সিডনিবাসী শতাধিক প্রিয় প্রজন্মের জন্যে এবারও ঈদের খাবার রান্না করেছিলেন আলোচিত তুলি ভাবী। অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশুনা করতে আসা এসব ছেলেমেয়ের এদেশে মা-বাবা নেই। সে ফিলিংস থেকে প্রতি ঈদে তুলি ভাবী, তার স্বামী আমাদের প্রিয় আনোয়ার ভাই এই ছেলেমেয়েদের মা-বাবা’র ভূমিকা নেন। ঈদের নামাজ পড়ে সবাই তাই দলবেঁধে ছোটেন তুলি ভাবীর বাড়িতে। সিডনির লাকেম্বার কিগ স্ট্রিটে এ উপলক্ষে এদিন পার্কিং সংকট দেখা দেয়। এ এক অন্য অনুভূতি। এবার কিছু মেহমান দাওয়াত করা হয়েছিল এ উপলক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার ছাত্রলীগের দাপুটে নেতানেত্রী আবু তারিক-সেলিমা দম্পতি, এভারেষ্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহিম স্ত্রী সন্তান সহ এসেছিলেন। মুসার স্ত্রী এদেশে আইনে পিএইচডি করছেন। প্রবাসী কম্যুনিটির মুরব্বি নেতা গামা আব্দুল কাদির ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারনে আসতে পারেননি। ফোন করে দূঃখ প্রকাশ করে বলেছেন আপনার তুলি ভাবীকে একদিন দেখতে যাবো। এমন একজন মহিয়সী নারী যিনি কিনা বছরের পর বছর ধরে এভাবে বাংলাদেশি প্রিয় প্রজন্মদের ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছেন তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আমার একদিন দেখতে যাওয়া দরকার।
এদেশে আমাদের ঈদ মানে ক্লাস-কাজের ফাঁকে টুপ করে এক সুযোগে নামাজে যাওয়া, নামাজ শেষে সম্ভব হলে প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করা। এরপর আবার ফিরে যাওয়া কাজে বা ক্লাসে। সিডনির বাংলাদেশি এলাকা লাকেম্বার প্যারি পার্ক ঈদের নামাজের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্য। ২০০০ সালে সিডনিতে অলিম্পিক আসর আয়োজন উপলক্ষে শহরজুড়ে গড়া হয় নানান ক্রীড়া স্থাপনা। প্যারি পার্কের ইনডোর স্টেডিয়ামটি তখনই গড়া হয়। এটি এখন স্থানীয় বাসিন্দা মুসলমানদের ঈদের জামাত উপলক্ষেও কাজে লাগে। শীত-বৃষ্টির দিনে ঈদের জামাত হয় ইনডোর স্টেডিয়ামের ভিতরে। এদেশের রাজনীতিবিদরা আবার ঈদের জামাতকে কেন্দ্র করে এমন রেডিমেট জনসমাবেশে শুভেচ্ছা বক্তৃতা দেবার সুযোগ হাতছাড়া করেননা। প্রতি ঈদের মতো এবারও ঈদের জামাতে শুভেচ্ছা বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন এলাকার ফেডারেল এমপি টনি বার্ক এবং লাকেম্বা আসনের রাজ্য সংসদের এমপি জিহাদ দিব।
আমি যখন অস্ট্রেলিয়া আসি লাকেম্বার হেম্পডেন স্ট্রিটে আমার বোনের বাসার নিচতলায় থাকতেন রোকসানা চৌধুরী তুলি ভাবী। পরিচয়টা সেভাবেই। অস্ট্রেলিয়ায় কারও পাসপোর্ট সত্যায়নে প্রথম শ্রেনীর গেজেটেড কর্মকর্তার বাধ্যবাধকতা নেই। যে কোন নাগরিক এটা করতে পারেন। শুধু শর্ত, সত্যায়নকারী নিকটাত্মীয় এবং এক ছাদের নিচের বাসিন্দা হতে পারবেনা। তুলি ভাবী আমার প্রথম পাসপোর্টটি সত্যায়ন করেন। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে সেখান থেকে। এরমাঝে তিনি হ্যাম্পডেন স্ট্রিটের ভাড়া বাসা ছেড়ে কিগ স্ট্রিট নর্থের কেনা বাসায় থিতু হয়েছেন। আমরা এখন পারিবারিক সদস্যের মতো। উৎসবে পরষ্পরের বাড়িতে যাই। এখন তার বাড়িটি আমার প্রিয় প্রজন্মদের অন্যতম ঠিকানাও।
বিদেশের জীবনে মেহমান পাওয়া কঠিন এক সৌভাগ্য। সবাই যার যার কাজ-ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত। প্রতি ঈদে তুলি ভাবী এই ছেলেমেয়েদের জন্য বিস্তর আয়োজন করেন। কিন্তু অনেকেরই শেষ পর্যন্ত গেটটুগেদারে শরীক হওয়া আর হয়না। প্রিয় প্রজন্ম সৌমিত্র রোববার রাতে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে জানালো, ভাই কাল দিনের বেলায় জব পড়ে গেছে। রাতেও আরেকটা কাজ আছে। আবারও আসা হলোনা। মুন্না ক্ষুদে বার্তায় লিখেছে, ভাই কালকে আপনাদের সঙ্গে নামাজ পড়ে তুলি ভাবীর বাসায় যাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু ভাগ্য খারাপ। কালকে কাজ পড়ে গেছে সকাল পাঁচটা থেকে।
মাশফি-সালমান সহ আরও অনেকে ক্লাস-কাজের জন্যে আসতে পারেনি। আমি আবার আমার এই ছেলেমেয়েদের সব সময় বলি ক্লাস ফার্স্ট, জব ফার্স্ট। এরপর অন্য কিছু। প্যারি পার্কের ইনডোর স্টেডিয়ামে ঢুকে আবার মোবাইল ফোন সাইলেন্ট মুডে রাখতে হয়। অবিরাম ফোন বা ম্যাসেজ আসতে থাকে। ভাই আপনে কোন দিকে আছেন। স্টেডিয়ামের ভিতরে না বাইরে। নামাজ শেষে আবার অবিরাম ফোন। ভাই আপনে কোনদিকে। একটু হাত তুলে ইশারা দেন ভাই। আজ ফয়সল-মেহেদি এদের খুঁজে পেতে এমন অনেক সময় লেগেছে। ফয়সলের ফ্রেন্ড সীমান্ত পড়াশুনা করতে সিডনিতে নতুন এসেছে কুড়িদিন হয়। দেখা হতেই বললো ভাই ঘুম থেকে উঠে পরনে যা ছিল সেভাবেই দৌড়ে নামাজে এসেছি। একটু সময় দেবেন ভাই। এক দৌড়ে পাঞ্জাবিটা পরে আসি। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ঈদ। আমার প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কটা এমনই।
বাংলাদেশ বিমানের সাবেক ইন্টার্নি এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার নাফিজ পড়াশুনা করেছে মালয়েশিয়ায়। সিডনির ইউটিএস’এ মাস্টার্স করতে এসেছে কিছুদিন হয়। এসেই নাফিস ফোন দেয় চাকরির জন্যে। আমি তাকে বলি ঈদের দিন তুলি ভাবীর বাসার প্রোগ্রামে আসো। অনেকে আসবে। ভাগ্য ভালো হলে একটা চাকরি হয়ে যাবে। এমন চাকরিদাতাদের একজন প্রিয় প্রজন্ম ফেরদৌস। তার রেস্টুরেন্টের চাকরিতে ক্লিন সেভড ছেলেদের বিবেচনা করা হয়। ফেরদৌসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম নাফিসকে। চাকরি চাইলাম। কিছু বললোনা। আরেক নতুন মেহেদিকে দেখেই ফেরদৌস নিজের থেকে বললো, জব লাগবে? মেহেদি ঢাকার পিজির ডাক্তার ছিল। এখানে পড়াশুনা করতে এসেছে। ক্লিনসেভড ছিল মেহেদি। ছেলেদের তাই বলি, নিজের উপস্থাপনাও প্রথম চাকরি পাবার জন্যে গুরুত্বপূর্ন। ছোটছোট ছেলে। চাকরিদাতার যেন প্রথম দর্শনে ছোটভাই বা ছেলে মনে করে মায়া হয়। আজকাল অনেক ছেলেপুলের মাথায় ঢুকেছে দাঁড়ি রাখলে সিনিয়র দেখায়। আন্ডারএইজড মনে হয়না। অনেকের মেয়ে বন্ধুরা সম্ভবত এমন ধারনা দেয়। কিন্তু মেয়ে বন্ধুতো চাকরি দেয়না।
তুলি ভাবীর বাসার ঈদের গল্প শুনতে শুনতে কিউরিয়াস সেলিমা-তারিক দম্পতি আমন্ত্রন পেয়ে আজ উৎসব দেখতে চলেই এসেছিলেন। এই দু’জনেই এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দাপুটে নেতৃত্বে ছিলেন। সিডনিতে এরা অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে লেবার পার্টির সঙ্গে সক্রিয়। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার এমপি মোসলেম উদ্দিনের মেয়ে সেলিমা সিডনিতে বাংলা শিক্ষা, বাংলা গান-কবিতার প্রসারে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখে চলেছেন। সিডনির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলে ঈষান-ঐহিকের বাংলা গান, কবিতা আবৃত্তি শুনে আমি অভিভূত হই। এমন বাচ্চার সংখ্যা খুব কম সিডনিতে। হাতেগোনা যাবে।
স্কুল হলিডের সুযোগে ছেলেদের নিয়ে প্রতিবছর দেশে যান সেলিমা। এবার দেশে যাবার পর বড় ছেলে ঈষান কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুটিং করতে গিয়েছিল। স্কুলের এক্সট্রা ক্যারিকুলাম হিসাবে সে এ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি জমা দেবে। কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার পর এক ট্র্যাজেডির শিকার হন সেলিমা। তাদের ছোট ছেলে ঐহিকের ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপর থেকে যতদিন বাংলাদেশে ছিলেন ছোট ছেলেটিকে নিয়ে হাসপাতালেই কাটাতে হয়েছিল সেলিমাকে। বড়ছেলেটিকেও ঢাকায় নানার বাসায় এক রকম গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এরমাঝে স্কুল খুলে যাওয়ায় পনের বছর বয়সী বড় ছেলেটি একা একা সিডনি চলে আসে। এ ঘটনাকে আমি এপ্রিসিয়েট করেছি। বড় সাধ নিয়ে একজন মায়ের দেশে বেড়াতে যাওয়া, সেখানে ছেলের ডেঙ্গু ধরা পড়ার ঘটনা নিয়ে আমি লিখেছিলাম। প্রিয় দেশটা বড় বিপদজ্জনক হয়ে উঠেছে। এরপরও কত আশা নিয়ে আমরা দেশে যাই।
আজ আমাদের ঈদ পার্টিতে সেলিমার ছেলের দেশে গিয়ে ডেঙ্গু ধরা পড়ার বিষয়টি উঠেছিল। সেলিমা বলেন তার ঐহিক এরপরও দেশে যাবে। তাদের মতো তাদের ছেলেরাও দেশে যাওয়াটাকে খুব পছন্দ করেন। এই ভালোবাসার নামটিইতো জন্মভূমি বাংলাদেশ। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
আমাদের ঈদ উৎসবে অনেকদিন পর একসঙ্গে এসেছে শাওন-মীম-অপু। পাঁচ বছরের বেশি আগে খুলনার ছেলে শাওনের সঙ্গে পরিচয় বন্ধুত্ব ফেসবুকে। তার সূত্রে মীম আমার কাছে আসে। শাওন পড়তে এসেছে পরে। এরপর আসে শাওনের মামাতো ভাই অপু। পড়াশুনা শেষে এরমাঝে অভিবাসন হয়ে গেছে মীমের। শাওন-অপুর অভিবাসন সংগ্রাম এখনও চলছে। এমন ছেলেমেয়েদের নার্সিং’এ আমি ছোটছোট কিছু দাগ রেখে যাই। যেমন আমার বাসার ডাইনিং টেবিলটি শাওনের অস্ট্রেলিয়া আসা উপলক্ষে কেনা। এ ঘটনা প্রায় মনে পড়ে। ছোট ছোট ছেলেগুলো চোখের সামনে কত বড় হয়ে যাচ্ছে। তিনজনই এরমাঝে দেশে গিয়ে বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়ায়। এরমাঝে মীমের স্ত্রী এসেছে তার অভিবাসনের পর। অভিবাসন নিয়ে।
আমারদের উৎসবে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো যোগ দিলেন মুসা ইব্রাহিম। স্ত্রীর পড়াশুনা উপলক্ষে এখন সিডনিতে থাকেন মুসা। তাদের ছোট্ট ছেলেটি দিনে দিনে বড় হয়ে যাচ্ছে। মুসা এলে খুশি হয় আমার প্রিয় প্রজন্ম বাহিনী। অশেষ কৃতজ্ঞতা মুসা। জিপিএ ফাইভ কৃতজ্ঞতা অবশ্য প্রাপ্য তুলি ভাবী-আনোয়ার ভাইর। প্রতিবার ঈদে তারা নতুন কিছু আইটেম যোগ করেন। যেমন এবার পোলাও চিকেন-বিফের পাশাপাশি নেহারি-রুটিও ছিল। স্পেশাল একটা চাটনি ছিল চালতা দিয়ে বানানো। মিষ্টান্নগুলোও ছিল বেশ মুখরোচক। আমার ছেলেমেয়েরা অনেক মজা করে খেয়েছে প্রিয় তুলি ভাবী-আনোয়ার ভাই। অনেক ভালোবাসি। সবাইকে ঈদ মুবারক।