রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখিন। উখিয়া-কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকার পরিবেশ-বন সম্পদের যে অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে গেছে এর ক্ষতিপূরন কোনদিন হবেনা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো এই শরণার্থীরা কবে বাংলাদেশ থেকে যাবে বা আদৌ যাবে কীনা এর কোন নিশ্চয়তা নেই। ঠিক একইভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের একজনকেও পাকিস্তান ফেরত নেয়নি। কিন্তু এরপরও বিজ্ঞানী নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে মুদ্রার অপর একটি দিক আছে। সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে প্রত্যেক ক্রিয়ারই । বাংলাদেশের মতো একটা দেশ, যে দেশের হাজার হাজার মানুষ নিরাপত্তা এবং উন্নত জীবনের আশায় যেখানে প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈধ-অবৈধ পথে ঢুকে যেতে চায়, সে দেশই কিনা মানবিক বিপর্যয়ের শিকার একটি জাতিগোষ্ঠীকে সীমান্ত খুলে দিয়ে আশ্রয় দিয়ে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে! এরপর থেকে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষেরা এখন বিপুল আগ্রহ আর শ্রদ্ধার সঙ্গে বাংলাদেশকে জানে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোর অনিবার্য এক মুখ। মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাঠগড়ায় মিয়ানমার। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোর শিরোনামে আবার বাংলাদেশ! এ শিরোনাম মর্যাদার, আস্থার, গৌরবের।
বাংলাদেশ নিজে একটি শরণার্থী দেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ওই শরণার্থীদের খাওয়াতে পরাতে প্রতিটি ভারতীয়কে নানাভাবে শরণার্থী কর দিতে হয়েছে। বাসে-ট্রনে চড়লে, জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয়ে, এমনকি সিনেমার টিকেট কেনার সময়েও দিতে হয়েছে শরণার্থী কর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এমন ভারতীয়দের অনেক অবদান। তাদের ১১ হাজার সৈন্য মারা গেছে যুদ্ধে। আহত-পঙ্গু হয়েছে লক্ষাধিক। বাংলাদেশ এসব ভুলে গেছে অথবা এই প্রজন্ম তা জানেইনা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথমে জার্মানিতে এবং পরে ভারতে শরণার্থী জীবন কাটিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা। শরণার্থী থাকা অবস্থায় লন্ডনে শেখ রেহানার বিয়ে হয়। শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার ছেলেমেয়েরা শরণার্থী শিশু হিসাবে বড় হয়েছে পড়াশুনা করেছে। বিএনপির বর্তমান কার্যকর চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন শরণার্থী জীবন কাটাচ্ছেন লন্ডনে।
সেই বাংলাদেশ শুরুতে এই রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে চায়নি। কিন্তু মিয়ানমারের নিষ্ঠুরতায় বাংলাদেশমুখি রোহিঙ্গা জনস্রোতটি এমন দাঁড়িয়েছিল যে সমুদ্রে ডুবে মারা পড়ছিল শতশত নারী-শিশু। তখন জাতিসংঘের অনুরোধে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ বাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশের সেনা-নৌ-বিমান বাহিনী-পুলিশের সদস্যরা মূলত বিশ্বের দেশেদেশে এই মানবিক কাজগুলোই করেন। বাংলাদেশের যারা শুরু থেকে রোহিঙ্গা প্রবেশের বিরোধী তাদের সিংহভাগ জাতিসংঘ বাহিনীর এইদিকটি জানেননা। তখন বাংলাদেশ জাতিসংঘের অনুরোধ শুনে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। নতুবা জাতিসংঘ বাহিনীতে বাংলাদেশের অবস্থানে তা প্রভাব ফেলতে পারতো। জাতিসংঘ বাহিনীতে বাংলাদেশের অবস্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের ঝুঁকি দূর হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে তখন বলেছিলেন, শেখ রেহানা তাকে বলেছেন, তুমি ১৬ কোটি লোককে খাওয়াতে পারলে এই ১৩-১৪ লাখ শরণার্থীকেও খাওয়াতে পারবে। আদতে এবার রোহিঙ্গা গ্রহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ রেহানার পুত্রবধূ। উল্লেখ্য শেখ রেহানার ছেলে ববির স্ত্রী বাংলাদেশে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কর্মকর্তা। সীমান্তে তিনিই শুরুতে শরণার্থীদের আশ্রয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
বাংলাদেশে নানা কিছুতে চুরি-চামারির সমস্যা। কিন্তু বিশাল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রানযজ্ঞ নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন অভিযোগ উঠেনি। কারন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এই কাজটি শুরু থেকেই সুচারুরূপে চলছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে দক্ষতা-যোগ্যতা এখন আন্তর্জাতিক প্রশংসা-বিস্ময়ের বিষয়। শরণার্থীরা আসার প্রথম প্রায় একবছর বিদেশি ত্রানে হাত দেয়াই লাগেনি। সারাদেশের মানুষের দেয়া ত্রান দিয়ে চালানো হয়েছে বিশাল যজ্ঞ! কিন্তু বিপুল শরণার্থীদের নিয়ে বাংলাদেশের অপ্রস্তুত প্রথম সময়গুলোর কারনে বনজ সম্পদের বিপুল এবং অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। শরণার্থীদের চাল-ডাল দেয়া হয়েছে কিন্তু তা রান্না করার কোন জ্বালানি দেয়া হয়নি। সে জন্যে এই জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়েই ধংস হয়ে গেছে বিপুল এলাকার বনজ সম্পদ। বিপুল এই শরণার্থীদের কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষজনের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সবাই চান দ্রুত এই শরণার্থী সমস্যার সমাধান। কিন্তু এই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কবে যাবে বা আদৌ যাবে কীনা তা কেউ জানেনা। কারন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ন দুই বন্ধু ভারত এবং চীন রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে নেই। চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ন মিয়ানমারের সঙ্গে বানিজ্য। ভারতের বর্তমান সরকারের কাছে রোহিঙ্গারা মুসলমান। সবাই শরণার্থীদের আরও বেশি চাল-নুন দিতে রাজি। তাদের বাসভূমে নিরাপদে পাঠাতে মিয়ানমারকে চাপ দিতে রাজি না।
এই অবস্থার ভিতর নেদারল্যান্ডে মঙ্গলবার শুরু হয় রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের শুনানি। ওআইসির সিদ্ধান্তে সেখানে মামলা করেছে গাম্বিয়া। আর গাম্বিয়াকে নানা সহযোগিতা দিচ্ছে বাংলাদেশ-কানাডা আর নেদারল্যান্ডস। সারা বিশ্বের মানবাধিকার কর্মীরা এ ইস্যুতে হেগে গিয়ে পৌঁছেছেন। মিয়ানমারের পক্ষে সেখানে গেছেন সে দেশের শান্তির নোবেল বিজয়ী অং সাং সুকী। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাঁর একদার আন্তর্জাতিক সব সম্মান এখন তলানিতে। সব সম্মান এখন বাংলাদেশের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কারন বাংলাদেশ আশ্রয় না দিলে এরমাঝে মারা পড়তেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এই মূহুর্তের বিশ্বে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে নিপীড়িত শরণার্থী গোষ্ঠী। এই মূহুর্তে বিশ্বে সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির বাংলাদেশে। বিশ্ব এই শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা বুঝতে পারছে। কারন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এরমাঝে ঢুকে পড়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। যেহেতু তাদের কোন দেশ নেই তাই উন্নত যে কোন দেশে ঢুকতে পারলেই তাদেরকে আশ্রয় দিতে হয়। তাদেরকে মিয়ানমারে ডিপোর্ট করা যায়না। আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ মিয়ানমার মানবেনা তা সবাই জানে। কিন্তু এরমাধ্যমে তাদের প্রতি আন্তর্জাতিক-চাপ-ধিক্কার আরও বাড়বে। একইসঙ্গে বাড়বে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন। আন্তর্জাতিক এই সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ নানাভাবে ক্যাশ করতে পারে নিজস্ব স্বার্থ। রোহিঙ্গা ইস্যু নানান ধংসের পাশাপাশি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এই গুরুত্বকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের আরও এগিয়ে যাবার এটিই প্রকৃত সময়।
পাদটিকাঃ রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুর মতো আগামীতে বাংলাদেশিরাও দেশে দেশে একই সমস্যায় পড়তে পারেন। কারন বাংলাদেশিরা যেমন দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছেন ঠিক তেমনি তাদের খুব কমসংখ্যক দেশগুলোর মূলধারার সঙ্গে মিশতে পারেন অথবা মেশার চেষ্টা করেন! সবজায়গায় গিয়ে গড়ার চেষ্টা করেন ‘একখন্ড মিনি বাংলাদেশ!’ বিদেশে গিয়েও এরা আওয়ামী লীগ-বিএনপির নানা গ্রুপের রাজনীতি-মারামারি করেন! পান খেয়ে পিক ফেলে নোংরা বানিয়ে রাখেন বাংলাদেশি এলাকা! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন যে দেশে যান তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে বাংলাদেশিরা! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খেতে হয়! বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রসার সহ নানাকিছুর পজিটিভ-নেগেটিভ দু’ধরনের দিক আছে। বড় নেগেটিভ হচ্ছে দেশগুলোর মূলধারায় ব্যাপক অংশগ্রহনের অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের বেশিরভাগ বিদেশে গিয়েও যাপন করছেন তুলনামূলক এক অনগ্রসরজীবন। এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে শুরু হয়েছে। এটি বাড়লে এলাকায় এলাকায় বিরূপ ক্যাম্পেনও বাড়তে পারে। অতএব সাধু সাবধান! রোহিঙ্গারাও কোনদিন মিয়ানমারের মূলধারার সঙ্গে মিশতে পারেননি অথবা চেষ্টা করেননি।