দুই হাজার চার সালের ২১ আগষ্টের জনসভার এসাইনমেন্ট আমার ছিলোনা। জনকন্ঠের তরফে এসাইনমেন্টটি ছিল উত্তম চক্রবর্তীর। শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার খবর পেয়ে ছুটে যাই বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে। সে এক অবর্ননীয় দৃশ্য। রাস্তা জুড়ে রক্ত আর মানুষের ক্ষতবিক্ষত দেহের খন্ডাংশ আর পরিত্যক্ত জুতো-স্যান্ডেল এখানে সেখানে পড়েছিল। গোলাপশাহ মাজারসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার বাতাসে টিয়ালসেলের ঝাঁঝ। তখনও পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ চলছিল। শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এরপর কী সেখানে বাদাম-চানাচুর-ঝালমুড়ি খেতে বসে থাকে? সেই যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থতির ভিতর পাহারায় রাস্তায় পানি ছিটিয়ে রক্ত ধোয়ার কাজ চলছিল পুলিশ। বিদেশে যেখানে কোন একটা ঘটনার পর পুলিশ এলাকাটি কর্ডন করে আলামত সংগ্রহের কাজ করে। আর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পুলিশ রক্ত ধোয়ার সহ সব আলামত ধংস করে দিচ্ছিল! এখান থেকে খটকা লাগে চিন্তায়। আমি আমার প্রত্যক্ষদর্শী সহকর্মী সাংবাদিক-ফটো সাংবাদিক, অকুস্থলের আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে ঘটনা জানার চেষ্টা করছিলাম। আমাকে বলা হয় নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে মানবঢাল সৃষ্টি করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবার সময় তার গাড়িতে গুলি চালায় গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। এ তথ্যে বাড়ে খটকা লাগার মাত্রা। কী স্বার্থ?
ঘটনা অনুসরন করার এসাইনমেন্ট পেয়ে গেলাম অফিস থেকে। এখনকার প্রজন্ম জানেনা সেদিন গ্রেনেড হামলায় আহতদের গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল। এরপর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আহতদের ট্রমা সেন্টার নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাদের ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে গিয়ে দেখি ভয়াবহ পরিস্থিতি। একের পর রক্তাক্ত লোকজনকে সেখানে আনা হচ্ছিল। কারও হাত নেই কারও পা নেই। কারোর কিছুই নেই। এদের বেশিরভাগ ছিলেন সংজ্ঞাহীন। কাউকে সরাসরি অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হচ্ছিল। ট্রমা সেন্টারের অতগুলো অপারেশন থিয়েটার ছিলোওনা। অনেকের চিকিৎসা চলছিল মেঝেতে রেখেই। ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রায় রক্ত রক্ত করে চিৎকার করছিলেন। তখনতো এ রকম সোশ্যাল মিডিয়া ছিলোনা। জরুরি রক্তের প্রয়োজনের কথা মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়লে রক্তদানে ইচ্ছুক শতশত নেতাকর্মী-সাধারন মানুষ ভিড় করেন হাসপাতালে। এরজন্যে সেখানে আহতদের চিকিৎসায় অন্তত রক্ত নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি। সেই ট্রমা সেন্টারে আহতদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটি বক্তব্যে চমকে উঠি। আমাকে তারা বলছিলেন আমাদের যা হবার হোক, নেত্রী বেঁচেছেন এটাই আমাদের শুকরিয়া। এটাই আওয়ামী লীগ। পঞ্চাশ বছর বয়সী সংগঠনটি এখনও তাই এমন উচ্ছল-আন্তরিক।
সহকর্মী নেত্রী-কর্মীদের নিয়ে বরাবর জনসভার মঞ্চের সামনের মাটিতে বসে যেতেন মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমান। শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে তাকে মঞ্চে বসার অনুরোধ করলেও তিনি তা শুনতেননা। সহকর্মী নেত্রী-কর্মীদের সঙ্গে এমনই একটি সম্পর্ক ছিলো আইভি রহমানের। সেদিনও তিনি মঞ্চের সামনেই বসেছিলেন। কেউ কী জানতেন এটিই হবে তার শেষ বসা? সুন্দর মুখটা তার অক্ষতই ছিল। সারা শরীর ছিল রক্তেভেজা ছিন্নবিচ্ছিন্ন। সিএমএইচে নিয়ে গিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি। এভাবে স্ত্রীকে হারিয়ে জিল্লুর রহমানের সেই শিশুর মতো কান্নার কথা আজও ভুলতে পারিনা।
এখনতো এয়ার এম্বুলেন্স বাংলাদেশের অনেকের কাছে ডালভাত। কিছু হলেই সিঙ্গাপুর থেকে উড়িয়ে আনা হয় এয়ার এম্বুলেন্স। রোগী নিয়ে সেটি আবার উড়ে চলে যায় সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ অথবা জেনারেল হাসপাতালে। আইভিদের অত টাকা ছিলোনা। এয়ার এম্বুলেন্স-সিঙ্গাপুরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা এসব তখনকার মানুষজন জানতোওনা। আইভি রহমানদেরও তাই বাঁচানো যায়নি। তার আত্মার অভিশাপে এখনও পুড়ছে বিএনপি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। পাপ নাকি তার বাপকেও ছাড়েনা।
গ্রেনেড হামলা নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে গিয়ে তখনই আমি ঘটনার নেপথ্যে তারেকের নাম পাই। খালেদা পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক নেতা আমাকে বলেন রাজাকে বা রানীকে হত্যা বা বন্দী করে ক্ষমতা দখল করে রাজপুত্র, এমন কাহিনী পড়েননি? তেমন সিনেমা দেখেনি? এটিও তেমন একটি ঘটনা। শেখ হাসিনাকে হত্যা করলে দেশজুড়ে চরম একটি বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি হবে। ওই পরিস্থিতির দায়দায়িত্ব খালেদা জিয়ার ওপর চাপিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় বসবেন তারেক, এটিই ছিল মূল প্ল্যান। শেখ হাসিনাকে মারতে না পারায় সে প্ল্যান ভেস্তে গেছে।
বিএনপির নেক্সট নেতা হিসাবে তারেকতো এমনিতেই খালেদা জিয়ার পরে ক্ষমতায় যাবেন। এরজন্যে শেখ হাসিনাকে মারতে হবে নাকি? এরজবাবে বলা হয় প্ল্যানটার মূল নকশাতো সেখানেই। খালেদা জিয়া কখন মরেন সেটি কোন নির্দিষ্ট দিন তারিখ কেউ জানেনা। অত অপেক্ষার তর সইছিলোনা না তারেকের। সে কারনেই তিনি এই নকশার আয়োজন করেন। এই নকশার নেপথ্যের বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার ভিন্ন একটি প্ল্যান ছিল। তারেকের নেতৃত্বে তারা বাংলাদেশকে আবার ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায়। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা দূর্বল হয়। যে কোন সময়ে বদলানো যায়। কাজ করা যায় পুতুল রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে। সেটি তারেকের মাধ্যমে সম্ভব ছিল। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পাঁচবছর পর পর নির্বাচন ছাড়া সহজে বদলানো যায়না। আমার তথ্যদাতা বিএনপি নেতার দাবি ছিল এই নকশাটা খালেদা জিয়া জানতেননা। ঘটনা শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে তিনি তার বাড়ি সুধাসদনে যেতে চান। কিন্তু সুধাসদন থেকে সাড়া না পেয়ে যেতে পারেননি। আর ঘটনা সাজিয়ে ঢাকার বাইরে চলে যান তারেক। ঘটনার তিন দিন পর্যন্ত মিডিয়ায় তারেকের কোন তৎপরতার খবর ছিলোনা।
একুশে আগষ্টে শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যার তারেক নকশা নিয়ে তখন জনকন্ঠে আমার একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। খুব স্বাভাবিক সে রিপোর্টে তখন তারেকের নামটি লেখার সুযোগ বা অনুকূল সময় ছিলোনা। আমার তথ্যদাতা অব দ্য রেকর্ডে তথ্যগুলো বলায় রিপোর্টে ছিলোনা তার নামও। আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি অব দ্য রেকর্ড তথ্যদাতার নাম। ঘটনার দু’তিন দিনের মাথায় অবশ্য বদলে যান খালেদা জিয়া। ছেলের পক্ষ নিয়ে তিনি ঘটনা ধামাচাপা দেবার কাজ শুরু করেন। বিএনপি নেতারা বলা শুরু করেন শেখ হাসিনা তার ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন!
এরপর চালু হয় জজমিয়া নাটক। যে লোকটি কোনদিন গ্রেনেড দেখেনি নোয়াখালীর গ্রাম থেকে তুলে এনে তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে, পরিবারের ভরনপোষনের টোপ দিয়ে জবানবন্দী দেয়ানো হয় গ্রেনেড হামলার! গল্পটা বলিয়ে জজ মিয়াকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া তার সঙ্গে তখন কোন সাংবাদিক কথা বলতে পারেননি। কিন্তু ধর্মের কল যে নড়ে বাতাসে। পুরো বিষয়টি ফাঁস হয়ে ১/১১’এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। লা জবাব এই জজ মিয়া নাটকের জন্যে বিএনপি এখন দোষ দেয় পুলিশকে।
কিন্তু গ্রেনেড হামলার পরপর শেখ হাসিনার গাড়িতে গুলি বর্ষন, তড়িঘড়ি করে সব আলামত ধংস, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন এমন বক্তব্য দেয়া এবং সবশেষে জজ মিয়া নাটকের মাধ্যমে বিএনপি ঘটনার নেপথ্যে তার সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করেছে। যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবেনা এমন আইন পাশ, পরবর্তিতে বিচার আটকে দিয়ে সেই খুনেরও দায় দায়িত্ব মাথায় নিয়েছে বিএনপি। পচাত্তরের ১৫ আগষ্ট হত্যাকান্ডের সময় শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা বিদেশ থাকায় তাদের হত্যা করা যায়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ানোয় অতঃপর তারা শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা চালাতে বেছে নিয়েছিল আগষ্ট মাসটিকেই। এখন গনতন্ত্রের দাবিতে পেরেশান বিএনপি কেনো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এর জবাব ২১ আগষ্টে আছে। ট্রমা সেন্টারে আহতদের কাতর আহাজারি এখনও ভুলতে পারিনা। এসব নিরপরাধ মানুষের আত্মার আহাজারি কান্নার অভিশাপ এখন ভোগ করছে বিএনপি।
আমার একজন স্বজন আহত হয়েছিলেন সেই গ্রেনেড হামলায়। তখন তিনি চ্যানেল আই’র অন্যতম তরুন তুখোড় সাংবাদিক। ইনি অবশ্য সাংবাদিক হবার আগে থেকেই তাকে বেশ ভালো চিনি জানি। জনকন্ঠ অফিসে আমাদের তরুন সহকর্মী মামুনের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ওই সুযোগে আমাদের অনেক আড্ডা হতো। আমরা ভালো বন্ধু হয়েছিলাম। সাংবাদিক হওয়াতে সেই বিরূপ পরিস্থিতিতেও তিনি ভর্তি হতে পেরেছিলেন হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। খবর পেয়ে তাকে হাসপাতালে ছুটে গিয়ে তাঁর মতো একজনকে সেই শয্যায় শুয়ে থাকতে দেখে চোখ ভেসে যায় জলে। তিনি অবশ্য স্বাভাবিক কথা বলছিলেন। এরপর প্রায় প্রতিদিন হাসপাতালে তাকে দেখতে যেতাম। আমার এই স্বজন বন্ধুটির নাম আশরাফুল আলম খোকন। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি। সারা শরীরে স্প্রিন্টার নিয়ে তিনি এখনও স্বাভাবিক হাসেন। শেখ হাসিনাকে সার্ভিস দেন।
গ্রেনেড হামলার এমন আরেক নাম স্প্রিন্টার ভরা শরীর। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ সহ সেদিনের ঘটনায় আহত অনেকে শরীরে স্প্রিন্টারের যন্ত্রনায় ভুগতে ভুগতে এক সময় মারা গেছেন। অনেকে এখনও স্প্রিন্টারের যন্ত্রনা নিয়ে বেঁচে আছেন। যাদের সবার নাম আমরা জানিনা। সারা বছর রাখিনা তাদের খোঁজখবর। কিন্তু তাদের স্প্রিন্টারের যন্ত্রনাতো থামেনা এক মুহূর্তের জন্যে। এসবের ফল ভোগ করছে এখন বিএনপি। কারন মানুষকে ভোগান্তি দিয়ে মানুষকে লাশ বানিয়ে পৃথিবীর কোন রাজনৈতিক দল ভালো থাকতে পারেনা।