শেখ হাসিনার বিকল্প বামপন্থীদের সরকার!

আটটি বামদল রবিবার ঢাকায় গণতন্ত্রের কালো দিবস পালন করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে হাঙ্গামায় জড়িয়েছে। আহত হয়েছেন বেশ কিছু নেতাকর্মী। রক্তাক্ত যে সব ছবি দেখেছি তা ভালোলাগেনি। কারন চিরদিনের বিরোধীদল বাংলাদেশের বামপন্থীরা আমার কাছে অন্তত টেন্ডারবাজ-দুর্নীতিবাজ না। আজকের যুগের বাস্তবতায় তাদের একটি দুর্নীতি অবশ্য আছে। তাহলো সবার স্পষ্ট আয়সূত্র নেই। একসময় বাংলাদেশের বামপন্থী নেতারাও ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। আজকের অনেকের জীবন চাঁদায় চলে। বামপন্থীদের এখন বাংলাদেশে চাঁদা দেবার মতো বিস্তর লোকজনও নেই। এরশাদ আমলের একটা ঘটনা বলি। এক বামপন্থী নেতা এক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদার টাকা আনতে গেছেন। টাকা দিতে দিতে সেই ব্যবসায়ী বলছিলেন, আপনারা কোনদিন ক্ষমতায় যেতে পারবেননা, এরপরও টাকা দেই কেনো জানেন? ঢিলটা যাতে কখনো আমার অফিসের দিকে না মারেন! এরশাদ আমলে বাংলাদেশের বামপন্থীদের যে শক্তি ছিলো সে অবস্থাও এখন নেই। সিপিবি তখন আওয়ামী লীগের আটদলীয় জোটে ছিল। জাসদ-বাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি মিলে ছিল পাঁচদলীয় জোট। শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের নেতা নির্মল সেন যেদিন পাঁচদলীয় জোটের প্রেস রিলিজ লিখতেন সেটা থেকে নিউজ বানানো যেত সহজে। দাদা গুছিয়ে সংক্ষেপে আসল কথাটা লিখতেন।

রোববার ঢাকায় বামপন্থীদের মিছিলে পুলিশ যেভাবে পিটিয়েছে তাতে শুধু পুলিশকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশের পুলিশ সব সময় এভাবে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের পিটায়। আগেও পিটিয়েছে। এখনও পিটায়। আগামীতেও পিটাবে। পুলিশকে মানবিক হবার শিক্ষা দেয়া হয়না। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের উদ্দেশে উস্কানিমূলক আচরনও হয়। এরপর মুখস্ত বলা হয় পুলিশ শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা চালিয়েছে! রোববার আট বাম দলের  নেতারা যে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে মিছিল নিয়ে যাবেন সে অনুমতি কী তারা আগে নিয়েছেন? একটু আগে বক্তৃতায় বললেন অবৈধ প্রধানমন্ত্রী! তা অবৈধ প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কেনো যেতে চাইছেন? উস্কানিতো এখান থেকেই শুরু। আগে অনুমতি নেয়া থাকলে অন্তত একটা প্রতিনিধিদলকে সেখানে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা যেতো। এখন মিছিল নিয়ে সেখানে যাবার পথে পুরো এলাকাজুড়ে যে যানজট আরও জটিল হয়, মানুষের ভোগান্তির কথা কবে আমাদের রাজনীতিকরা ভাবতে শিখবেন? মানুষের এই ভোগান্তি নিয়ে আমাদের আওয়ামী লীগ-বিএনপি-বাম নেতাদের কেউ ভাবেননা।

আমি এখন যে দেশটায় থাকি এখানে অবশ্য এসব নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি এ রকম সহিংসও হয়না। রাজনৈতিক নেতাকর্মী সবাই এখানে কাজ করে খান। কাজ বাদ দিয়ে কেউ কোন কর্মসূচিতে যাননা। কারন একদিন কাজ না করলে সপ্তাহের বাজেটে যে টান পড়ে সেটাই সবার আসল উদ্বেগের বিষয়।  রোববারের হাঙ্গামার আগে এক সমাবেশে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন শেখ হাসিনার সরকারকে সরিয়ে বাম বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শুনে ভালো লাগলো সেলিম ভাই। কিন্তু বাংলাদেশে নিকট ভবিষ্যতে এর কোন সম্ভাবনাও নেই। একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন শুদ্ধ হয়নি, এরজন্যে প্রতিবাদ কর্মসূচিটি ছিল। নির্বাচন শুদ্ধ হলেও এই মূহুর্তে দেশে কোথাও বামপন্থীদের  কোন সংসদীয় আসনে বিজয়ী হবার মতো কোন সাংগঠনিক শক্তি নেই। বামপন্থীদেরও এখন এমপি হতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি জোটের দ্বারস্থ হতে হয়।

৩০ ডিসেম্বর নিয়ে বেশ কিছু রাজনৈতিক হুমকি পেয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এরমাঝে ডক্টর কামাল হোসেনরা বলেছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করবেন। প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করতে নাকি অনুমতি লাগেনা এমন কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু এই নেতারা রোববার ঘর থেকে বেরিয়েছেন এমন শোনা যায়নি। আসলে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের তৎপর নেতারা সবাই ছোটদলের বড় বড় নেতা। এদের সবার বয়স হয়েছে। তাই তাদের সবাই এখন মোটামুটি কাগুজে বাঘ। হুমকি ধামকি দিয়ে এরা বিএনপিকে চাঙ্গা করে আন্দোলনে নামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বিএনপির নেতারাও সবাই এখন বয়স্ক। মির্জা ফখরুল ধারাবাহিক কয়েকদিন গরম বক্তৃতা করলে দম নিতে চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর চলে যান। দম নিতে চিকিৎসার জন্যে প্রায় সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক যান ডক্টর কামাল হোসেন। সবাই দেশের চিন্তায় ঘুমাতে পারেননা। কিন্তু দেশের চিকিৎসায়ও তাদের কারও আস্থা নেই! আসল সত্য এরা এমনই গণবিচ্ছিন্ন।

বিএনপির আবাসিক একজন নেতা আছেন রুহুল কবির রিজভি। সত্য মিথ্যা জানিনা আমাকে একজন বলেছেন রিজভির ব্রিফিং  টেবিলে বসতে অনেকের খরচাপাতি লাগে! রিজভি রোববারের ব্রিফিং’এ  বলেছেন শেখ হাসিনা  ভয় পেয়ে তাদের সমাবেশের অনুমতি দেননি! আসলেই যেন শেখ হাসিনা সারাক্ষন রিজভির ব্রিফিং এর ভয়ে তটস্থ থাকেন-থরথর কাঁপেন! এটিও এক আবাসিক কাগুজে বাঘের কৌতুক বক্তৃতা আর কী! এর আগে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন তারা আর কখনও সমাবেশের অনুমতির জন্যে আবেদন করবেননা। তাহলে রোববার কী করেছেন? এপ্লিকেশন? আবেদন ছাড়া  কিছু করতে যা যা লাগে তা বিএনপি নেতাদের নেই।

বাংলাদেশের অনেক নেতা আজকাল প্রায় একটা কথা বলেন তাহলো গণতান্ত্রিক দেশে সভা সমাবেশের জন্যে অনুমতি নিতে হবে কেনো? সভা-সমাবেশ করার অধিকার মানুষের সাংবিধানিক অধিকার, ইত্যাদি। ডক্টর কামাল সহ এই কথাগুলো যারা বলেন তারা কিসের ভিত্তিতে এটি বলেন তা আমার মাথায় আসেনা। আমি একটি গণতান্ত্রিক দেশে থাকি। এখানে সভা-সমাবেশ-প্রতিবাদ কর্মসূচি সবকিছুর জন্যে আগেভাগে পুলিশের অনুমতি নিতে হয়। এমন কর্মসূচিতে কতজন লোক আসবেন, তাদের বয়স কী রকম হতে পারে, তাদের হাতে কোন ব্যানার-প্ল্যাকার্ড থাকবে কিনা, ব্যানার-প্ল্যাকার্ড থাকলে সেগুলোয় কী লেখা থাকবে সে ভাষা পর্যন্ত পুলিশকে আগেভাগে জমা দিতে হয়। এরপর পুলিশ অনুমতি দিলেও নানান শর্ত জুড়ে দেয়। এর অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে কোন অবস্থায় রাস্তায় স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল তথা মানুষের পথ আটকানো যাবেনা। আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েমে গিয়ে আপনি আরেকজনের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করতে পারেননা।

অস্ট্রেলিয়ার পার্থে কমনওয়েলথ সম্মেলন যখন হয় তখন সিডনি থেকে বিএনপি নেতারা প্রতিবাদ জানাতে পার্থে যেতে চেয়ে পুলিশের অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তখন অনুমতি দেয়নি। পুলিশের পক্ষে তখন বলা হয় কমনওয়েলথ সম্মেলনে যত সরকার প্রধান পার্থে এসেছেন এত সরকার প্রধানকে প্রটোকল দেবার মতো পুলিশ পার্থে নেই। সে জন্যে তারা নিউজিল্যান্ড থেকে পুলিশ হায়ার করে এনেছেন। এখন বিএনপির প্রতিবাদ সমাবেশ পাহারা দেবার মতো আরও পুলিশ হায়ার করে আনতে পারবেননা। পার্থ সিডনি থেকে বহুদূর। বিমানে যেতে সাড়ে চার ঘন্টার মতো লাগে। বিমানে যাওয়া আসার ভাড়াও পাঁচশ ডলারের বেশি। অতঃপর পুলিশের অনুমতি নিয়ে সিডনির হাইড পার্কে প্রতিবাদের আয়োজন করা হয়। কিন্তু কাউকে রাস্তায় নামার অনুমতি দেয়া হয়নি।

সর্বশেষ শেখ হাসিনা যখন সিডনিতে এক আন্তর্জাতিক পদক গ্রহনের জন্যে আসেন তখন পুলিশের অনুমতি নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে প্রতিবাদ প্রদর্শন করা হয়। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে যেখানে ছোটবড় সব শহরেই যানজট এখন ভয়াবহ এক ব্যাধি সেখানে আইন করে রাস্তা বন্ধ করে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করা দরকার। এটা শুনতে অনেকের খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু একদিন এসব করতে হবে। সভা-সমাবেশ হতে পারে মিলনায়তনে-পার্কে, কিন্তু তা কোনভাবে রাস্তায় তা যাতে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত না ঘটায়। অস্ট্রেলিয়ায় পার্কে কেউ কোন অনুষ্ঠান করলে অনুষ্ঠান শেষে তা নিজ খরচে গোটা এলাকাটিকে ক্লিন করে দিতেও হয়। মিলনায়তনে অনুষ্ঠান করলে ভাড়ার সঙ্গে আগাম দিতে হয় ইন্সুরেন্স ফীও। যদি কোন কারনে মিলনায়তনের কোন রকম ক্ষতি হয়।  এখন আওয়ামী লীগ যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে, আমি এরও বিরোধিতা করি। কারন উদ্যানগামী মিছিলের কারনে আশেপাশের সবগুলো রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ মাঝেমধ্যে বলার চেষ্টা করে ছুটির দিন দেখে তারা সমাবেশ করে। কিন্তু ছুটির দিনে কী সবার ছুটি থাকে? মানুষের ভোগান্তি বুঝতে যদি সরকারি দল দায়িত্বশীল না হয় তাহলে তা যে তালগাছ আমার তত্ত্ব হয়ে যায়। এটি অন্যায়।