বেদের মেয়ে [অনু গল্প]

মেয়েটির নাম জোৎস্না ছিল কি না – জানা নেই। কি নাম ছিল তার? তাও জানা নেই। এ নিয়ে আমার কখনো তেমন একটা মাথা ব্যথা ছিল না। ভালো লাগতো এটুকুই জানি। সারাদিন ঘাটে বাধা নৌকার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়াতো। আমি সবে মাত্র ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। হাতে অপূরন্ত সময়। শীতের সময়। সেবা প্রকাশনীর কোন একটা অনুবাদ গল্পের বই হাতে নিয়ে বসতাম নদীর পাড়ে। রোদ পোহাতে। ওখান থেকে বেদে মেয়েটিকে সহজে দেখতে পেতাম।

আমি দেখতে বেশ লিকলিকে, ছোটোখাটো ছিলাম। কালো, খাঁটি বাঙালিদের মত প্রায় মাটির রঙে রং। বেশির ভাগ মানুষ আন্দাজ করতো – বড়োজোর ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি আমি।

না, প্রেমেও পড়িনি – আমার প্রেমেও কেউ পড়েনি। আসলে ওসব হবার মতো মানসিক বয়স তখন আমার ছিল না। মাথায় একটি ব্যাপার ই ঘুরপাক খাচ্ছিলো।  বেদে হবো। বেদে পরিবারের সাথে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবো নদীপথে। কয়েকদিন পর পর ই নতুন নতুন জায়গা, নতুন নতুন মানুষ। নতুন নতুন পরিবেশ। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা।

শুনেছি যে কেউ ইচ্ছা করলেই বেদে হতে পারে না। তাদের রক্তের সম্পর্কে অথবা বিবাহ সূত্রে বেদে হতে হয়। শুনেছি চিতোষীর (আমাদের বাসা থেকে পাঁচ/ছয় কিলোমিটার দূরে) কোন এক ছেলে, বেদে মেয়ে বিয়ে করে এখন বেদে।  মনে সাহস পেলাম। তবে মনে একটা ভয়ও কাজ করছিলো – আমি সাপ পছন্দ করি না। ভবিষৎ বউ – চুড়ি, শাড়ী বিক্রি করলে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সাপ? না বাবা, সাপ বা সাপ খেলা নয়!

না, কোনো ভাবেই মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি। গত ছয় সাত দিনে এক বারও আমার দিকে চেয়ে দেখেনি। সে সময়, আমি নিজেকে কখনো সুদর্শন মনে করিনি – এখনো মনে করি না। শুনেছি ইউসুফ নবী এতোই সুদর্শন ছিল যে – মেয়েরা সুদর্শন ইউসুফ নবী’কে  সামনে দেখে খাবার কাটার পরিবর্তে নিজের আঙ্গুলই কেটে ফেলেছিলো। না, আমার বেলায় আজ পর্যন্ত তেমন কিছুই ঘটেনি – সামনেও ঘটবে না। নিশ্চিত। অতএব এই “না তাকানোর” ব্যাপারটা খুব একটা প্রভাব আমার উপর ফেলতে পারেনি। দমাতে পারেনি আমাকে বা আমার মনের কঠিন ইচ্ছাকে।

এই মেয়েটির বাবা বেদে সর্দার। লম্বা, ভালো স্বাস্থ্য, পেটা শরীর। মাথার চুল মাঝারি কিন্তু গোঁফ ছিল বেশ, সুলতানি কায়দার।  লম্বা, গালের দুই দিকে উঠানো। প্রায় সারা দিন ফরিজ উদ্দিনের চা দোকানে আড্ডা দিতো। মেয়েটাও মাঝে মাঝে আসে। বাবা কে দেখে যায়। আমি সর্দারের পাশে বসে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। কোনো ফল আসে না তাতে।

আমার বাবার সাথে এই বেদে সর্দারের ছিল বেশ  ভালো সম্পর্ক। আমাকে চিনতো। খাতির পাওয়ার জন্যে প্রায় সারাদিন ওনার আসে পাশে ঘুর ঘুর  করা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে চা খাওয়াতে চাই, খেতে চায় না। উল্টা আমাকেই খাইয়ে ছাড়ে।

প্রায় দু সপ্তাহ পর আমাদের ভাব হলো, কথা শুরু হলো। সুযোগ বুঝে মনের কথাটা বললাম তাকে। আমি বেদে হবো।

খুব একটা অবাক হলো না বেদে সর্দার। স্বাভাবিক ভাবে নিলেন। প্রশ্ন করলেন তা তুমি কি ভাবে বেদে হতে চাও? তোমার বাবা মা তো বেদে না! বললাম আমার প্ল্যান আছে।  আগ্রহ ভরে জানতে চাইলেন কি সে প্ল্যান।

বেদে মেয়ে বিয়ে করবো। জানতে চাইলেন কোনো পছন্দ আছে কিনা? বললাম না – কি ভাবে বলি – ওনার মেয়েটাই আমার পছন্দ! বোধ হয় আমার মনের ভাষা তিনি পড়তে পারছিলেন খুব সহজ ভাবে – বললেন – আমার মেয়েটাকে পছন্দ হয়? কিছুক্ষন চুপ থেকে মাথা নাড়লাম। বললেন “ঠিক আছে আমি দেখছি – আমার মেয়েটা রাজি কিনা – সেটাও কিন্তু দেখতে হবে” আমি বললাম ঠিক আছে।

প্রতিদিন বেদে সর্দারের কাছে আছি – জবাবের অপেক্ষা করি। জবাব আর মিলে না। হঠাৎ শুনলাম বেদেরা আগামী কাল চলে যাবে খিলা বাজার ডাকাতিয়া ঘাট ছেড়ে।

ততোদিনে বেদে সর্দারকে মামা ডাকা শুরু করে দিয়েছি। চা দোকানে পেয়ে মামাকে ধরলাম। বললাম “মামা কিছু বললেন না তো!” মামা হেসে আমাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরলেন। ডাকাত ডাকাত চোঁখ দুটিতে একটু মায়া টেনে বললেন – তুমি এখনো অনেক ছোট – আমার মেয়েটাও ছোট, একটু বড় হও – আমি মনে রাখবো। ভেবে দেখবো।

মনটা খুব ছোট হয়ে গেলো। সারা দিন আর বাসা থেকে বের হইনি। আমার আর এ জীবনে বেদে হওয়া আর হলো না। বেদেরা ছোট থাকতেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। আর মামা বলছে আরেকটু বড়  হতে। আমি বড় হতে হতে তো এই মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে অন্য কারো সাথে। আমি আর বেদে হতে পারলাম না।

বিকালে স্কুল মাঠে খেলতে যাবার আগে আব্বার সাথে দেখা হয়ে গেলো আমাদের ফার্মেসিতে। আব্বা আমার মন খারাপ দেখে মুশকি হেসে বললেন “কিরে – বেদেরাতো চলে গেলো – তোকে নিলো না ?”

কি আর বলবো পুরা পৃথিবী যেন আমার মাথার উপর ভেঙে পড়লো। বেদে মামাটা, এতো খারাপ, এতো বেঈমান! প্রতিজ্ঞা করলাম – যতদিন বেঁচে থাকবো এই মামার সাথে আর কখনো কথা বলবো না।

প্রায় ৯/১০ বছর পর যখন এই বেদে মামা’টার খোঁজ নিয়েছিলাম। অবাক হলাম, ওই সময়ের প্রায় সবাই চিনেন তাঁকে। শুনেছি, সেই একমাত্র মেয়েকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে কাকে যেন খুন করে ফেরারী জীবন যাপন করছেন এখন। নৌকার সাথে, দলের সাথে তিনি এখন আর আসেন না।

ওই বেদে দলের সর্দার অন্য কেউ এখন।