মানিকের যুদ্ধ – ১

একটি অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় আদিবাসীদের গল্প দিয়েই শুরু করি। ১৯২০ বা ৩০ শতকের মিশনারীজদের নিয়ে গল্প এটি।

এক আদিবাসী (এবওরিজিনি) দাদা তার নাতিকে গল্প শোনাচ্ছিল। এক ভোরে তিনি দেখলেন, কয়েকজন সাদা (British) হঠাৎ সমুদ্রের দিক থেকে উদয় হয়ে সমুদ্র পাড়েই তাঁবু খাটিয়ে ঘর বানাতে শুরু করলো। ঘরটা দাঁড় করাতেই তাদের সারাটা দিন চলে গেলো । সন্ধ্যা হতে না হতেই সবাই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এবং ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লো। খাবার সংগ্রহে যাবার মতো শক্তি বা সাহস তখন আর কারোরই রইলো না। শেষ পর্যন্ত সবাই বাকি রাতটা না খেয়েই কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলো।

অন্যদিকে, এক আদিবাসী যুবক সকাল থেকেই সেই মিশনারীজদের লক্ষ্য করছিলো দূর থেকে। বিকেলেও মিশনারীজদের টানা একই ধরনের বিশ্রাম-হীন কাজ দেখে খুব মায়া হল তার। সে ঘর থেকে মাছ ধরার লাঠিটা নিয়ে সমুদ্রে গেলো মাছ ধরতে। বৌকে বলে গেলো – ঐ পরদেশী মেহমানদের জন্যে কিছু ভাল মন্দ শাক -সবজী রান্না করতে । অল্প ক্ষণের মধ্যেই বেশ কটি বড় বড় মাছ নিয়ে ফিরে এলো সেই যুবক। রাতের আগেই বিশাল ভোজের আয়োজন সম্পন্ন হয়ে গেলো মিশনারীজদের জন্যে।

সন্ধ্যায় যুবক আর তার বৌ অতি কষ্টে বিশাল খাবারের বহর নিয়ে হাজির হল মিশনারীজদের তাবুতে। মিশনারীজরা যতো না অবাক হল, তার চেয়ে বেশি খুশী হল খাবার দেখে। সাদরে গ্রহণ করলো দুজনকেই। পরিচয়ের পালা শেষ হতে না হতেই এবার শুরু হল খাবারের প্রস্তুতি। নিয়ম অনুযায়ী সবাই খাবার সামনে নিয়ে হাত তুলল মোনাজাতের ভঙ্গিতে। গডের অনেক প্রশংসা করা হল । এবং শেষে বলা হল ‘Thanks god for sending us this delicious food’।

দাদা নাতিকে বললেন, আদিবাসী catch fish, আদিবাসী fry fish, আদিবাসী carry fish (to missionaries), no thanks to আদিবাসী, thanks to god! সাদাদের কখনোও বিশ্বাস করোনা, এরা খাবে তোমার, ধন্যবাদ দিবে গডকে!

বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ? আ-জীবন আমার যুদ্ধ আমার নিজের সাথে। এটা কাদের যুদ্ধ ছিল? কাদের বিরুদ্ধে ছিল? কেন ছিল? কারা আমাদের সাহায্য করলো? কাদেরকে আমরা সন্মান দিলাম? কাদের কে দিলাম ধন্যবাদ? এরা কারা হল আমাদের প্রতিনিধি? কারা সংসদে? কাদের হাতে বিশেষ বাংলাদেশী পাসপোর্ট? আ-জীবন আমার যুদ্ধ আমার নিজের সাথে। এ যুদ্ধে জয় ছাড়া অন্য কোন পথ আমার জন্যে খোলা নেই এখন। এটাই প্রজন্মের দাবী, আমি নিশ্চিত।

স্বাধীনতার বছর আমার বয়স ছিল খুবই কম। তখন আমি পাঁচ বছরের শিশু মাত্র। বেশ কিছু-বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ১৯৭১-এর তেমন কিছু-মনে নেই। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা খুবই ছোট্ট একটা উপশহরে, যেখানে সপ্তাহে দুবার হাট বসতো। গ্রাম থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন সেই উপশহর। শ’খানেক দোকান এবং তিন চার’টা বাসা (পরিবার) নিয়েই আমাদের ছিল বসবাস। আমাদের প্রান্তে মাত্র দুটি বাসা, ডাক্তার ফ্যামিলি আমরা আর তার পাশে বেশ বড় কাপড় ব্যবসায়ী ফ্যামিলি।

বাবা যদিও হাতে অস্ত্র-নেননি কখনো, তবুও তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রায়ই মুক্তিবাহিনীর গোপন মিটিং বসতো আমাদের বাসায়। কাপড় ব্যবসায়ী খালু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, তাই অন্য ধরনের মিটিং বসতো তাদের বাসায়। যুদ্ধের শেষের দিকে পাক বাহিনী যখন আমাদের বাসা তল্লাশি করতে আসে, তখন আমরা সবাই পালিয়ে গিয়েছিলাম নৌকা করে, বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে। পাশের বাসার সেই খালুই আমাদের ঘরবাড়ি দেখে শুনে রাখতেন সব সময়। এবারও তিনি পাক বাহিনীকে পোড়াতে দিলেন না আমাদের বাসা, কিন্তু আসবাব পত্র রক্ষা করতে পারলেন না। সব ঘর থেকে বের করে এনে পোড়ানো হল তাঁর সামনেই। যাক সে সব কথা।

১৯৭১ সালের মধুর কণ্ঠ যা এখনো আমার কানে ভাসে ‘‘আকাশ বানী কলকাতা …খবর পড়ছি নীলিমা স্যান্নাল’। আব্বার বিশাল বড় রেডিওর খবর শুনতে আসতো আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার নানান বয়সের প্রচুর লোক। আমিও আব্বার কোলে গিয়ে বসতাম অন্য সবার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্য। খবরের চেয়ে ওটাই আমার কাছে বেশী প্রিয় ছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে দুএকটা সংবাদের আবছা আবছা প্রতিক্রিয়া এখনোও আমার মনে আছে।

১৯৭২ সালের প্রথম থেকে আমার বড় ভাই বেলায়েত হোসেন ‘বাতায়ন‘ নামে একটি দেয়াল পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। হাতে লেখা মাসিক পত্রিকাটি বাবার চেম্বারের বাইরের দিকের দেয়ালে বেশ বড় যায়গা জুড়ে পেস্ট করে লাগানো হতো। পলিথিন দিয়ে ঠেকে দিয়ে, রাতে নিচে লাগাতেন বেশ ক’টা হেজাক লাইট (কেরোসিনের বেশ উচ্ছল বাতি)। প্রতি হাট বারের রাতেই পাঠক সংখ্যা হতো সব চেয়ে বেশী। আমি এখনো ১৯৭২ বা ১৯৭৩-এর বেশ কিছু লেখা বা পাঠক সমাবেশের কথা মনে করতে পারছি। সম্ভবত ১৯৭২ এর শেষের দিকে এর একটি মুদ্রণ সংকলন বেরিয়েছিল ‘বাতায়ন‘ নামেই। বাতায়নের প্রথম সংখ্যার উপ-সম্পাদকীয় কলামের শিরনাম ছিল ‘মানিকের যুদ্ধ‘। বিষয়টি শুনেছি, কিন্তু পড়ে দেখার মতো সামর্থ্য এবং পরে সুযোগ আমার কখনো হয়নি। পড়াশুনার জন্যে ঢাকাতেই থাকতে হতো বছরের বেশীর ভাগ সময়। ১৯৮২ সালের দিকে আমি যখন সিলেট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ী আসি, আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছিলো ‘এত কম বয়সে – আমি আবার কি যুদ্ধ করেছি!’ ১৯৭১-এ লবণের দাম খুব বেড়ে গিয়েছিলো। একসময় এমন হল যে সবখানে লবণ পাওয়াও যেতো না। ‘মানিকের যুদ্ধ’ সম্পাদকীয়তে সম্পাদক বর্ণনা করেছিলেন, বাঙ্গালী যে যার অবস্থানে থেকে কে কীভাবে যুদ্ধ করেছিলো পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। আমার যুদ্ধ ছিল লবণের বিরুদ্ধে। খাবো না লবণ। মা নাকি অনেক বলে কয়েও আমাকে মানাতে পারেননি সে সময়।

(চলবে)