কোভিড -১৯ ও আমাদের কোয়ারেন্টাইন সময়

এখন পৃথিবীতে  করোনা, ও কোয়ারেন্টাইন শব্দ দুটোর পাশাপাশি অবস্থান মানুষকে আতঙ্কিত করছে খুব।

করোনা ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতেই। বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত একচল্লিশ লাখ এক হাজার পাঁচশ ছত্রিশজন, গত দুদিনের হিসাব মতে, তবে দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে বৈকি কমছে না। মৃত্যুর সংখ্যা দুই লাখ আশি হাজার। আমার জানা মতে একশ সাতাশি টা দেশে করোনা আঘাত হেনেছে। সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা তেরো লাখ নয় হাজার একশত উনোষাট। মারা গেছে আটাত্তরহাজার সাতশ বিরানব্বই জন। (সুত্র বিভীন্ন সংবাদ মাধ্যমে ) করোনা আক্রান্ত যে সব দেশ থেকে মানুষ ফিরছেন দেশে বা বিদেশে, তাতে শঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে   যদিও বিদেশ থেকে ফিরলেই হোম কোয়ারেন্টাইনের  বা হোটেল কোয়ারেন্টানের পরামর্শ  স্বাস্থ্য বিভাগের।

কোয়ারেন্টাইন কি -এ বিষয়ে কতটুকু জানেন প্রবাসী কিংবা তাদের স্বজনেরা। তারা জানেন বাড়িতে আমরা একটা আলাদা রুম রাখব। ওই রুমে কোনো লোককে ঢুকতে দেব না।আসলে হোম কোয়ারেন্টাইন মানে কি শুধুই দূরত্ব বজায় রাখা?

আমরা এই শব্দের সাথে অনেকেই পরিচিত হচ্ছি, তার কারণ দেশের অনেক মানুষই যেমন এই শব্দটা নতুন শুনছেন, তেমন করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার সাথেও ফেস করছেন। এবং লক্ষণ, উপসর্গ গুলো সম্পর্কে জানছেন। কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানে, আপনি হোটেল কিংবা বাসায়  যে কোন খানে থাকতে পারেন। সেটা হবে আলো-বাতাসযুক্ত আলাদা ঘর। ব্যবহার করতে হবে ভিন্ন টয়লেট। যে কোনো মানুষের সঙ্গে দূরত্ব হতে হবে এক মিটার। এড়িয়ে চলতে হবে সব ধরনের জমায়েত, আড্ডা, নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। গৃহস্থালি সামগ্রী ভাগাভাগি করা যাবে না। ব্যবহৃত বস্তু ও ঘর জীবাণূনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে নিয়ম করে, যে কোনো সমস্যায় হটলাইনে কল করতে হবে।দৌড়ঝাপ করে এই সেই হাসপাতালের গেলে চলবে না, এতে করে হয়রান হতে হয়। নিদৃষ্ট তথ্য অনুযায়ী বাসা থেকে চিকিৎসার জন্য বের হতে হবে, করোনার জন্য নিদৃষ্ট হাসপাতাল করেছে সেখানেই যেতে হবে।

হোটেল কিংবা হোম কোয়ারেন্টাইনের সময় মোট  ১৪ দিন। এ সময়টাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাসযুক্ত একটি ঘরে থাকতে হবে। আলাদা টয়লেট থাকতে হবে। কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিকে অন্য মানুষের সঙ্গে ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বয়স্ক, শিশু ও গর্ভবতীদের থেকে দূরে থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই কক্ষের বাইরে বের হওয়া যাবে না কিংবা কোন আড্ডার কাছে যাওয়া যাবে না। নিজেকে পরিষ্কার রাখতে হবে, নিয়মিত বিরতিতে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। জীবাণুনাশক পণ্য ব্যবহার করা যেতে পারে। গৃহস্থালি সামগ্রী কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করা যাবে না। ব্যবহৃত জিনিসপত্র জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। ধোয়ার সময় গ্লাভস ও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। কোয়ারেন্টাইনে থাকা ঘর নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। শ্বাস কষ্টসহ যেকোনো সমস্যায়  হেল্প লাইনে কল করতে হবে।

কোয়ারেন্টাইন নিয়ে অনেক কথাই লেখা হয়েছে, প্রতিনিয়ত লিখছে, কেউ কেউ ইতিমধ্যে এই কোয়ারেন্টাইন অভিজ্ঞতায় অবগত  হয়েছেন, কেউ কেউ হতে যাচ্ছেন, কেউ কেউ কোয়ারেন্টাইনদিন যাপন করছেন।

যেমন আমরা, আমার সপরিবারে দুটো মেয়ে সন্তান সহ এই মুহুর্তে হোটেল কোয়ারেন্টাইনে আছি। আজকে আমাদের  ষষ্ট দিন, আমরা সাউথ অষ্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা, আপাতত আমরা কোয়ারেন্টাইন যাপন করছি মেলবর্নের হোটেল ক্রাউনে।

প্রথম যখন বাংলাদেশ থেকে স্পেশাল ফ্লাইটে আমরা মেলবর্ন ফিরলাম, সারা রাস্তায় ছিল ভয়, ছিল -না ছুঁই, না ছুঁই,করে বসে থাকা, বার বার হাতে স্যানেটাইজার ব্যবহার, মুখের মাস্ক শক্ত করে নাকে মুখে সেঁটে রাখবার চেষ্টা, রাস্তার অনেক ঝক্কি সামলে যখন আমরা আমাদের অষ্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা রাখলাম, ভেতরে ভেতরে একধরনের সঙ্কা , অবসাদ, অসহায়ত্ব, সংক্রমনের ভয়, মৃত্যুভয়, কোয়ারেন্টাইন সময় পার করবার ভয়, সব ভয় একসাথে মুখে ভর করেছিল, হাত কাঁপছিল, কারন তো অবশ্যই ছিল, যে দেশ থেকে এসেছি, সে দেশ এমনিতেই ছোট অনিয়ম হাজার সমস্যা, করোনার সচেতনতাহীন জীবন, প্রর্যাপ্ত  কিট নেই যে পরিক্ষা করবে, মানুষ করোনাক্রান্ত হয়ে গোপনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানান হতাশা, দুশ্চিন্তা, ভয়কে নিয়ে যখন আমরা অষ্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছি। কিন্তু এখানকার এয়ারপোর্টে ঢুকতেই যেন শান্তির লু হাওয়া বইতে শুরু করলো মনে। কেয়ারিং মনোভাব, হাসিমুখে কখা বলা,  কারও চোখে মুখে আমাদের নিয়ে না ছিল ভয়, না ছিল দূর দূর যা যা টাইপ আচরণ। বরং বাচ্চাদেরকে চকলেট স্বাগতম জানিয়েছে, যতখুশি নিয়ে নাও এমনি করে বলতে শুনেছি। আর আমাদের প্রত্যেকের সাথে খুব সদালাপি মূলক আচরন, আমারদের অর্ধেক ভয় কে কাটিয়ে দিয়েছে। তারপর সবার একটাই চিন্তা ছিল,আমাদের এত্তো এত্তো লাগেজ, সব যদি নিজেদেরকে, বাসে তুলতে হয়, তবে তো জীবন কাবাব  তারকারণ আমাদের আগের স্পেশাল ফ্লাইটের কিছু মানুষের কাছে শুনেছি, হোটেল লবি থেকে নিজের লাগেজ নিজেকেই রুমে তুলতে হয়েছে, তারপর যদি হোটেলে নিজেকেই বয়ে নিয়ে রুমে নিতে হয়, তবে তো অর্ধেক জীবন নাই হয়ে যাবে। বাস অবধি আসতেই দেখলাম হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন কতক অসময়ের বন্ধুরা, এয়ারপোর্ট এবং হোটেল কর্মী যারা ধামা ধাম করে যত্নে লাগেজ তুলে দিলেন বাসে। আমারা  হোটেল পৌঁছেও কোন সমস্যায় পড়লাম না, বরং সবার চক্ষুছিল আনন্দে উৎফুল্ল, আমরা কয়েকজন যাত্রাসঙ্গী একসাথে বলে উঠলাম … ও মাই গস ! হোটেল ক্রাউন, উই আর লাকী এনাফ, থ্যাংক গড ! হিপ হিপ হুররে।

এমন খুশি হওয়ার কারণ ছিল। আমরা দেশে আটকে পরা কালীন কতজন প্রবাসী যে কত ভাবে লান্চিত হয়েছি তা এবার আমাদের মনে মনে আছে। এমন কি বিভীন্ন সংবাদ মাধ্যমে মানুষের সাক্ষাৎকারে শুনেছি –

যথারীতি হোটেল রুম যার যার সদস্য অনুযায়ী পেয়ে গেলাম, আমরা একটা সুইট পেয়েছি ভাগ্য গুণে। তারপর থেকে চলছে জামাই আদর। খাবার দাবার থেকে খোঁজ খবর, বাচ্চাদের রোজ এক্সপেন্সিভ টয়, এবং সার্বক্ষনিক খোঁজ খবর। আমরাও আমাদের মনকে রাঙ্গিয়ে মনোটোনাস সময়কে কাজে লাগাচ্ছি, একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন পরিধিতে। ভালো আছি, নিয়ম মানছি নিয়মের ঘড়িতে কাঁটার মতো ঘুরছি, টিক টিক টিক  করে। আর দিন গুনছি কবে ফিরবো বাড়ি।

আমার ফেসবুক স্টাটাসে কোয়ারেন্টাইন নিয়ে রোজকার  অনুভূতি আমি শেয়ার করেছি ধারাবাহিক ভাবে।

সবাই নিরাপদ থাকুন সুস্থ থাকুন।