মিথ্যাবাদীরা চালাকির মাধ্যমে যেভাবে বাড়াচ্ছেন বাংলাদেশের করোনা রোগী!

আমাকে একজন বললেন, আপনি না বললেন করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে ছড়াবেনা। কিন্তু এটি এখন ছড়াচ্ছে কেনো। তাকে বললাম ভাইরে, জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের সংক্রমনের হার এখনও অনেক কম। এরপরও যা ছড়াচ্ছে তা মানুষের আইন না মানার কারনে। বাংলাদেশের মানুষজন যে যেভাবে পারছে চালাকি করে আইন অমান্য করছে। পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সঙ্গে চালাকি করছে প্রতিদিন! কিন্তু এটি এমন একটি মহামারী রোগ, এর রোগের সঙ্গেতো চালাকি চলেনা।
রোগটি যারা বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন তারা রোগ লুকাতে বিমান থেকে নামার আগে বেশি করে প্যারাসিটামল খেয়ে নিয়েছিলেন যাতে বিমান বন্দরে তাদের জ্বর ধরা না পড়ে! এভাবে মিথ্যা বলে রোগটি তারা তাদের পরিবারে ও গ্রামে-মহল্লায় নিয়ে গেছেন। এখন স্বজনের লাশ বনে-জঙ্গলে পালিয়ে যাচ্ছেন! কবর পর্যন্ত দিচ্ছেননা! বাংলাদেশের সব করোনা রোগীর মরদেহ দাফন করছে পুলিশের লোকজন। পুলিশের সদস্যরাই মৃতের জানাজা পড়ছে। এই করোনা যুদ্ধে বাংলাদেশের চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী-পুলিশের যে ভূমিকা-অবদান, এর দাম বাংলাদেশ কোনদিন শোধ করতে পারবেনা।
দেশের করোনা রোগীদের অনেকে এখনও হাসপাতাল-ডাক্তারের কাছে গিয়েও মিথ্যা বলে অন্যদের মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন! মিথ্যা বলা বন্ধ করতে হবে। সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। রক্ষা করতে হবে সামাজিক দূরত্ব। দেখবেন, এই রোগ আর বাড়বেনা। মনে রাখবেন করোনা মানেই মৃত্যু নয়। চিকিৎসককে সত্য বলে এটি বাড়িতে থেকেই নিরাময় সম্ভব। বাংলাদেশ এখন বেশি বেশি মিথ্যাবাদীদের দেশ! অদ্ভূত এক দেশ! মক্কা-মদিনার মসজিদও এই পরিস্থিতিতে বন্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার জন্যে, জামাতে নামাজ পড়ার জন্যে একেকজন অস্থির! কিন্তু এদের কাউকে মৃতের লাশ দাফনে নেয়া যাচ্ছেনা! মৃতের দাফনে যাবার কথা বললে পালিয়ে যায় এমন মুসল্লির দেশের নাম বাংলাদেশ ছিলোনা। করোনার চাইতে এসবই এখন দেশের বড় বিপদের নাম।
অথচ শুধু মানুষকে ঘরে রেখে সামাজিক দূরত্ব মেনে অস্ট্রেলিয়া করোনা যুদ্ধে নাটকীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। নতুন সংক্রমন নেমে এসেছে ২% এ। উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ায় করোনা টেস্টের হার পৃথিবীর সর্বোচ্চ। আড়াই কোটি মানুষের দেশে তিন লাখের বেশি মানুষের করোনা টেস্ট হয়েছে। জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৬৩৬৬ জন করোনা রোগী এদেশে নিশ্চিত হয়েছেন। এরমধ্যে মারা গেছেন ৬১ জন। এক রুবি প্রিন্সেস নামের প্রমোদতরী থেকে ছয়শ’র বেশি করোনা রোগী পাওয়া গেছে। এই জাহাজকে বলা হয় অস্ট্রেলিয়ায় করোনা রোগ বিস্তারের এপিক সেন্টার। সেই অস্ট্রেলিয়া পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসেছে। ইস্টারের ছুটিতে গতবারের চেয়ে রাস্তায় গাড়ি ছিল ৯০ শতাংশের কম। কেউ আইন অমান্য করলে এখানে ১৬৫২ ডলার জরিমানা করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে চলে এলেও অস্ট্রেলিয়া সরকার সামাজিক দূরত্বের আইন আগামী ছয়মাস রাখতে চাইছে।
করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষজনও এখন যেমন মুখে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া শিখে ফেলেছেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার অভ্যাসটি বহাল রাখা গেলে এদেশের অনেক রোগের পাশাপাশি সামাজিক সম্প্রীতিও বাড়বে। এমনিতে বাংলাদেশের গ্রামীন স্বাস্থ্য-পয়ঃনিষ্কাশন অবকাঠামো ভারতের চাইতে ভালো। এবার নতুন যে সব স্বাস্থ্য সচেতনতার অভ্যাস গড়ে উঠেছে তা অব্যাহত রাখা গেলে বাংলাদেশের শিশু স্বাস্থ্য-গড়আয়ু বৃদ্ধি সহ নানাকিছুতে নাটকীয় অগ্রগতি ঘটানো যাবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের টয়লেটে সেনিট্রেশনের স্বাস্থ্য-সম্মত পৃথক বিনের ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি এই মানবিক এই ব্যবস্থাপনার অভাবে মাসিকের সময়গুলোতে বাংলাদেশের অনেক মেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে চায় না।
বাংলাদেশের করোনা রোগীর চিকিৎসা নিয়ে বিশৃংখলা এখনও দূর হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যত সাহস দেননা কেনো, যতই সম্মানি দেবার কথা বলেননা কেনো, যে সব ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন তাদের বিশ্রাম-থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এখনও নির্বিঘ্ন করতে পারেনি বাংলাদেশের আনস্মার্ট আমলাতন্ত্র। মিলেনিয়াম হোটেল কর্তৃপক্ষ বলেছে এখন পর্যন্ত একটা পয়সাও তাদেরকে স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয় থেকে দেয়া হয়নি।
পর্যটন কর্পোরেশনের অবকাশ হোটেলে ক্লান্ত হয়ে ফিরে তারা দেখেন, খাবার নেই! স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বলছি আপনার মিডিয়া ব্রিফিং ভালো হয়না। ওখানে সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা নির্বিঘ্ন করার কাজ করুন। কোন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিদিন এসব ব্রিফিং’এ আসেননা। প্রধানমন্ত্রীর ইজ্জত রাখুন। তিনি সবকিছুতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আর আপনি আছেন ব্রিফিং’এ চেহারা দেখানো নিয়ে ব্যস্ত! আল্লাহপাক সবাইকে ভালো চেহারাও দেননা। বুঝেছেন স্যার?
করোনা চিকিৎসার চাইতে বাংলাদেশে এখন কাজ হারানো গরিব মানুষজনের ঘরে খাবার পাঠানো বড় সংকট হয়ে উঠছে। অব্যবস্থাপনার কারনে জামালপুরে লুট হয়েছে ত্রানের গাড়ি। মানুষের ভিড়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাচ্ছেনা বলে দশ টাকা কেজির চাউল বিক্রি বন্ধ রাখতে হয়েছে। দ্রুত এ চাউল মানুষের ঘরে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিন। কোন একজন মানুষ খাবারের কষ্টে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর এমন হাজার হাজার কোটি টাকার স্টিমুলেজ প্রনোদনা সব ব্যর্থ হয়ে যাবে।
মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানোর জন্যে স্থানীয় এনজিও কর্মী, স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাসেবক ছেলেমেয়েদের সাহায্য নিন। এমন কাজের জন্যে চমৎকার চমৎকার মানবিক ছেলেমেয়ে কিন্তু সারাদেশে মুখিয়ে আছে। সারাদেশে কিন্তু অনেক ছেলেমেয়ে এখন নিজ উদ্যোগে এমন ত্রানের কাজ করছে। বাংলা নববর্ষের দিন একদল যুবক সামাজিক দূরত্ব নীতিমালা মেনে একটি আদিবাসী গ্রামের ১২০ পরিবারের কাছে খাদ্য সাহায্য পৌঁছে দেন। ভ্যানের ওপর খাবারের প্যাকেট রাখা ছিল। একজন একজন এসে একেকটা প্যাকেট তুলে নিয়ে গেছেন। ত্রান বিলিতে বাংলাদেশ পুলিশ এবার এখন পর্যন্ত সারাদেশেই খুবই ভালো কাজ করছে। মানুষ যখন সেনাবাহিনীর হাত থেকে চাউল সহ সাহায্য চাইছে, সেনা সদস্যদের আরও বেশি সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
চাউল চুরির সঙ্গে যেখানে যাকে পাওয়া গেছে যাচ্ছে তাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে তাৎক্ষনিক ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে সাজার ব্যবস্থা করুন। এই সময়ে সারাদেশে এমন আওয়ামী লীগার চাউল চোর ধরা পড়া মানে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে ঠকিয়েছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে চাউল চোরদের দলে ঢুকিয়েছেন। বাংলাদেশে এসব ত্রান চুরির ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। ১/১১’র সময় বিএনপির নেতাদের পুকুর থেকে শুধু ঢেউটিন বেরুচ্ছিল।
আগের সঙ্গে এখনকার পার্থক্য এখন মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া অনেক শক্তিশালী। তাই কোন চুরি আর লুকোনো যাচ্ছেনা। চোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও হচ্ছে। এদের পারিবারিক-সামাজিকভাবেও বয়কট করুন। যাতে তাদের ছেলেমেয়েরা বাবার পরিচয় বলতে লজ্জা পায়। খুনি মাজেদের ছেলেমেয়েরা এমন পিতাকে শেষবারের মতো দেখতেও আসেনি। দূর্যোগের এই সময়ের চাউল চোররা খুনি মাজেদের চেয়ে ভালো কেউ নয়।
পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে এই সময়ে বিশেষ একটি নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমে লম্বা ছুটি পেয়ে পোশাক শ্রমিকরা বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। এরমাঝে পোশাক ব্যবসায়ী বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বজায় রেখে কারখানা খুলে কাজ করানো যেতে পারে। আসলে করোনা ভাইরাসের যে বিপদজ্জনক রূপ, সামাজিক দূরত্ব মেনে পোশাক শ্রমিকদের কারখানায় আসা-ঢোকা-কাজ করা-নিরাপদে বাড়ি যাবার সুযোগ নেই। আর এসব শ্রমিক বস্তির ঘরে যেভাবে গাদাগাদি অবস্থায় থাকেন তাদের মাধ্যমে মহামারী এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি অনেক বেশি।
সরকারকে বিপদে ফেলতে বানিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সির সেই সংবাদ সম্মেলন, নব্য আওয়ামী লীগার এমপি সালাম মুর্শেদিগং ঢাকায় শ্রমিকদের ঢেকে এনে ঢাকায় নারায়নগঞ্জ-গাজীপুরে এই রোগকে মহামারী করার বিপদ তৈরি করেছেন মহামারীর! অথচ কোন কারখানাতেই এখন কাজ হচ্ছেনা। উল্টো এরা এখন বেতনের দাবিতে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন। বেতন না পাওয়াতে তারা বাড়িভাড়া, দোকানবাকির টাকা দিতে পারছেননা। তাদের বিক্ষোভ, বস্তির রূমে গাদাগাদি রেখে মহামারী ছড়াতে কী তাদের ঢাকায় ডেকে এনেছেন বানিজ্যমন্ত্রী?
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্য ইস্রাফিল সোমবার রাতে এক টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, চলতি পরিস্থিতিতে ৮-১০ লাখ পোশাক শ্রমিকের বেতন পাবার কোন সুযোগই নেই। এই ৮-১০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক বেতন-খাবারের দাবিতে এখন যদি রাস্তায় থাকে তাহলে করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধটাই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে।
মঙ্গলবার এ নিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি বাংলাদেশের এই সেক্টরটি এখনও সম্পূর্ন ব্যাংক ঋনের ওপর নির্ভরশীল। প্রয়াত নুরুল কাদেরের ফর্মূলায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের বিকাশ হয়। এতে এলসির বিপরীতে ব্যাংক কাঁচা মাল ক্রয়বাবদ ৮০% পর্যন্ত ঋন দেয়। এসব কাঁচামাল যখন বন্দরে এসে পৌঁছে তখন শুল্কছাড়ে কাজে দেয় ব্যাংকের বন্ড সুবিধা । করোনা ভাইরাসের সংক্রমন পরিস্থিতিতে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেই বাংলাদেশের সব শিপমেন্ট বন্ধ করে দেয় বায়াররা। মালই যেখানে যায়নি টাকা আসবে কোত্থেকে!
এমনিতে বাংলাদেশের সিংহভাগ গার্মেন্টস কারখানা আগের মাসের বেতন দেয়, পরের মাসের প্রথম দিকে। কিন্তু মার্চ মাসের শিপমেন্ট না হওয়ায় তাদের পক্ষে এখন টাকা পাওয়া কষ্টকর। ব্যাংকের কাছে পুরনো ৭০-৮০ ভাগ ঋন থাকায় তারা ব্যাংকের কাছ থেকে নতুন ঋন পাচ্ছেনা। লকডাউনের কারনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনেকে অফিসে না আসায় অনেক কাজও হচ্ছেনা। এসব বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর প্রনোদনার টাকা ৪০ ভাগ গার্মেন্টস মালিক নিতেও পারবেনা। কারন টাকা দেবার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী যতোটা আন্তরিক, অর্থমন্ত্রী ততোটা রক্ষনশীল।
প্রধানমন্ত্রীর প্রনোদনার টার্গেট ছিল আগামী তিন মাস গার্মেন্টেস শ্রমিকদের বেতন প্রনোদনা হিসাবে তাদের ব্যাংক বা বিকাশ একাউন্টে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এই টাকা ২% সুদে ঋন হিসাবে দেয়া হবে সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টস কারখানাকে। কিন্তু এদের ঋন নেবার অক্ষমতায় শ্রমিকরা যাতে অভাবে কষ্ট না পায় সে পথ বের করতে হবে সরকারকে। ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষি-পরিবহন শ্রমিক, হকার-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবাইকে এখন বাঁচিয়ে রাখার প্রধানমন্ত্রী প্রনোদনা দ্রুত বিতরনে তাঁর দফতরকে দ্রুততম সময়ের পথ বের করতে হবে। মানুষ বাঁচাতে হবে সবার আগে।