মনটা খুব খারাপ। কারন বুধবার বাংলাদেশে করোনা মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। বুধবার পর্যন্ত এই সংখ্যা ১০১২ জন। আক্রান্ত সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৮৬৫ জন। অথচ আমি প্রথম থেকে লিখে আসছিলাম ভিন্ন কথা।
আমি অস্ট্রেলিয়ার একটি বহুজাতিক সমাজে থাকি। জানুয়ারিতে এখানে প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায়। যিনি চীনের উহানে চীনা নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়েছিলেন। শুরুতে করোনা যত দেশে ছড়িয়েছে সব জায়গায় ছিল একটি বহুজাতিক সমাজ।
বাংলাদেশের সমাজ বহুজাতিক নয়। দেশের কিছু এলাকায় অল্প সংখ্যক আদিবাসী ছাড়া সবাই বাংলায় কথা বলেন। জীবনযাপনও সব দেশের মধ্যে। এরজন্যে শুরুর দিকে লিখছিলাম এই মহামারী বাংলাদেশে ছড়ানোর উপাদান-সুযোগ কম।
অথচ এখন উল্টো হেরে গেছি অস্ট্রেলিয়ার কাছেও। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে এখন পর্যন্ত রোগী পাওয়া গেছে ৭ হাজার ২৬৫ জন। এদের ৬ হাজার ৭২০ জন সুস্থ হয়ে গেছেন। মারা গেছেন ১০২ জন। ১০ জুন রোগী পাওয়া গেছে ৯ জন।
বাংলাদেশে রোগটি নিয়ে যান ইতালি প্রবাসীরা। নারায়নগঞ্জে রোগটি প্রথম যায় উমরাহ হজযাত্রীর মাধ্যমে। আমেরিকা প্রবাসী এক মা-মেয়ে রোগটি নিয়ে যান গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে। মহামারী ছড়াতে এমন বেশি লোক লাগেনা।
মানুষ হিসাবে আমাদের অনেক সমস্যা অথবা সীমাবদ্ধতায় আর সরকারি অদক্ষতায় আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারিনি। যার যার দায়িত্ব ভুলে একজন আরেকজনকে দোষ দিয়ে গেছেন এবং এখনও দিচ্ছেন!
নারায়নগঞ্জ থেকে সংক্রমিত লোকজন লোকটি সারাদেশে ছড়িয়ে দেন। তারা নৌকায়, ট্রাকে করে যে যেভাবে পেরেছেন রোগটি নিয়ে যার যার এলাকায় গেছেন! এটাও কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রবনতা।
অসুখে পড়লে প্রিয়জনের কাছে যেতে চাই। এক সময় দেখতাম আমাদের পাহাড়ি বন্ধু কারও ম্যালেরিয়া হলে তারা ঢাকা থেকে পাহাড়ে চলে যেতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন পাহাড়ে তাদের এমন কিছু চিকিৎসা আছে তাতে সহজে ম্যালেরিয়া সেরে যায়।
কিন্তু করোনাতো আর ম্যালেরিয়া নয়। এটি ছোঁয়াচে মহামারী। জেনে অথবা না জেনে আমরা অসুখটি গ্রামে প্রিয়জনের কাছে নিয়ে গেছি। আমাদের মাধ্যমে এভাবে রোগটি গ্রামেও চলে গেছে! কত দায়িত্ব! এলাকার লোকজনকে করোনা চেনাতে হবে!
এখন আর বাহক অথবা সংক্রামকের পরিচয়মাত্র নারায়নগঞ্জবাসী নন। বাহক এখন সবখানে। জীবন আর জীবিকার দ্বন্দ্বে জীবিকা প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশে। এই মহামারী মোকাবেলার প্রথম আহবান ছিল ঘরে থাকা মানে বেঁচে থাকা।
উন্নত বিশ্ব যারা পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছে তারা মানুষকে ঘরে রাখতে যে আর্থিক ব্যবস্থাদি নিতে পেরেছে বাংলাদেশের সে অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছিলোনা। চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সুফল ঘরে তোলা যায়নি।
গার্মেন্টসওয়ালারা শুরুতে বলেছিল অমুক দিনের মধ্যে কাজ শুরু না করলে সব অর্ডার চলে যাবে ভিয়েতনামে! সেই শুরু করতে গিয়ে ভিয়েতনামের অর্ডার আটকানো চায়নি। চীনের সব অর্ডার নিয়ে গেছে ভিয়েতনাম।
বাংলাদেশ সংক্রমন ছড়িয়ে দেবার ঝুঁকিই শুধু রিসিভ করতে পেরেছে। গার্মেন্টসওয়ালারাও এখন নতুন কারখানা নয়, পিসিআর ল্যাব বসাচ্ছে! আর শ্রমিক ছাটাই শুরুর দিন তারিখ হুমকি দিয়ে বলছে উল্টো গার্মেন্টস সেক্টর!
গার্মেন্টসওয়ালাদের এই হুমকির মনের কথাও সবাই জানে! ছাটাই করোনা যদি সরকার তুমি আমাকে আরও দাও আরও দাও। কারন গার্মেন্টস মালিকরাই দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী! তাদের গিনিপিগের নাম শ্রমিক।
এই মহামারীর মধ্যে আবার বাংলাদেশের কিছু মানুষজনকে ঈদ শপিং করতে হয়েছে। ‘ছুট একটা ভাইরাসরে অত ডরাইয়া ঈদ করতাম নায়নি’! গণপরিবহন না থাকলেও হেঁটে-রিক্সায় ট্রাকে যে যেভাবে পেরেছে ঈদে বাড়ি যাওয়া আসা করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ এর আগে এভাবে হেঁটেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন হেঁটেছে জীবনের ভয়ে। এবার হেঁটেছে মনের টানে! ‘বাড়িত না গেলে ঈদ অয় কেমনে’? অতএব এমন গণ সহযোগিতায় করোনাও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সবখানে।
এখন শুধু প্রিয়জনের লাশ দাফন অথবা সৎকারেই যাওয়া যায়না! মৃত্যুর আগে স্বামী চিৎকার করে কেঁদেছে আর একটু পানি চেয়েছে। স্ত্রী দরজা খোলেনি। চিৎকার বন্ধ হয়ে গেলে সকালে ছোট ছেলেটি গিয়ে দেখেছে তার বাবা বেঁচে নেই আর।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে যখন অতগুলো আইসিইউ-ভেন্টিলেটর নেই বলে অর্থহীন হাহাকার চালায়। আইসিইউ-ভেন্টিলেটর নেই এসবতো আমরা জানি। আমাদের টেস্টের মেশিনপত্র টেকনিশিয়ানও ছিলোনা।
টেস্ট কিট, মেশিনপত্র, টেকনিশিয়ান যখন বাড়তে শুরু করে তখন দেখি খালি ভুল হয়। এরপরও জাফরউল্লাহদেরটা নেইনি। এরপর ব্যাটা নিজে করোনায় পড়ায় এখন আর অনুমতি অনুমতি বলে আর চিৎকার করতে পারেনা।
আরেক ব্যাটা কোন এক কালে ছাত্রলীগ করেছে এই দাবিতে মাতব্বরি দেখাতে নিউইয়র্ক থেকে ঢাকা চলে এসেছিল! যখন সে অশোক চৌধুরীর সঙ্গে মাথায় পট্টি বেঁধে ছাত্রলীগ করতো তখন আমাদের লোকজন কম ছিল।
এখনতো আর আমাদের লোকজন কম নয় যে তাকেও দেশে ফ্লোর দিতে হবে! উনি আবার বড় দাতা হাতেমতাই! আট ল্যাগেজ ভর্তি পিপিই নিয়ে এসেছেন! দিয়েছি সব এয়ারপোর্টে আটকে! হরিদাস পাল এখন শুধু ফেসবুক লাইভই করতে পারবে আর কিছু নয়।
শুরুর দিকে বাংলাদেশের টেস্ট-চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত সবাই সংক্রমনের শিকার হয়ে যাচ্ছিলেন! আর সহজ দোষ দেয়া হচ্ছিল রোগীরা মিথ্যা কথা বলে! আর তাদেরই কেউ কেউ বলছেন বেসরকারি সেক্টর এই সময়ে বিট্রে করেছে।
সরকারি হাসপাতালের লোকজন আগে বিকালে গিয়ে দায়িত্ব পালন করতেন বেসরকারি হাসপাতালে, এই সময়েও তা করতে গিয়ে আক্রান্ত হতে শুরু করেন। ইয়াংরা বলছিলেন বয়স্করা অনেক সমস্যার মূল।
তারা রোগীদের কাছে যেতেও ভয় পান। পিপিই সহ সুরক্ষা সামগ্রী তাদের অনেকে ঠিকমতো পরতে খুলতে জানেননা বলে আক্রান্ত হন। এর অনেক কিছুই আমাদের অনেকের যোগ্যতা অথবা অযোগ্যতা।
আমাদের কোথাও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষন ছিলোনা। যেহেতু সবার সবকিছু লাগতোনা তাই অনেক কিছু আগে ধরা পড়েনি। নানান সুরক্ষা সামগ্রী পরা-খোলার প্রশিক্ষন যখন বাড়লো তখন সংক্রমনও কমে গেলো।
আইসিইউ-ভেন্টিলেটর যেমন চটজলদি আমরা বাড়াতে পারছিলামনা, তা সম্ভবও নয়, এগুলোর পর্যাপ্ত জনবলও আমাদের নেই। অক্সিজন সংকটও চরম আকার ধারন করেছে বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালে হাসপাতালে।
চট্টগ্রামের এক হাসপাতাল থেকে একদিন একজন আকুতি জানিয়ে বলছিলেন ভাই একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্টে কাশতে কাশতে মরে যাচ্ছি।
অক্সিজেন সংকটের একটি কারনও জানা গেলো! যদি সময়মতো অক্সিজেন পাওয়া না যায় এই চিন্তায় অনেকে পিঁয়াজের বস্তার মতো অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনেও বাড়িতে গুদামজাত করেছেন!
অথচ এসব অক্সিজেন তারা বাড়িতে ব্যবহারও করতে পারবেননা। স্বাস্থ্যখাতের কি অবস্থা এটি এবার সবাই টের পেলো। দেশের গরিব মানুষ যারা চিকিৎসার জন্যে বিদেশ যেতে পারেনা তারা এর সব জানে।
ধনীরা সবাই মোর্শেদ খান বা সোহেল রহমানের মতো সাহসী হতে পারেনি যে পুরো এয়ারক্রাফট ভাড়া নিয়ে বিদেশ চলে যাবে। গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিরা সিএমএইচ, পুলিশ-সাংবাদিকদের জন্যেও কিছু পৃথক ব্যবস্থা হয়েছে।
শুধু আমজনতার কোন নিশ্চিত ব্যবস্থা নেই। এই ব্যবস্থা নাই থাকবেনা জেনেই বারবার বলা হচ্ছিল সবাই সতর্ক হোন। যাতে রোগ বাঁধিয়ে না ফেলেন। রোগ বাঁধিয়ে বসলে কিন্তু চিকিৎসা পাবেননা। অথবা রাষ্ট্রের সে সামর্থ্য নেই।
আমরা হয়তো মানুষকে সেভাবে ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারিনি। বুঝিয়ে বললে যে সে শোনে এর প্রমান আছে টোলার বাগে, মাদারিপুরের শিবচরে। এবং সর্বশেষ পূর্ব রাজাবাজারে। মানুষকে আস্থায় নিতে পারলে সে অনুকূল সাড়া দেয়।
বিপুল জনঘনত্বের বাংলাদেশে এখনও সংক্রমন এবং মৃত্যুহার কম। মহামারীর সময়ে এটি ভেবে বা বলে নিশ্চিন্ত থাকা যাবেনা। মানুষকে বাঁচাতে তাদের অর্থনৈতিক হতাশা দূর করতে হবে। হতাশ মানুষকে বাঁচানো কঠিন।