ্রাম থেকে শুধু খবর আসছে অমুক আক্রান্ত, অমুক আক্রান্ত! অনেকের কোন উপসর্গও ছিলোনা! এ অবস্থাতেও বাংলাদেশ এমন আচরন কেন করছে এ নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষন আছে।
আমার পর্যবেক্ষনগুলো আমি আমার লেখায় লিখি। দেশকে আমরা সবাই ভালোবাসি। এ ক্ষেত্রে আমার একটি পর্যবেক্ষন হলো দেশের একটা লোক যখন বিদেশে যায় সে দেশটাকে আরও বেশি ফিল করে। ভালোবাসে। প্রায় কাঁদে।
যা হয়তো দেশে বসে এভাবে সবার পক্ষে ফিল করা হয়ে ওঠেনা। সিডনিতে আমি নতুন আসা বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের অনেকের প্রথম দিনগুলোর সঙ্গে প্রায় জড়িত হয়ে যাই। এটা জড়াই কারো অনুরোধে, কখনোবা গায়ে পড়ে। জড়াতে ভালোও লাগে।
নিজেকে তাদের বয়সী তরুন তরুন লাগে। তাদের প্রথম সংগ্রামের দিনগুলোতে ভাই-বন্ধু বা অভিভাবক হিসাবে তাদের সঙ্গে জড়িয়ে যাবার অনুভব ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা।
আর এই জড়ানোর কারনে কখনো কখনো অনেক বাজে অভিজ্ঞতাও হয়। এসব মাথায় নিলে বা গায়ে মাখলে এই কাজটি করা সম্ভব নয়। আমি বাংলাদেশ থেকে বাইরে এসেছি ২০০৭ সালে।
মাঝে শুধু ২০১৬ সালে একবার দিন কয়েকের জন্যে দেশে গিয়ে জন্মভূমির নজরকাড়া পরিবর্তনগুলোও দেখেছি। এরমাঝে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোই বেশি। মোটা দাগের একটি নেতিবাচক পরিবর্তন দেখেছি।
তাহলো আমার ২০০৭ সালে রেখে আসা দেশটা এখন অনেক বেশি বেআইনি মনোভাবাপন্ন হয়ে গেছে! এখন যত নতুন ছাত্রছাত্রী পড়াশুনার জন্যে অস্ট্রেলিয়ায় আসছে তাদের অনেককে হ্যান্ডেল করতে এই সমস্যাটিই খুব টের পাই।
এদের অনেকে একটি বেআইনি মনোভাবাপন্ন দেশ থেকে একটি আইনানুগ দেশে নেমে পদে পদে প্রথমেই হোঁচট খায়! কারন এখানে কথায় কথায় ফাইন-জরিমানা হয়! এই রাষ্ট্র যেন সারাক্ষন একটি বেত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়!
এর নাম ফাইন! নতুন এই ছেলেমেয়েদের আইনানুগ এই দেশে আইনানুগ করার কাউন্সিলিং করতে করতেই প্রথম দিনগুলো যায়! এটা করা যাবেনা ওটা করা যাবেনা এমন বললে জবাবে এদের প্রায়জন বলতে চায়, ‘কিছু হবেনা ভাই’!
অনেক সময় এরা এদেশে থাকা কোন বেআইনি চিন্তার লোকজনের পাল্লায় পড়লেতো আরও বিপদ হয়! অমুক বলেছে অমুক বলেছে ভাই, কিছু হবেনা। এদের অনেকে এক পর্যায়ে বেশ কয়েক হাজার ডলার ফাইন গুনে অতঃপর শান্ত হয়!
দেশের ভিতরে এমন বেআইনি মনোভাবাপন্ন লোকজন এখন বিস্তর। কারন তাদের সামনে আইনানুগ মডেল কম। অথবা নেই। বাংলাদেশের প্রভাবশালীদের সিংহভাগ আইন মানেনা। অথবা আইন না মানাকে বীরত্ব হিসাবে দেখে!
এখন এই মহামারীর বিপদের সময়ে বাংলাদেশের যারা নানাকিছুতে আইন মানছেনা তাদের সিংহভাগ কিন্তু সেই প্রভাবশালীদের অনুসারী ‘সহমত ভাই গ্রুপ’! কথায় কথায় বলতে অভ্যস্ত ‘আপনিই সেরা’!
এখন তারা আর কারও কথাই শুনছেনা। এই মহামারীর সময়ে নানান অনিশ্চয়তায় একটা দেশের লোকজন নানান মানসিক রোগেও জর্জরিত হয়। এরজন্যে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো এটিও বুঝতে পারছে।
তাই দেশগুলো এখন নাগরিকদের মানসিক চিকিৎসা দেবারও উদ্যোগ নিয়েছে। এরজন্যে ঘোষনা করেছে নানান প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছে। ভিডিও কল সহ নানান ভার্চুয়াল মিডিয়ায় সরকারি খরচে মানসিক চিকিৎসা নেয়া যায়।
বাংলাদেশের সে অবস্থা অথবা সামর্থ্য নেই। যেখানে একটা সরকার দশ টাকা কেজির চাল, আড়াই হাজার টাকাই নিরাপদে টার্গেট গ্রুপের কাছে পৌঁছাতে পারছেনা! সেখানে সরকার নাগরিকদের মানসিক চিকিৎসা সেবা কী করে দেবে।
অথচ বাংলাদেশের এখন একজন আন্তরিক অক্লান্ত কাজ করতে পারেন এমন একজন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আছেন। চমৎকার একটি প্রশাসন-পুলিশ-সেনা সদস্যরাও তাঁর পক্ষে কাজ করছেন।
দেশের চিকিৎসা সামর্থ্য-প্রধান সব মিডিয়াও সরকারের পক্ষে। কিন্তু কোন কিছুই যেন কাজে দিচ্ছেনা। আইজিপি সহ নানা কর্তৃপক্ষ গরম কথাবার্তা বললেও ‘উছলি যাওয়া’ মানুষজন তাতে আমল-পাত্তা দিচ্ছেন কম।
সরকারের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধীদল বিএনপির সর্বক্ষনিক অভিযোগ, সরকার এই পারেনা সেই পারেনা! তাদের কথাগুলো শুনে দেশের মানুষ হাসে। কারন তারা কী পারেন তাওতো দেশের মানুষ জানে।
তাদের নেতাকর্মীরা যদি তাদের কথা শুনতো তাহলে তাদের দলের অবস্থা এমন ছেঁড়াবেড়া হয়? সরকারের দয়ায় তারা তাদের দলের দন্ডিত নেত্রীর শর্ত-সাপেক্ষ মুক্তি কবুল করেছে!
সরকার যেহেতু তাদের ভাষায় ‘পারেনা’ তাহলেতো এই সুযোগে তাদেরতো মাঠ দখলের মোক্ষম সুযোগ ছিল। মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষের মনের নিয়ন্ত্রন তাদের হাতে চলে যাবার কথা!
অথচ দেশের মানুষ দেখছেন সরকারি ত্রানের পর বেসরকারি সংস্থা হিসাবে দ্বিতীয় অবস্থান বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের। বিএনপির নয়। বিএনপি হিসাব দিয়েছে তারা ৩৩ লাখ লোককে ত্রান দিয়েছে! দেশে মানুষ কিন্তু প্রায় ১৮ কোটি!
তাহলে কী বিএনপির টার্গেট গ্রুপ এখন ৩৩ লাখ! যাক, আসল কথায় আসি। অমুকে এই করেনা, এই পারেনা বলে এখন কারও বাঁচার সুযোগ নেই। এভাবে মহামারীর থাবা থেকে কেউ বাঁচবেননা।
যে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এখন মারা যাচ্ছে এটা কিসের সংকেত বোঝেননা? যদি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্লাইট চালু থাকতো তারা এখানে বেঘোরে মরতেন? সাধারন সর্দি-কাশিতে এতোদিন তারা চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক ছুটতেন!
এরজন্যে ক্ষমতায় থাকতে এদের কেউ দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে কাজ করেননি। একেকজন সারাক্ষন বক্তৃতা দিয়েছেন আর মনের মধ্যে রেখেছেন দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে গরিবের বাচ্চারা!
খালেদা জিয়া-মির্জা ফখরুল এরাও কোনদিন দেশে চিকিৎসা করাতেননা। দেশে চিকিৎসা করাতে হবে এই অরুচিতে খালেদা জিয়া এখনও বাড়িতেই থাকছেন। মির্জা ফখরুল চিকিৎসা করান সিঙ্গাপুরে।
এখন দেশের সীমিত সামর্থ্যে স্বাস্থ্যখাতে প্রথম দিকের বিশৃংখলা অনেকটা সামলে নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু চাইলেই এখন হাজার হাজার আইসিইউ, ভেন্টিলেটর পাওয়া সম্ভব নয়। মানুষ কী করে কে কিভাবে নিয়ন্ত্রন করবেন সে পথ বের করুন।
ইউরোপ-আমেরিকার স্টাইলে বাংলাদেশ এ বিপদ সামাল দিতে পারবেনা। গার্মেন্টস চালু রেখেই মানুষের জীবিকার পথ খোলা রেখেই বাংলাদেশকে এ বিপদ সামাল দিতে হবে। মানুষ তার দরকারে ঘর থেকে বেরুবে।
ওই সময়গুলোয় চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি বহাল রেখে। যার দরকার নেই তারা বেরুবেননা। শুধু আপনি অত অত পরিবারকে খাবার দিয়েছেন এটা জাহির করলে হবেনা। এসব জাহির করতে আপনি পছন্দ করেন ভালো কথা।
আশেপাশের যার ওপর যার প্রভাব আছে তাকে সামলানোর কাজ করুন। এতেই কিন্তু করোনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের এই যুদ্ধটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। এখন সবাইকে প্রতিটা পদক্ষেপে হতে হবে আরও বাস্তববাদী।
এতোদিনের বেহিসেবিপনায় দেশের যে বিপদ ঘটিয়ে ফেলা হয়েছে তা নিয়ে হা-হুতাশ করে লাভ নেই। এই পরিস্থিতিটা সামাল দিতে হবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। আমাদের অনেক ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন জানপ্রান দিয়ে কাজ করছেন।
এই করোনায় আমাদের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের বদলে যাওয়া পুলিশ-মানবিক বাহিনী। এই আইজিপিও অনেক ডিপেন্ডেবল। বিশ্বাস করুন এসব নানা কারনে বাংলাদেশ অনেক ভালোভাবে সামাল দেবো।
প্লিজ কেউ কোন হতাশা ছড়াবেননা। আমাদের দেশের মানুষকে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে আপনারাই আমাদের সম্পদ-লক্ষী জনগোষ্ঠী। আমরা সবাই মিলে সবাইকে বোঝাতে পারলে কেউ আমাদের হারাতে পারবেনা।
প্রিয় প্রজন্ম, কথা শোনো। আগামী দিনগুলোতে তোমরাই থাকবে দেশের নেতৃত্ব-কর্তৃ্ত্বে। হাত বাড়াও। ভালোবাসা দিয়ে বিপদাপন্ন মানুষকে সামাল দিতে হবে। এই করোনার সময়ে তাদেরও মন ভালো নেই।
যাদের মন ভালো নেই তাদের নিয়ে রাগ করতে নেই প্রিয় প্রজন্ম। ভালোবেসে দেখো। তাদেরকে সঙ্গে নেয়া যাবেই। কাউকে বাদ দিয়ে বা বাদ রেখে কেউ মহামারী জয় করতে পারেনা। আমরা সবাইকে এ লড়াইয়ে জিতবো ইনশাল্লাহ।