গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে গিয়েছিলাম নানার বাড়ি বেড়াতে৷ পাশের বাড়িতে আবার বিয়ে উৎসব চলছে৷ তো বিকেলবেলা আম্মু আমাকে ঘুম পাড়িয়ে গিয়েছিল বউ দেখার জন্য৷ আমার জন্য না, ঐ যে পাশের বাড়ির ছেলের বউ দেখতে৷
হঠাৎ টিনের চালে আম পড়ার ঠুস-ঠাস শব্দে ঘুম ভেঙে গেল৷ ঘুম থেকে উঠে দেখি পাশে আম্মু নেই৷ আমার বয়স তখন কত আর হবে! চার কি পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা৷ বুঝতেই পারছেন এইটুকুন একটা বাচ্চা মাকে না দেখতে পেয়ে কি অবস্থা হওয়ার কথা! মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা৷ বাচ্চাটি যেন ঘুমের রাজ্যেই স্বস্তিতে ছিল, কল্পনায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে এসে তা আর স্পর্শই করলো না৷
এ যেন জলহীন মৃত্তিকার হাহাকার চাহনী, ক্ষুধাতুর পেটের ক্লান্তির প্রতিচ্ছবি, অশান্ত হৃদয়ের বেদনার বাণী৷
কি আর করার! কান্না করতে শুরু করলাম৷ শিশুদের যখন কোনোকিছু করার ক্ষমতা থাকেনা, রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যখন স্তব্ধ, ভাষা যখন হয়ে যায় সংকীর্ণ তখন ক্রন্দনশক্তি ব্যতীত আর কোনো উপায়ই থাকেনা৷
আমার নানাজান গাছ থেকে আম পারছিলেন৷ তখন বেশ শক্ত-সবল মানুষ ছিলেন উনি, রাগ-অভিমান, শাসন, ভালোবাসা কোনোটারই ঘাটতি ছিলনা৷ নাতির অসহায় কান্নাভেজা চোখ তিনি সইতে পারলেন না৷ কঠিন হৃদয়ে যেন জলস্রোত বয়ে গেল৷ গাছ থেকেই ডেকে বললেন-
না…না, ও নানা এই যে আমি, নেও আম নেও, তোমার জন্য কত্ত…গুলা আম পারছি আমি, নেওনা একটা, নানা ভা…লো৷
এইসব মনভোলানো কথা বলে কি আমাকে দমিয়ে রাখা যায়? এত্ত সোজা! হুমমম?
তো কে শুনে কার কথা! নাতির কান্না যে কোনোভাবে থামছেই না৷ কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছিলাম একদম৷ খালামনিরা তো শান্তনা দিচ্ছেই আবার আমের বিশাল ঝুড়ি নিয়ে সামনে সাজিয়ে রেখেছে৷ যেন আমি তাদের নতুন জামাই! যেই বাচ্চা একটার বেশি দুইটা আমই খেতে পারেনা তাকে এত্তগুলা আম দেওয়ার কোনো মানে হয়? এই ভেবে আরো কান্না শুরু করলাম৷ আর বলতে লাগলাম- আমার আম্মুকে এনে দে…ও, আমার আম্মুকে এনে দে…ও, আমি আম খাবো না, আগে আমার আম্মুকে এনে দে…ও৷
খালামনি তাড়াতাড়ি খবর পাঠালেন আম্মুর কাছে৷ যেন অশ্বারোহী ছুটিয়ে একটানে তুলে আনবেন আম্মুকে, রাজা মশাই অপেক্ষায় আছেন বলে কথা!
আম্মু তো দ্রুতগতিতে ছুটে আসলেন যেন সাত সমুদ্র তের নদী এক লাফেই পাড়ি দেওয়ার মত অবস্থা৷ তার বুকের ধন আজ হাহাকার করছে বুকে ফেরার জন্য৷
চারদিক নিস্তব্ধ৷ কোনো কথা নেই, আওয়াজ নেই আর নেই কোনো কান্না৷ এ যেন মরুভূমির তীব্র শুষ্কতায় কূপের সন্ধান পাওয়া, তীব্র খরায় বৃষ্টিবর্ষণ শুরু হওয়া, শুষ্ক অনাবাদী জমিতে সেঁচের পানি গড়িয়ে পড়া, কোলাহল স্থানে নিরবতা বিরাজ করা, শূন্য হৃদয় পরিপূর্ণ হওয়া, অশান্ত প্রাণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে পাওয়া৷
আমি আর আম্মুর এই স্বল্প সময়ের দূরত্বটুকু যেন হাজার বছরের ব্যবধান৷ তাই উপলব্ধি করলাম আম্মুকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না৷ আম্মুর কাছ থেকেও একই প্রতিশ্রুতি নিলাম৷
আজ এত বছর পর সেই স্মৃতিটুকু এখনো চোখে ভাসে৷ মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলোর কথা৷ মায়ের প্রতি মায়া- মমতা, সোহাগ-ভালোবাসা শতগুণ বেড়ে যায়৷ বিধাতা যেন সবসময়ই আমাদেরকে এক করে রাখেন, কখনো যেন দূরে সরিয়ে না দেন৷ এই আকাংখা, প্রার্থনা নিয়ে আজ ‘বিশ্ব মা দিবস’কে কেন্দ্র করে সকল মায়েদের প্রতি রইল আমার হাজারো সালাম, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা৷ তাই মন খুলে বলতে চাই-
মা, আমি তোমাকে সত্যিই অনেক বেশি ভালোবাসি৷
“চোখের জল মুছিয়ে শতব্যথা লুকিয়ে
করলো তোমায় বড় যে’জন,
তারে তুমি রেখোনা ক্ষুধায় অনাহার-
শান্তি দিও, এই হোক আমাদের পণ”
দেওয়ান মোঃ ছাইফুদ্দিন৷ বাবার নাম মাওঃ ছালাহউদ্দিন দেওয়ান ও মায়ের নাম ছালেহা খাতুন৷ চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলা, ফরক্কাবাদ গুলিশা গ্রামের দেওয়ান বংশের সন্তান৷ বর্তমানে অনার্স করছেন চাঁদপুর সরকারী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে৷ ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি কবিতা, গজল-সংগীত ও আর্টিক্যাল লেখার প্রতি বেশ ভালোলাগা কাজ করে৷ বলতে গেলে, বরাবরই বাংলা সাহিত্যের প্রতি একটা ঝোঁক রয়েছে তার৷