ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য অপেক্ষা থাকে সব সময়ই। কারণ প্রাণের মেলা বই মেলা হয় এই মাসে। সেই মত এবারেও সেই মাস এলে দেশে যাই। এবারে যাওয়াটা ছিল অন্য রকম। এবারে প্রথমে গেলাম ওমরাহ্ করতে মক্কা শরীফ , মদিনা ঘুরে ওমরাহ্ শেষ করে আমার সোনার দেশ বাংলাদেশে গিয়ে পৌঁছালাম ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০তে।
এবারে আমার তিনটে বই আসবার কথা থাকলেও দুটো এলো আর আমার বর মূনির হোসেনের প্রথম বই ‘নির্বাচিত জোকস’ প্রকাশিত হোল।
সারাটা বইমেলা কি যে আনন্দে উল্লাসে কেটেছে তা প্রকাশের ভাষা নেই। জাপান থেকে আসা ছোট ভাইয়েরা আর দেশের ভাই বোনদের সাথে তুমুল আড্ডা আর খানাপিনার এক রাজকীয় উৎসব চলেছে দিনের পর দিন।
এত এত ভালবাসা আর সম্মান পেয়ে নিজেকে বার বার শুধিয়েছি আমি কি এই এত ভালবাসা পাবার যোগ্যতায় যেতে পেরেছি! কে জানে।
২৯ ফেব্রুয়ারি বই মেলা শেষে গেলাম কলকাতা সেখান থেকে শান্তি নিকেতনে।আমার মিতা দিদির সাথে কাটানো দিনগুলো জমে থাকবে আমার গহীনে আনন্দের নাম হয়ে আজীবণ।
কলকাতা থেকে আবার ঢাকায় ফিরে এলাম ৫ মার্চ ২০২০ কারন আমাদের অস্ট্রেলিয়া ফিরে আসার তারিখ ছিল ৯ মার্চ ২০২০।
৭ মার্চ ২০২০ তে দেখা করতে গেলাম আমার ভাই কবি কামাল চৌধুরীর সাথে তাঁর বর্তমান কর্মস্থল মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে । যিনি বর্তমানে মুজিব জন্মশত বার্ষিকীর প্রধান আহবায়ক এবং প্রাক্তন মুখ্য সচিব।
অনেক অনেক গল্প চা নাস্তা পর্বের পর কামাল ভাই জানালেন ১৭ মার্চের আয়োজনের কথা যেখানে প্রায় লক্ষাধিক দেশী বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথিদের সমাগম হবে আর আমি সেই মহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী না হয়ে কেন চলে যাব। আমার আর মূনিরের নামে আমন্ত্রণ পত্র প্রদানের নির্দেশ করা হোল আর আমাদের ফেরার টিকেট তারিখ বলদে ২২ মার্চ ২০২০ করা হোল।
তারপরের ঘটনা দুনিয়া জানে সেই অলৌকিক এবং অনভিপ্রেত অদ্ভুত অদৃশ্য এক মহামারির কথা যা ডিসেম্বর ২০১৯ থেকেই চায়নাতে সংক্রামন ছড়াচ্ছিল এবং কেড়ে নিচ্ছিল অসংখ্য প্রাণ। তাবৎ পৃথিবী আসলে অতটা আমলে নেয়নি এই ভাইরাসের আক্রমণ সবাই ভেবেছিল এটা বুঝি শুধু চায়নাতেই সীমাবদ্ধ আছে বা থাকবে অথবা কতটা মারাত্মক এর সংক্রামণ।
কিন্তু কালে কালে সেই করোনা ভাইরাস তার বিষাক্ত ফণা তুলে ছোবল দিতে শুরু করল সারা দুনিয়ার আনাচে কানাচে। চোখের পলকে বদলে যেতে থাকলো আমাদের খুব চেনা পৃথিবীর রঙ।নিভে যেতে থাকলো অসংখ্য তাজা প্রানের আলো। বড় করুণ সেই চলে যাওয়া। সহ্যের বাইরে এ মৃত্যু সহ্য করা। তবুও আমরা খুব ভীষণ অসহায় এবং একে মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই এই মুহূর্তে। নেই এর প্রতিকারের পথ্য। নেই একে হটিয়ে দেবার মন্ত্র।
আমাদের ফেরার টিকিট ছিল সিংগাপুর এয়ারলাইন্সের সাথে কিন্তু সিংগাপুর এয়ারলাইন্স তাদের সব ফ্লাইট বাতিল করে দিল ২০ মার্চ ২০২০ থেকে।
আমরা তখনো দাওয়াতের পর দাওয়াত খেয়ে আর আনন্দ করে বেড়াচ্ছি কোন ধারণাই তখনও জন্ম নেয়নি যে বাংলাদেশেও আসছে ভয়াবহ এই করোনার বিষাক্ত ছোবল।
আমাদের দুই ছেলেই অস্ট্রেলিয়াতে তারা সারাক্ষণ উদগ্রীব আর উৎকণ্ঠায় তাদের দিন রাত পার করে। তাদের ঘুম নেই খাওয়া নেই কারন বাবা মা দুজনেই অনেক দূরে আর কবে তারা ফিরতে পারবে তার কোন সুনির্দিষ্ট সময়সীমা কেউ জানিনা।
আমার বর মূনিরের হার্টের সমস্যা । মূনিরের হার্টে ৯ টা রিং আর ৬টা বেলুন লাগানো আছে। আমি নিজে উচ্চ রক্তচাপের রোগী। আমাদের দুজনেরই ওষুধ প্রায় শেষের পথে কারণ দেশে থাকার কথা ৩ সপ্তাহ সেই হিসেবে ওষুধ নিয়ে গেছি মাস খানেকের মত। বাচ্চাদের বুঝতে দেইনা যে আমাদের ওষুধ কতটা দরকার।দেশী ওষুধ কিনেছি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়েই কিন্তু তা আসলে ঠিক মত কাজ করেনা কারণ বড় দীর্ঘ দিন আমাদের শরীর অভ্যস্ত হয়ে আছে অস্ট্রেলিয়ার ওষুধে।
২৪ মার্চ যখন সিংগাপুর এয়ারলাইন্স তাদের ফ্লাইট বাতিলের সময় সীমা বাড়িয়ে নিয়ে গেল আরও মাস খানেক দূরে তখন সত্যি হিম হয়ে এলো আমার ইন্দ্রিয় আমার মণ বাড়ীর সবকটা বাতি যেন ভিভে যেতে শুরু করল।
সেই রকম হম হয়ে যাওয়া এক দুপুরে আমাদের বড় বাবু হাসিনের টেক্সট এলো , সে লিখেছে , ‘আর মনে হয় তোমাদের সাথে আমাদের দুই ভায়ের দেখা হবে না’ সারাজীবনের নরম হৃদয়ের মানুষ আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি , কিছুখন পর আমার বাবু ফোন করে আর সেই ফোনে তার কান্নার শব্দ আমাকে ঘুমুতে দেয়নি যে কটা দিন দেশে ছিলাম অস্ট্রেলিয়া ফেরা তক। পুরো ছয় ঘন্টা আমার বাবুটা কেঁদেছে আর তার ফলে সে ডিহাইড্রেট হয়ে গেছিল। আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আমার ভেতরের আমি ঝুপ করে মরে গেল।
পুরো দুটো দিন অবশ নির্জীব থাকার পর কেউ কানে কানে বলে গেল শক্ত হও, ঘুরে দাঁড়াও, বাচ্চাগুলো কাঁদছে, শক্তি নিয়ে কাজ করো ওদের কাছে ফিরে যেতে হবে।যেতেই হবে তোমার।
অবাক হয়ে বুঝলাম সেই ফিস ফিসের শক্তি কতটা যা সারাজীবনেই আমাকে উঠে দাঁড়াতে শিখিয়েছে কিন্তু এই যে আমি সেই ২০ মার্চ থেকে চোখে কাজল দেইনি কই এক বারও তো কেউ ফিস ফিস করে বলে নি ‘তোমার চোখে কাজল নাই কেন বাপ’ যেটা আমার মন খারাপের সময় সব সময়ই বলে যায় আর আমি কাজল পরে নেই দ্রুততায়।
তার মানে এই যে করোনা কাল এই সময়ে তিনিও ছেয়ে আছেন এক ধূসর বিষণ্ণতায়। তিনিও হয়ত মগ্ন আছেন নীরব এক প্রার্থনায়।
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। উঠে বসলাম এবং শুরু করে দিলাম আমার কাজ।
মূনির সারাক্ষণ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে কথা বলেই যাচ্ছে কিন্তু কোন কিছুই খোলা নেই যাচ্ছেনা কেউ আকাশের বুক চিরে। মূনির ফেস বুকের মাধ্যমে একটা বেশ শক্তিশালী দল বানিয়ে ফেলেছে তাদের নিয়ে যারা আটকে আছে আর ফিরে যেতে চাইছে অস্ট্রেলিয়ায়।
সারাদিন কত শত জন ফোন করছে ইমেইল করে পাঠাচ্ছে তাদের পাসপোর্ট কপি ভিসা কপি আর আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ইমেইল করে যাচ্ছি একের পর এক।
প্রথম ইমেইল করেছি আমাদের অস্ট্রেলিয়ার প্রধান মন্ত্রী স্কট মরিসন’কে আর আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই প্রধান মন্ত্রীর দফতর থেকে উত্তর এলো যে, তারা আমার ইমেইল পেয়েছে এবং তা প্রধান মন্ত্রীর সমীপে পেশ করা হয়েছে আর তারা তাদের দিক থেকে যা করার করছে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছে এই ইমেইলের জন্য।
আমি আবার ইমেইল করি পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে আর ইমেলের সাথে পাঠাই আমাদের কাছে পাঠানো সকলের তথ্য, ইমেল করি আমাদের ক্যানবেরার মুখ্য মন্ত্রীকে , বিরোধী দলের নেতাকে , আমাদের খুব ভাল বন্ধু একজন সিনেটরকে , আমাদের আরেক বন্ধু মুখ্য মন্ত্রীর ডায়রেক্টরকে , ইমেইল করি ক্যানবেরা টাইমসে আমাদের ভাল বন্ধু এক সিনিয়র রিপোটারকে।
তারপর আমি সিডনিতে আমার এক ছোট ভাই আবু তারেক কে বলি আমাদের নিয়ে একটা নিউজ করতে। আমি সিডনিতে আতিকুর রহমান ভাইকে বলি উনার প্রশান্তিকা পেপারে একটা নিউজ করতে। আনিসুর রহমান ভাইকে বলি উনার অনলাইন বাংলা সিডনিতে নিউজ করতে , আনিস ভাই বলেন এই সব বাংলা অনলাইন বা পত্রিকার নিউজে কিছু হবেনা আইভি আপা, আপনি প্রধান মন্ত্রী আর পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে লিখেন।উনি আমাকে একটা লিংকও পাঠিয়ে দেন। তখন খানিকটা জমে থাকা আমার ভেতরে কিছুই কাজ করছিল না আমি শুধু শুনে যেতে থাকি সবার কথা কিছু বলতে গেলে উত্তর দিতে গেলেই কান্না গলার ভেতরে হাউমাউ করে ওঠে। আমার মনেও থাকে না কি বার বা কোন তারিখে চলছে ক্যালেন্ডারের পাতায়।
আমি যাদের যাদের ইমেল করেছি সবাই উত্তর দিয়েছে। জানিয়েছে, তারা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবে আমাদের ফিরিয়ে নিতে যা করণীয় করার। আমাদের খুব ভাল বন্ধু সিনেটর জানিয়েছে তার ভাই আর ভায়ের বঊ মুম্বাইতে আটকে পড়েছে তাদেরও ফিরে যাবার কিছু হয়নি, তবুও সে আমাদের জন্য লিখবে যথাযথ বিভাগে।
এর মধেই ঢাকাস্থ হাইকমিশন থেকে ইমেল পেলাম যে আমার প্রেরিত সব ইমেলের প্রেক্ষিতে তাদের কাছে অস্ট্রেলিয়ান প্রধান মন্ত্রীর দফতর থেকে নির্দেশের ভিত্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে নির্দেশ এসেছে আমরা যারা আটকে আছি তাদের তালিকা প্রস্তুত করতে। ওই ইমেলের আমাকে একটা স্প্রেডশিটও পাঠানো হয়েছিল যাতে আমাকে বলা হয়েছে আমার আর মূনিরের যাবতীয় তথ্য প্রদান করতে।
দম আটকে আটকে যা যা করার করেছি আর চোখের পানিকে বলেছি ফিরে যাও প্লিজ এখন আমার কান্নার সময় নেই এখন অনেক কাজ করার সময় কারণ আমার বাচ্চাগুলো কাঁদছে। সাথে কাঁদছে আমার মতই আটকে পড়া আরো কতশত জনের আপন জনেরা। তারা মাঝে মাঝে ফোন করছে মূনিরকে আতংকিত হয়ে তারাও জানতে চাইছে কি হবে, ফিরে যেতে কি পারব, কবে হবে, এই সব।
হাইকমিশনের অফিসারদের সাথে মূনিরের নিয়মিত কথা হতে থাকলো , জানতে পারলাম আসলে আমাদের আটকে পড়া বাংলাদেশী-অস্ট্রেলিয়ানের সংখ্যার পরিমাণ প্রচুর। প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ জনের মত এর মধ্যে আছে অনেক অনেক বাচ্চা। আছে বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ।
এর পর শুরু হয়েছে রেজিস্ট্রেশন পর্বের। অনেকেই প্যানিক হয়েছে, কান্নায় ভেঙে পড়েছে যারা দেরীতে রেজিস্ট্রেশন করেছে এবং তার ফলে তাদের কাছে ইমেল আসেনি টাকা জমা দেবার জন্য।
টাকা জমা দেয়া নিয়েও চলেছে এক ভয়াবহ অধ্যায় কারন শ্রীলংকা এয়ারলাইন্স বলে দিয়েছে ইমেলের মাধ্যমে টাকা জমা দেবার নির্দিষ্ট এক ব্যাংকের নাম আর তাদের শর্ত সমুহ। সেই ব্যাংকে অনেকেই টাকা জমা দিতে পারেনা প্রথম পর্যায়ে কারণ বাংলাদেশে তখন শবে বরাতের ছুটি , তারপর শুক্রবার , শনিবার ব্যাংক বন্ধ। এয়ারলাইন্স ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট নেবেনা। অনলাইন ট্র্যান্সফার করা যাবেনা এই রকম সব শর্তাবলী।
আমাদের কপাল ভাল কারণ আমাদের ভাতিজা রিয়াদের একাউন্ট ছিল একই ব্যাংকে সে তার একাউন্ট থেকে সরাসরি ট্র্যান্সফার করে দেয় আমাদের টিকিটের টাকা।
এর মধ্যেই আবার ফোনের ঝড় বয়ে যায় মূনিরের কাছে অনেকে প্রকাশ্যে কান্না করে কি করবে এই অবস্থায় তা জানতে। আমি নিজে তাদের টেক্সট দেই যে হাই কমিশনে ইমেল করে যেতে যে এই রকম একটা অবস্থায় তাদের সময় দিতে হবে কারন বেশ কিছু জায়গা লকডাউনের আওতায়ও ছিল। কেউ কেউ ঢাকার বাইরে ছিল। কয়েকজন ইমেইলের উত্তর পেয়ে আবার আমাকে জানায় যে হাইকমিশন বলে দিয়েছে তাদের কিছু করার নেই। আমি বলি আবার ইমেইল দিতে বার বার ইমেইল করতে এবং খুশীর কথা যে এত এত ইমেল পেয়ে তাদের সময় প্রদান করা হয়েছে আর তারা টাকা জমা দিতে পেরেছে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পরেও।
আমি নিজেও দুবার ইমেল করেছি সবার জন্য যেন তাদের সময় দেয়া হয় টাকা জমা দেবার, তারা সত্যি ফিরে যেতে উন্মুখ এবং ছোট বাচ্চা নিয়ে তারা খুব অস্থির আছে।
যাই হোক বহু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ২৯০ জন টাকা জমা দিতে সক্ষম হয় হাই কমিশন সময় বাড়িয়ে দিলে।তারপর এলো সেই দিন ১৬ এপ্রিল ২০২০। আমাদের বলা হয়েছে ৫ ঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে। গাড়ীর জন্য পাস প্রদান করা হয়েছে যাতে যাত্রীদের নামিয়ে যাবার সময় ড্রাইভারদের বা আত্মীয়দের কোন সমস্যা না হয়।
আমাদের জন্য মূনিরের বন্ধু বাবু ভায়ের গাড়ী তৈরি ছিল কিন্তু এর মধ্যে আমার খুব ভাল বন্ধু আদিত্য নজরুল ফোন করে খবর নিতে যে , এয়ারপোর্টে কি ভাবে যাচ্ছি, সে তার দফতরের গাড়ী নিয়ে যেতে বলল কারন টেলিভিশনের গাড়ীতে হয়ত তেমন কোন সমস্যা হবে না যা প্রাইভেট গাড়ীতে হতেও পারে।
আমরা সময় মতই এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। বিশাল লম্বা লাইনের বহর পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশের পর চেক ইন কাউন্টার থেকে জানায় আমাদের জমজম পানির প্যাকেট নেয়া যাবেনা!
মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা হয় কারণ পবিত্র পানির দুটো বোতল নিয়ে এসেছি ওমরাহ করে আসার সময় যার একটার (৫ লিটার) পুরোটাই দেশে আত্মীয় আর বন্ধুদের দিয়েছি আর একটা বোতল নিয়ে যেতে চেয়েছি আমার বাচ্চাদের জন্য সেটাও নিতে দেবেনা!
ভাগ্য ভাল হলে যা হয় আদিত্যর জি টিভির গাড়ীর ড্রাইভার লিটন আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলেছে সে অপেক্ষা করবে যদি কিছু লাগে বা সমস্যা হয়। সাথে সাথে লিটনকে ফোন দেই সে বলে কোন সমস্যা নাই সে আছে কার পার্কে কি এক স্বস্তির হাল্কা নিশ্বাস বুকের ভেতরে বয়ে যায় কারণ লিটন না থাকলে আমাকে এই পানি ফেলে দিয়ে যেতে হোত আর তা হলে নিজের ভেতরে কেমন এক অপরাধবোধ আর অনুশোচনা কুরে কুরে খেয়ে ফেলত আমায় বাকি জীবন টা কারণ কত জন পায়না এই পানি, কত জন খোজে কই পাওয়া যায় জম জমের পানি, আর আমি নিজে আল্লাহর ঘর থেকে নিয়ে এসেও ফেলে দিয়ে যেতে বাধ্য হবো! আল্লাহ সত্যি মহান এবং তিনি আমার সাথে আছেন।
ঢাকা এয়ারপোর্টে দেখা হয়ে গেল ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ার এর সাথে তিনি ক্যানবেরিয়ান মূনির কে দেখে খুব খুশি হয়েছেন মূনির কে চেনেন আগে থেকেই। কতটা দায়িত্ববান হলে মানুষ এই রকম সময়ে এই পদক্ষেপ নিতে পারে ভাবলাই মন ভরে যায় শ্রদ্ধায় ভালবাসায়। আমার জমজমের পানি অধ্যায়ের জন্যও হাইকিমশনার খুব আফসোস করলো আর বলল তুমি ভাগ্যবান ড্রাইভার আছে তার হাতে দিয়ে দাও। আমি যখন পানির বাক্সটা ড্রাইভারের কাছে দিতে গেলাম তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আমাদের দেশে কি কোনদিন এমন বোধ সম্পন্ন মানুষ হবে- আদৌ কোন দিন!
দেখা হয়েছে পররাস্ট্র সচিব মাসুদ মোমেন ভায়ের সাথে তিনিও অনুপ্রাণিত হয়েছেন হাই কমিশনারের দ্বারাই কারণ মোমেন ভাই নিজেই বললেন যে তিনি তো ঘরেই বসে থাকতেন কিন্তু যখন জেনেছেন হাই কমিশনার আসছেন তিনিও এসেছেন। স্যালুট মোমেন ভাইকে আমাদের যে এই রকম হাজারো মোমেন ভাই খুব দরকার। খুব আন্তরিক একজন মানুষ মোমেন ভাই আর আমার ভাই আকবর হায়দার কিরনের খুব কাছের ছিলেন নিউইয়র্কে থাকার সময়ে।
মোমেন ভাই মোবাইলে কিরন ভায়ের ছবি দেখালেন সম্প্রতি কিরন ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল গেলে সেই ছবিও দেখালেন। খুব ভাল লাগল। মোমেন ভায়ের জন্য এত্ত শুভকামনা।
শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইন্স আমাদের নিয়ে যথা সময়ে উড়ে চলল। মাঝে কলম্বোতে একঘন্টার বিরতিতে তারা ক্রু বদলায় , বিমানের ফুয়েল ভরে নেয় আর খাবার নিয়ে নেয়।
পুরো বিমান একেবারে ভর্তি ছিল। প্রচুর বাচ্চা থাকায় তাদের অস্থির কান্নার শব্দ কানে ঝংকার তুলেছে সারাটা সময়ই। অবাক হয়ে শুনেছি আর বুঝেছি কান্নার ধরন আর শব্দ কতটা আলাদা বাচ্চা ভেদে। এক এক জনের কান্না এক এক রকম। এক এক শব্দের এবং সুরের।
দীর্ঘ প্রায় ১২/১৩ ঘন্টা পর মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে নামতেই আমাদের বলা হোল সোশ্যাল ডিস্টেন্স বজায় রাখতে, খুব হাসি পেয়ে গেলে তাদের বলেই বসলাম, দেখ এই আমরা প্রায় ১৩ ঘন্টা এইই বিমানে গাদাগাদি করে বসে এসেছি কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত সবাই এক সাথেই ছিলাম।
এয়ারপোর্ট অফিসারদের মাঝেও হাসির হিল্লোল বয়ে গেল তারাও বলল সত্যি তাই, কিন্তু এখন তো তোমরা বিমানের বাইরে এখন থেকে এটা মেনে চলতে হবে তোমাদের সবার ভালর জন্যই।
সত্যি তাই আমাদের ভালর জন্য এই দেশ এই জাতি কি অমানবিক পরিশ্রম করে যাচ্ছে তা যারা দেখবে না বা জানবে না তাদের বুঝার বাইরে।
সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সেরে কাগজ পত্রের যাবতীয় যথাযথ পূরণের পর আমাদের নেয়া হয়েছে বিমানবন্দরের পেছেনের গেট দিয়ে একেবারে রানওয়ের কাছে অপেক্ষারত বাসের কাছে আর এক এক বাসে ১৫/১৮ জন করে নিয়ে রওনা দিলাম আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হোটেলের দিকে।
সেই মুহূর্তে আল্লাহকে মনে মনে হাজার হাজার ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখ ভিজে একাকার হলেও মনে হয়েছে বুঝি রাণীর গাড়ীর বহর চলেছে বাসের আদলে কারণ আগে পিছে পুলিশের সিকিউরিটির গাড়ীর পাহারায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হোটেলে।
১৪ দিন আমাদের কোরান্টাইন দিন। ১৪ দিন এইখানে থাকতে হবে। ঘরের বাইরেও সিকিউরিটির পাহারা বাইরে বেরুলেই বিশাল অংকের ফাইন দিতে হবে। আমাদের দুজনের যাবতীয় ওষুধ আমাদের হোটেলের ঘরে পৌঁছে যায় আগে থেকে আমাদের কাছে জেনে নিয়ে।
১৪ দিনের আগে দেখা হবেনা কারোরই স্বজনদের সাথে।
তবুও কি এক শান্তির ঝর্ণা তিরতির বয়ে যায় চোখের ভেতরে আর বুকের গভীরে।
এক জীবনে দুই জীবনের স্বাদ সত্যি অভূতপূর্ব এবং অলৌকিক হিরণ্ময় আলোতে মোড়ানো।
আইভি রহমান – ২৩ এপ্রিল ২০২০
নভোটেল হোটেল- সাউথ ওয়ারফ
মেলবোর্ন।