মহানবীর (দঃ) বংশধররা থাকেন কায়রোয়

আরবদের মাঝে কায়রোর নাম কাহেরা। যেমন মিশরীয়দের নাম মাশরি। আমার কাছ থেকে দেখা প্রথম এই আরব জাতিটি নিয়ে নানা রকম আগ্রহ কাজ করে মনের ভেতর। যেমন কায়রোর যে এলাকায় থাকি সকালে পত্রিকার জন্যে বেরিয়ে প্রথম যে হকার মহিলার সঙ্গে দেখা হয় তার সারা গলা, নাক-কান সবকিছু সোনার গহনায় মোড়ানো দেখি।

ফুটপাথের একজন পত্রিকা বিক্রেতা নিশ্চয় সাধারন একজন অস্বচ্ছল গরিব নারী। তাকে এমন গহনায় মোড়ানো দেখে আমার অবাকই লাগে। বাংলাদেশে এমন আমরা দেখিনা। নিরাপত্তার কারনেও সাধারনত বাংলাদেশের মায়েরা-মেয়েরা এমন প্রকাশ্য স্থানে সোনার গহনা সচরাচর পরেনওনা।

পরে কায়রোর এক সাংবাদিকের মাধ্যমে জেনেছি সেই হকার মহিলা এক আরব আদিবাসী বেদুঈন সম্প্রদায়ের সদস্যা। বাজারে বা প্রকাশ্য স্থানে যেতে তারা এমন নিজেদের সোনার গহনায় মুড়িয়ে রাখতে পছন্দ করেন।

এমন কয়েকদিন পত্রিকা নিতে নিতে সেই হকার মহিলার সঙ্গে আমার একটি ভাব হয়ে যায়। আমি একটা ইংরেজি পত্রিকা নেই তা তিনি এরমাঝে জেনে বুঝে গেছেন। তাই তার সামনে গেলেই হেসে সেই পত্রিকার একটি কপি বাড়িয়ে দিয়ে পয়সা বুঝে নেন। তার হাসি দেখে বুঝতে পারি তার দাঁত কয়েকটিও সোনায় বাঁধানো!

কিন্তু সেই পত্রিকাওয়ালির সঙ্গে আমার কখনও কথা হয়নি। কারন তিনি আরবি ছাড়া কোন ভাষা জানেননা। আমিও আরবি বুঝিনা। বাংলাদেশের মুসলমান পরিবারের সন্তান হিসাবে কোরান পড়তে গিয়ে আমিও আরবি পড়তে শিখেছিলাম। কিন্তু আমাকেও তখন এর অর্থ শেখানো হয়নি।

আমাকে শেখানো হয়েছিল আরবি আল্লাহর ভাষা। কোরান আরবিতে না পড়লে শিখলে বেয়াদবি হয়। আল্লাহর সঙ্গে বেয়াদবি মানে ইহকালে পরকালে কঠিন শাস্তি। অতএব শাস্তির ভয়ে আমিও হুজুরের সঙ্গে তা শুধু মুখস্ত করে গেছি।

কিন্তু তা আমার মনে আমাদের মনে তা কোন অনুভূতির সৃষ্টি করেনা। কারন আমি-আমরা এর অর্থ জানিনা। পরে একদিন বুঝতে শিখেছি যিনি আল্লাহর সঙ্গে বেয়াদবির ভয় দেখিয়ে আমাকে অর্থ শেখাননি তিনিও আসলে এর অর্থ জানতেননা। তার হুজুরও ভাষাটি তাকে একই রকম ভয় সহ মুখস্ত শিখিয়েছেন।

 আজ আরব দেশে এসে মনে হয় যদি আরবিটা তখন অর্থ সহ শিখতাম তাহলে অনেক উপকার হতো। বিশেষ এতে আমার রিপোর্ট সুবিধা হতো। কুড়িটি আরব দেশের মাতৃভাষা আরবি। এমন ছ’টি আরব দেশ ভ্রমনে গিয়ে আমি একই ভাষাগত সমস্যায় পড়েছি।

আরেক কারনে তাদের আরবি পত্রিকা পড়তেও পারতামনা। কারন আমরা জের জবর সহ আরবি ভাষা পড়তে শিখেছিলাম। তাদের আরবিটা জের জবর বিহীন। আর পড়তে পারলেই বা কী। অর্থ যদি না জানি বুঝি।

কায়রোর সাইয়্যেদেনা এলাকাটা বাংলাদেশের মাজার এলাকার মতো। বলা হয় ইমাম হোসেনের(রাঃ) কর্তিত মাথার কবর সেখানে। বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসে পড়েছি কারবালার ময়দানে এজিদ বাহিনী ইমাম হোসেনকে জবাই করে হত্যা করেছিল।

মীর মোশাররফের বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস এই প্রজন্ম পড়ে-পড়েছে কিনা জানিনা। আমরা বিষাদ সিন্ধু যখন পড়তাম তখন কাঁদতাম। সে এক শোকগাঁথা।

এখন বিষাদ সিন্ধুর পড়ার অভিজ্ঞতা লোকজনকে অন্য একভাবে জব্দ করতে কাজে লাগাই। আমার প্রিয় প্রজন্মদেরও জবাবটি শিখিয়ে রাখি। মুক্তিযুদ্ধের অনেক সত্য গল্প যখন করি তখন যুক্তিতে যারা পারেননা তখন তারা প্রশ্ন রাখেন মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার বয়স কত ছিল।

তখন তাদের আমি জবাব দিয়ে বলি মীর মোশাররফ হোসেন যে বিষাদ সিন্ধু লিখেছিলেন এরজন্য তিনি কারবালার ময়দানে ছিলেননা। মানুষ ইতিহাস পড়ে অনেক সত্য জানে। ইতিহাসের সত্য জানতে ঘটনাস্থলে স্বশশীরে উপস্থিত থাকার দরকার নেই।    

হযরত মোহাম্মদের (দঃ) নাতি ইমাম হোসেন (রাঃ)। হযরত আলী (রাঃ), হযরত ফাতেমার (রাঃ) ছেলে। শিয়া সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় ইমাম। ৬৮০ সালে যিনি ৭২ জন পারিবারিক সদস্য, অনুসারী সহ কারবালার যুদ্ধে নিহত হন। সেটিই আশুরার ইতিহাস।

ইরাকের কারবালায় আমি ইমাম হোসেনের (রাঃ) মাজারে গিয়েছিলাম। ইসলামের ইতিহাসের কারবালা একটি যুদ্ধের ময়দানের নাম। ইমাম হোসেন বাহিনীর সঙ্গে যেখানে এজিদ বাহিনীর যুদ্ধে হয়েছিল।

ইমাম হোসেনের মাজারের কারনে আজকের কারবালা শিয়া প্রধান দেশ আরবের একটি জমকালো শহর। ইসলামের ইতিহাসে আছে ইমাম হোসেনকে কারবালার ময়দানে জবাই করা হয়েছিল।

কিন্তু তাঁর কর্তিত মাথাটি স্বজনদের একজন মিশরে নিয়ে এসে কায়রোয় তা সমাধিস্থ করেন। কিন্তু এ নিয়ে অনেক মতান্তর আছে। একপক্ষ মনে করেন সেই মস্তকটির সমাধি আসলে সিরিয়ায়। এ নিয়ে দামাস্কাসে একটি মাজারও আছে।

 আরেক পক্ষের মত পরে সেটি কারবালায় স্থানান্তর করে ইমাম হোসেনের দেহের সঙ্গে আবার নতুন করে সমাধিস্থ করা হয়। আরেক পক্ষ মনে করেন ইমাম হোসেনের মস্তকটি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ফিলিস্তিনের হেবরনে।

সেখানেই সেটি দাফন করা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনের ক্রুসেডের সময় সেটি শত্রুপক্ষের কাছে চলে যেতে পারে এমন আশংকায় সেটি স্থানান্তর করা হয় আজকের কায়রোয়।

তবে কায়রোর সাইয়্যেদেনা এলাকা প্রথম গড়ে ওঠে ইমাম হাসানের (রাঃ) বংশধরদের মাধ্যমে। এ বংশের সৈয়দা নাফিসা এখানে তাঁর শেষ জীবন কাটান। তিনি একজন শিক্ষক, ইসলামিক স্কলার ছিলেন। তাই তাঁর বংশধরদেরও মূল পেশা এখনও শিক্ষকতা।

১১৫২ সালে সাইয়্যেদেনা এলাকার মাজার-মসজিদ নির্মান করা হয়। ১৮৭৪ সালে সেই কমপ্লেক্স আবার পুনঃনির্মান করা হয়েছে।

সৈয়দ থেকে সাইয়্যেদেনা। সৈয়দ বংশের কথা বাংলাদেশের মুসলমানরাও জানেন। সৈয়দা নাফিসার সূত্রে হযরত মোহাম্মদের (দঃ) বংশধররা বংশ পরষ্পরায় এই সাইয়্যেদেনা এলাকায় বাস করে আসছেন।

হযরত আলী (রাঃ), ইমাম হোসেনের (রাঃ) অনুসারীরা শিয়া হলেও ইমাম হাসানের (রাঃ) অনুসারী এই সম্প্রদায়টি সুন্নি। এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের মিশরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়। তাদের দাওয়াত করা হয় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে।

হযরত মোহাম্মদের(দঃ) বংশধরদের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে মহানবীর জন্মদিন ১২ রবিউল আউয়ালও এ দেশের বড় একটি জাতীয় উৎসব। এ উপলক্ষে সারা মিশর জুড়ে হয় মিষ্টি বিক্রির উৎসব।

সারাদেশ জুড়ে এলাকায় এলাকায় প্যান্ডেল সাজিয়ে বিক্রি করা হয় নানান রকমের শুকনো মিষ্টি। এ উপলক্ষে একজন আরেকজনকে মিষ্টি উপহার দেন। সরকারি বেসরকারি কর্মচারীদের মিষ্টি উপহার দেয় যার যার কর্তৃপক্ষ। এরজন্যে ১২ রবিউল আউয়াল কেন্দ্রিক মিশরের মিষ্টির অর্থনীতিটি বিশাল।