করোনাঃ ভাবনা এবং যন্ত্রনা

সারা বিশ্ব জুড়েই করোনা তান্ডবে দিশেহারা মানবজাতি। অনেকেই অনেক রকম জটিল এবং অপ্রত্যাশিত ভাবনার তোড়ে ভেসে বেড়াই। কেউ কারো ভাবনার জগতে প্রবেশ করতে পারিনা আমরা কিন্তু কিছু কিছু ভাবনা অনেক সময় মিলে যায় খুব গোপনে কাকতালীয় ভাবেই … যেমন এই গল্পটা তেমনই এক ভাবনার গল্প …এক খুব ভাল বন্ধুর গল্প নিজের মত করে নিজের আলোতে দেখে লিখে ফেলা।

আমার বন্ধুদের ভাল লাগলেই আমার আনন্দ…
আমার উছলে পড়া হাসির জোয়ার বইবে ……
জগতের সকল বন্ধুদের জন্য।

বেশ কিছুদিন ধরেই মাথায় একটা ভাবনা এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ভাবনার কি নাম হতে পারে কে জানে। এটা কি আজেবাজে ভাবনা নাকি আজগুবি ভাবনা অথবা গাঁজাখুরি ধরণের কোন ভাবনা জানা নেই, কিন্তু ভাবনাটা কিছুতেই আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না বা যাচ্ছেই না।

সারাক্ষণ মগজের ভেতরে বসে কুরে কুরে খাচ্ছে ভেতরের আমি কে।

ভাবনাটা এমন ধরণের -কেন যেন খুব জানতে ইচ্ছে করছে এই আমি যদি হুট করে নাই হয়ে যাই তবে কে কিভাবে তা নেবে।কেউ কি বিলাপ করবে আকাশ বাতাস কি কেঁপে উঠবে সেই বিলাপে।কেউ কি লুকিয়ে দু’ফোটা চোখের পানি ঝরাবে অথবা কেউ একেবারে চুপ করে যাবে। কেউ কি ভাববে আহা কেনসে নাই হয়ে গেল!কেউ কি কিছুতেই থামাতেই পারবেনা তার কান্না বা আমাকে মনে করা। আমার স্মৃতি ফুল কি খুব সুবাসিত হবে না কি কিছুই দেবেনা আমার স্মৃতি কাউকেই!

কেউ কি অঝোরে কাঁদবে বা আদৌ!

এই আমিটা, যে সারাক্ষণ ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সামলে নিয়েও এর ওর সকলের খোঁজ না নিতে পারলে শান্তি পায়না।রাতের ঘুম হয়না দিনের মধ্যে কাজের ব্যাঘাত হয়। যত ক্লান্তই হোক না শরীর বা মন এই সব কাজ না করতে পারলে একেবারেই শান্তি পায়না আমার মন।

সারাক্ষণ মাথায় পোকা নড়ে, ওই চাচার মেয়ের কি হয়েছ্‌ সে পাস করল না এবারেও ফেল মেরেছে , ওই মামার ছেলের শ্বশুর হাসপাতাল থেকে কি বাড়ী ফিরলেন, সেই যে ছেলেটা কবে একটা চাকরির কথা বলেছিল তার জন্য একটা ফোন করতে হবে। হুট করে মাথায় আসে আহা অনেক দিন ওদের খোঁজ নেয়া হয়নি কালকেই ফোন দিতে হবে। অথবা যে মেয়েটাকে পড়াশুনা করাচ্ছে সেই কবে থেকেই তার কতদুর এগুলো পরীক্ষার প্রস্তুতি এসব না জেনে কিছুতেই আমার শান্তি নেই। একেবারেই নেই।

এসবের বাইরেও মগজের ঘুম হয়না প্রতিরাতে আজিমপুর কবরস্থানটা ঘুরে না এলে।

ইউক্যালিপটাস গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে একমনে দোয়া পড়ে যখন ওই মাটির বুকে হাত রাখি খুব টের পাই ,আব্বার হাত আমার হাতের উপরে আলতো করে হাত বুলায় আর বলে, এত রাতেও ঘুমাও নি বাপ!

আমি খুব আস্তে করে বলি ,এইত এবার যাবো। আব্বা বলেন রাত জেগোনা বাপ শরীর খারাপ করবে, সকালে তোমার অফিস আছে। ঘুমাও।

আমি আব্বার মাথায় হাত বুলিয়ে আসি আম্মার কাছে। জানাই ছিল আম্মা মুখ গম্ভীর করে থাকবেন আগে যে আব্বার কাছে গেছি!

আজীবনের ছেলেমানুষ আম্মা আমার। কি অবাক করা সুন্দর মুখটা। আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকি আর দোয়া পড়ি। আম্মা বলেন তুমি অনেকটা শুকিয়ে গেছো, খাওনা ঠিকমত, আমাকে বাসায় নিয়ে চল রান্না করবো তোমার জন্য।

কত্তদিন তোমার জন্য চিংড়ী দিয়ে পটল রান্না করে দেইনি।টিকিয়া বানাই নি। তুমি কি এগুলো রান্না করে খাও? আমি চুপ করে থাকি, নিজেকে নিজে বলি আজ প্রায় পনের বছরের বেশী হয়ে গেছে আম্মা আমি খাইনি চিংড়ী দিয়ে পটল কারন ওটা যে আমার আম্মা ছাড়া আর কেউ রান্না করতেই জানেনা, পারেওনা।

আমি নিজে কি করে রান্না করব, তাতে যে আমার আম্মার রান্নাকে অসম্মান করা হবে। সে স্পর্ধা যেন আমার না হয় জীবনের কোন দিনও। তাই আমি আর কোনদিন খাবো না চিংড়ী দিয়ে পটল।

আমি চোখ মুছে আস্তে করে বলি এখন ঘুমান সকালে নিয়ে যাব।

এই সব তো আমার নিত্য দিনের রুটিনের ছক আঁকা এক খাতা।

কিছুদিন ধরেই এই রুটিনের বাইরেও ওই ভাবনা পোকা ডানা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিস্তার করছে ক্রমেই তার পরিধি।

এই সব ভাবতে ভাবতেই কে জানে কেন কি হোল, হুট করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম কিচেন থেকে খাবার টেবিলে আসার সময়ে। বাড়ীর সবাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো, অস্থির কতগুলো মুখ আমাকে ঘিরে ধরল। আমার কথা বলার শক্তি যেন হঠাত করেই লুপ্ত।

কিছুতেই যখন আমাকে কথা বলানো গেল না তখন লাল নীল বাতি জ্বালিয়ে আর সারা মহল্লাকে সাইরেনের শব্দের জানান দিয়ে এ্যাম্বুলেন্স এলো।

প্যারামেডিক দল খুব গম্ভীর মুখে আমাকে পরীক্ষা করলেন, পালস দেখলেন, মুখে বাতাস ঢুকানো হোল, অনেক বার CPR দেয়া হলো। বুকে ,পেটে অনেক জোরে চাপ দেওয়া হোল।অনেক চেষ্টা এবং সময়ের পর প্যারামেডিক দল খুব করুণ স্বরে বলে উঠলেন ‘She is no more’— কেউ কি কিছু বুঝলো!

কিছুই বুঝা গেল না ,কোন সাড়া নেই কারোই। কেউ যেন কোথাও নেই। সব চুপ করে আছে, বুঝি অনন্তকাল কেটে গেল এর মধ্যে।

একসময় প্যারামেডিক দল বলে উঠলেন তারা ‘Dead Body’ নিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালের সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আর পোস্টমর্টেম শেষ হলে আমাকে ফেরত দেয়া হবে।

এইবার পরিবারের হুশ ফিরে এলো সবাই এক যোগে হৈ চৈ করে কান্নার মাতম তুলে চীৎকার শুরু করে দিল, না এটা হতে পারেনা , কিভাবে সম্ভব, ও তো আমাদের জন্য রাতের খাবার টেবিলে নিয়ে আসছিল আর মাথা ঘুরে পড়ে গেছে , কি ভাবে নাই হয়ে যেতে পারে। ভাল করে আবার পরীক্ষার আবেদন জানানো হোল। আর পোস্টমর্টেম কেন করা হবে। ওর খুব যত্নের আদরের শরীরটা কেন কাটাছেঁড়া করা হবে?

প্যারামেডিক দলের একই কথা, তাদের কাজ তারা করেছে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সে আর নেই। এখন হাসপাতালে নিয়ে যখন পোস্টমর্টেম করা হবে তখন মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।

কারো মাথায় বুঝি কিছুই যাচ্ছেনা সবার বোধ লোপ পেয়েছে। স্তম্ভিত হয়ে গেছে, কান্নাও বুঝিবা থমকে গেছে তাদের। কেউ মনে হয় জানতে চাইল কবে ফেরত পাবো ওকে আর তা কিভাবে জানব, কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

প্যারামেডিক দল জানালো যে হাসপাতাল কাছে সেটাতেই নিয়ে যাওয়া হবে। সব সম্পন্ন হয়ে গেলে হাসপাতাল ফোন করে জানিয়ে দিবে সময় এবং দিনক্ষণ।

আমাকে খুব যত্ন মমতায় এ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসা বিছানায় ঊঠানো হোল। আমি চীৎকার করতেই থাকি আমাকে নিয়ে যেওনা আমি ঠিক আছি আবার দেখো আমি নাই হয়ে যাইনি। কিন্তু কেউ শুনতেই পায়না আমাকে। কেউ দেখেও না আমার চোখের কোণে কি প্রবল প্লাবনের ধারা।

আমাকে বেল্ট দিয়ে খুব ভাল করে বেঁধে দেয়া হোল ওই বিছানার সাথে শুইয়ে। তারপর তারা রওনা দিল তাদের ‘Dead Body’ নিয়ে।

গেটের বাইরের বাতিটা জ্বালানো হয়নি বেশ অন্ধকার হয়ে আছে করিডরের সামনেটা। দরজার সামনে জটলা বেধে গেল কিন্তু কারো মনেই এলো না গেটের বাইরের বাতিটা জ্বালানোর কথা। কি করে মনে হবে ওরা কি কোনদিন করেছে এসব!

আমাকে তুলে নেয়া হোল এ্যাম্বুলেন্সে তারপর কি কি সব করে তারা ড্রাইভ শুরু করলে দেখতে পেলাম ঝাপসা কটা শরীর দরজা ধরে দাঁড়িয়ে কিন্তু বাইরের বাতি টা কেউ জ্বালায় নি তখনো!

হাসপাতালে পৌঁছে দরকারি সব কাগজ পত্র ঠিক হলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হোল খুব ঠান্ডা একটা ঘরে তার নাম বুঝিবা মরচুয়ারী তারপর নাম্বার মিলিয়ে একটা ড্রয়ার খুলে তাতে আমাকে ভরে দেয়া হোল। আমি চীৎকার করতে লাগলাম আমাকে কম্বল দাও আমার খুব শীত লাগছে। আমাকে কম্বল দাও আমি শীত সইতে পারিনা। খুব কষ্ট হয় আমার। কেউ শুনলো না। কেউ দেখলো না আমি বলেই চলেছি কেঁদেই চলেছি।

বন্ধ হয়ে গেল ড্রয়ার।ঘন কালো অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায়না।কি অদ্ভুত সুনসান সব কিছু।

আমি ঠান্ডায় জমতে জমতে কখন যেন নেতিয়ে পড়ে ঘুমিয়েই গেলাম।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল দেখলাম আমি শুয়ে আছি একটা টেবিলের উপর আর হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বলছে মাথার উপরে ওই ড্রয়ারের সব অন্ধকার একেবারে ঝেটিয়ে দূর করে দিয়ে।

যে বিছানায় আমাকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে তাতে কোন চাদর নেই। ছোট বাচ্চাদের প্ল্যাস্টিক অথবা ন্যাপি বদলানোর মত একটা র্যা পার পাতা আর তাতে যেন ঠান্ডা আরও বেশি লাগছে শরীরের নীচে আর বাইরের দিকেও মনে হয় ঘরে এয়ারকন্ডিশন চলছে।

চোখ তুলে চারিদিক দেখতে শুরু করলাম। ঘরটা বেশ বড়।বিচিত্র সব যন্ত্রপাতিতে ভরা চারিপাশ। আমার বিছানার পাশেই একটা টেবিল অনেক রকম ছুরি, কাঁচি, ইনজেকশন এর সিরিঞ্জ, তুলোর স্তুপ, প্যাড সহ আরো অনেক নাম না জানা জিনিস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কে জানে কার জন্য!

এখন কি সকাল না রাত বুঝতে পারা গেল না। বাসায় সবাই কি করছে। তাদের রাতের খাবারটা টেবিলে সাজানো হয়েছিল তখনই তো পড়ে গেলাম, ওরা কি খেয়েছে!খাবারগুলো কি ঠিকমত ফ্রিজে রেখেছে র্যানপ করে করে আল্লাহ জানে পারবে কিনা কেউ তো কোনদিন এসবের ধারে কাছেও যায় নি। অস্থির লাগে ওরা সবাই কি করছে সেই ভেবে।

ছটফট করে উঠে বসতে গেলে টের পাই আমাকে ঢেকে রাখা হয়েছে একটা সাদা চাদর দিয়ে আর তার নিচে বেল্ট দিয়ে বাঁধা আছে আমার শরীর।

এই সময়ে একদল মানুষের কথা শুনতে পাওয়া গেল আর দরজাটা খুলে গেল। সবুজ আর নীল ড্রেস পরা কয়েকজন ছেলে মেয়ে আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল।

কে একজন মাথার উপরের ঝুলন্ত অনেক গুলো বাতির ঝাড়টা হাত বাড়িয়ে নামিয়ে নিলে এলো আরো অনেক কাছে আর তাতে আমার চোখ মুখ ঝলসে যেতে থাকলো এত্ত আলোর ছটা আগে কি দেখেছি!

সবাই ঝটপট করে তাদের হাতে গ্লাভস পরে নিল। তারপর ওদের ভেতরে যিনি সবচাইতে লম্বা এবং বয়স্ক মত সেই লোকটা হাতে কাঁচি নিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন তারপর শরীর থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলেন।

সবাই ঝুঁকে পড়ল আমার দিকে। কেউ কেউ বলাবলি করতে লাগলো , আহা , খুব মর্মান্তিক মৃত্যু। কি সুন্দর দেখতে ছিল মেয়েটা আর কতই বয়স হয়েছে। লম্বা লোকটা একটা ফাইল হাতে নিয়ে পাতা উল্টে পড়ছিলেন কিছু, তারপর বললেন, হার্ট আর ব্রেন দুটোই একসাথে কলাপ্স করেছে।

একসাথে হার্ট এট্যাক আর ব্রেন স্ট্রোক করেছিল যা সত্যি বিস্ময়।

তাই প্যারামেডিক দলের কিছুই করার ছিলনা আর এই দুটো জিনিস এত দ্রুত অফ হয়ে গেছে যা সত্যি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিলেও উত্তর হয়ত জানা যাবেনা।

কি নিপুণ তৎপরতায় বয়স্ক মানুষটা আমাকে উন্মুক্ত করে ফেললেন কি অবাক কান্ড আমি একটুও ব্যাথা পেলাম না!

দেখো তোমরা, ওর হার্ট একেবারেই ক্লিন ছিল ,কিন্তু মনে হয় খুব স্ট্রেস ছিল মেয়েটার, একপাশে কেমন নীলচে হয়ে আছে কিন্তু কেন সেটা বুঝা যাচ্ছেনা ওর হার্টের কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি ফাইলে।

আমি চীৎকার করতে থাকি , না আমার হার্টে কোন সমস্যা ছিল না। একপাশে নীলচে আভা জমেছে কারন আমার বুকের গহীনে জমে আছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রত্যাশিত অপমানের আগুন যে আগুন বাইরে বেরুতে পারেনি আমাকে কাঁদিয়ে আর ভেতরেও জ্বলে উঠতে দেয়নি আমার ভেতরের আমিটা।

কারণ তাতে আমার নিজের চারিপাশের সবার কাছে আমার অপমানের কথা বলাই লাগত যা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।আমি ওই অপমানের জন্য মোটেও তৈরি ছিলাম না আর ওটা অন্যায় আঘাত ছিল।

কিন্তু আমি কিছুতেই ভুলে যেতে পারিনি সেই চরম অপমানের তীব্র ঝাঁজ। পুড়ে অঙ্গার হয়েছি। কেউ দেখেনি।খুব আপন কারো থেকে পাওয়া আর খুব আপনজনেরা জেনেওছে, কিন্তু কিচ্ছু বলেনি। তাতে সেই আগুন আরও বেড়েছে।

বহুদিন অপেক্ষা করেছি আমি যদি কেউ এসে বলে আমি ভুল করেছি। তবে হয়ত আমার হার্টের পুরোটাই টকটকে লাল’ই থেকে যেত।কিছুতেই নীলচে হয়ে যেতনা।

কিন্তু কেউ আসেনি। কেউ না । কেউ না।আমি চিল্লাতে থাকি, আমার হার্ট নিলচে কেন হবে আমি তো সবাইকে মাফ করে দিয়েছি। পুষে রাখিনি এতটুকু কষ্ট বা যন্ত্রনা যদিও খুব কষ্ট হয়েছে ভুলে যেতে। কিন্তু পেরেছিলাম তো। তবে কেন এখনো নিলচে হয়ে আছে। কেন । কেন। কেউ উত্তর দেয় না। কেউ না।

ওরা আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে আমি শুনতে পাই ওদের আলাপ, মনে হচ্ছে ব্রেন স্ট্রোকটা খুব দ্রুততায় আর মারাত্মক ভাবে আক্রমণ করেছিল আর তাতেই হার্ট ব্রিদ করতে মানে নিঃশ্বাস নিতে পারেনি ফলে একেবারেই সব কিছুই কলাপ্স করে গেছিল।

মৃতের ফাইলে দেখা গেছে সে হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী ছিল। অনেক উচ্চ মাত্রার ওষুধ নিয়মিত খেতো বেশ অনেক বছর ধরেই। মানসিক চাপ বা অস্থিরতার কথা আছে ফাইলে যখন তার মা মারা গেছিলেন তার জন্যেও কিছু ওষুধ খেয়েছে সে।

নতুন কোন চাপা যন্ত্রনা হয়ত ভেতরে চাপা ছিল বা কিছু কষ্ট চেপে রাখা টাই এই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়ে শেষ করে দিয়েছে। দুঃখজনক।

অটপ্সি রিপোর্টে বুঝি লেখা হয়ে গেল ‘hemorrhagic stroke with severe heart attack due to coronary artery blocked’ আমি কিছুই বুঝতে পারার আগেই তারা ধুম করে হাজার পাওয়ারের বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে চলে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে তাও কেমন হলদেটে আমি ঝিম মেরে পড়েই থাকলাম। কিছুই মাথায় যাচ্ছেনা। কিচ্ছুনা।

বেশীদিনের অপেক্ষা বা ঝামেলা ছাড়াই হাসপাতাল খবর দিয়েছে বাড়ির লোকজনদের। আমাকে বাড়িতে নেয়া হয়নি। সোজা চলে গেলাম মসজিদের দরজায়। আগে থেকেই নাকি ইমেইল আর টেক্সট দিয়ে জানানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমার খবর।

যেহেতু করোনা নেগেটিভ দিয়েছে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তাই ইমাম সাহেব রাজি হয়েছেন জানাজা পড়াতে।

এই শহরে আসার পর থেকেই আমি এই মসজিদে এসেছি।

আজ শেষ সময়ে সেইখানে না আসতে পারলে আমার তো ঘুম আসবেই না।

এটা মনে হয় সর্ব শক্তিমান তিনি উপর থেকেও বুঝতে পেরেছিলেন।

নির্দিষ্ট সময়ে দেখা গেল মসজিদে মানুষের বন্যা বইছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা মুশকিল হয়ে পড়তে দেখে ঘোষণা দেয়া হোল যে দুবার জানাজা হবে দুই জন ইমামের সাহায্যে।

আমার চোখ ঘুরে ঘুরে দেখে যেতে থাকে, এত অপার বিস্ময় আজো অপেক্ষায় ছিল এই চোখের জন্য!

অফিস কলিগ থেকে শুরু করে ভিন্ন ধর্মের বর্ণের গোত্রের কে না এসেছে! চোখ আটকে যায় পিটার আর গ্যারির দিকে ওরাও কাজ ফেলে আজ এখানে!

পিটার অফিসের জ্যানেটর ক্যান্টিনে দেখা হলেই হেসে কথা বলেছি জিজ্ঞাসা করেছি কি খাচ্ছে সে লাঞ্চে। কোন দিন সে বলেছে আজ লাঞ্চ নেই, আমি আমার স্যান্ডউইচ থেকে অর্ধেক জোর করে তাকে দিয়েছি প্রবল বাধার মুখেও। সেই পিটার কি অঝোরে কাঁদছে মাঠের এক কোনে বসে। সে দ্বিতীয় জানাজায় দাঁড়াবে বলে দূরে অপেক্ষা করছে।

গ্যারি কি ভাবে জেনেছে আমার জানা নেই সে তো বাসস্টপে বসে গিটার বাজিয়ে দুপয়সা উপার্জন করে নিজের খাবারের সংস্থান করে নেয় সেও কেন তবে তা ফেলে আজ এখানে, খাবে কি গিটার শুনে কেউ পয়সা না দিলে। গ্যারি দাঁড়িয়ে আছে শেষ সারির একেবারে বামদিক ঘেঁষে। বার বার হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে দেখে আমার নিজের চোখও কি অবলীলায় ভিজে যায়। ভিজে যেতেই থাকে।

আমার সুপারভাইজার জো আর টিম লিডার শারন দুজনে কি সুন্দর করে মাথায় স্কার্ফ বেঁধেছে!

খুব বেশি দেখা হয়ে গেলে চোখের ক্লান্তি আসে একটা সময়ে। আমার চোখেও ক্লান্তি ভর করে আর তাকি্যে থাকার শক্তি পায়না মনে হয়।

কি নির্ভার নিশ্চিন্তে নিসচুপে ঘুমিয়ে পড়ে সে সোঁদা গন্ধ মাখা মাটির বুকে মাথা রেখে।