হে প্রিয় বন্ধু – বন্ধুত্ব থেকে যায় আজীবন

লোহ্ ফঙ ওয়া। মালয়েশিয়ান চাইনিজ। আমার মালয়েশিয়া অফিসের  সহ কর্মী এবং আমি আর “মিস লোহ্” একই কক্ষ ভাগাভাগি করে বসতাম।  পাঁচ ছয় বছর এই ভাবেই  অফিস করেছি আমরা। আমার অনেক নিকট বান্ধবী। কিছু দিন যেতে না জেতেই সে হয়ে গেলো আমাদের পারিবারিক বন্ধু।  রোহিত এবং রৌশনের ও বন্ধু হয়ে গেলো সে। 

১৯৯৬ এ আমি মালয়েশিয়া ট্রান্সফার হলাম।  আমাদের অফিস রাজধানীর কুয়ালা লামপুর  শহরে, জালান রাজা লাউট সড়কে। দিল্লীর পর এটা আমার দ্বিতীয় শহর – দেশের বাইরে কর্মস্থল। পরিবার ছাড়া এসেছি – কোম্পানীর ড্রাইভার বিমান  বন্দর থেকে সোজা অফিসে নিয়ে এলো। 

এবার পরিচয়ের পালা – ৪ জন অস্ট্রেলিয়ান, ৩ জন মালয়েশিয়ান মালে, ৬ জন মালয়েশিয়ান চাইনিজ, ৪ জন মালয়েশিয়ান তামিল, মালয়ালম। ছেলে আমি সহ মোট ৬ জন।  সবাই খুব ঘটা করে বরণ করে নিলো এবং জানাতে ভুললো না যে – অফিসে  আমি হলাম সবার চেয়ে ছোট।  এতএব লাজুক হলে চলবে না – কথা বলতে হবে – সবার সাথে মিশতে হবে।  অ্যাডমিন, একাউন্টস আর অটোক্যাড ড্রাফটিং সবাই চাইনিজ। 

মিস লোহ্ খুবই রক্ষনশীল মেয়ে। সিনিয়র অটোক্যাড ড্রাফট পারসন – বেশ মোটা অংকের মাইনে পায়। সব সময় সিরিয়াস। কাজের বাইরে খুব একটা কথা বলে না। কিছু দিনের মধ্যেই আমি সিগারেট খোর গ্রুপের মধ্যমনি হয়ে গেলাম। ১১ তলায় অফিস – অফিস থেকে বেরিয়ে  সিঁড়ির গোড়ায় বসে আমরা সিগারেট খেতে আসতাম ২/৩ ঘন্টা পর পর।  তিন জন মেয়ে আমি সহ চার্। জীবনে এই প্রথম মেয়েদের সাথে বসে সিগারেট খাচ্ছি। লোহ্ সিগারেট খেত না কিন্তু আমার এই সিগারেট খাওয়া মোটেই পছন্দ করতো না।  চাইনিজদের সাথে এর আগে কখনো কোন কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই আমার। 

মাস ছয়েকের মধ্যে বেশ খাতির হলো লোহ্ এর সাথে আমার।  আমাকে সীমিত আকারে শাসন শুরু হলো।  বিশেষ করে সিগারেট নিয়ে। আমি হাসতাম আর বলতাম – কমিয়ে দিয়েছি – ছেড়ে দিবো।  আমার দেখা মতে চাইনিজরা নিজেদের মধ্যেই বন্ধুত্ব করে বেশির ভাগ। বাইরের কাউকেই তেমন একটা বিশ্বাস করে না। 

আমার একটা ছোট্ট কাজ পড়লো অস্ট্রেলিয়া তে।  তিন মাসের। মালয়েশিয়া  ফিরে গিয়ে যে দিন প্রথম অফিস গেলাম।  হটাৎ করেই লোহ্ আমার উপর তার সমস্থ রাগ ঝেড়ে বসলো। আমি পুরাই থ! তিন মাসে কোনো যোগাযোগ কেন করিনি, ফোন কল ফ্রি, ফোন দেই  নি। অথচ সেই আমার তিন মাসের অফিস ব্যাকআপ ছিল।   সে বার অনেক ক্ষমাটমা  চেয়ে পার পেয়েছিলাম। আমি কখনো তার এই রূপ আগে দেখিনি।  সে অনেক চাপা স্বভাবের মেয়ে। 

অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার জেনারেল ম্যানেজার চাপ দিচ্ছে – অস্ট্রেলিয়া তে স্থায়ী ভাবে চলে যাবার জন্যে।  আমার মালয়েশিয়ান কান্ট্রি ম্যানাজার চাচ্ছে, আমি এই মুহূর্তেই অস্ট্রেলিয়া না যাই।  তার পর ও ভাবলাম এপলাই করে দেখি, দেখা যাক কি হয়! এদিকে মালয়েশিয়াতে কোম্পানির করা স্বাস্থ বীমা খুব একটা ভালো না – তার উপর রওশন যমজ বাচ্চার মা হবে ছয় সাত মাস পর। হাসপাতালের খরচ চালাবার মতো সামর্থ তখন ও আমার হয়ে উঠেনি।  স্বাস্থ বীমা প্রেগনেন্সি  কভার করবে না। 

হিংসা।  IELTS রেজাল্ট হাতে, অফিসে এসে যখন  লোহ্ কে জানালাম – খুব একটা খুশি হতে দেখলাম না।  নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি নেচে নেচে সবাইকে জানালাম এবং দেরি না করে মাইগ্রেশন ফর্ম নিয়ে বসলাম কালকেই জমা দিয়ে দিবো। 

সকালে অফিসে ঢোকার আগে ব্যাঙ্ক একাউন্ট চেক করলাম।  চার হাজার রিঙ্গিত নেই – অ্যাডভান্স চেয়ে অফিসে যে টাকা চেয়েছি তা তখনো ঢুকে নি।   মাইগ্রেশন ফর্ম জমা দেয়ার সময় এই টাকার প্রয়োজন। 

অফিস ঢুকে মন খারাপ করে কাজ শুরু করলাম।  কিছুক্ষন পর লোহ্ এলো। জানতে চাইলো হটাৎ এতো চুপচাপ কেন।  বললাম তেমন কিছু না।  অনেক চাপাচাপির পর বললাম দুই হাজার রিঙ্গিতের প্রয়োজন ফর্ম জমা দেয়ার জন্যে।  কিছুক্ষন চিন্তা করে বললো – থাকলেও তোমাকে দিতাম না।  তার পর, অনেক কথা, অনেক হাসাহাসি – কিছুক্ষন হাসিহাসি করে বিষয়টা হালকা করে নিলাম।  বললাম অসুবিধা নেই অ্যাডভান্স পেলে সাবমিট করবো।  দু’এক দিনের ব্যাপার ই তো!

দুপুরে বাইরে খাবে লোহ্ – আমাকে বলে গেলো।  ঘন্টা খানেক পর ফিরে এলো সাথে ড্রাইভার কামালকে নিয়ে।  হাতে খাম – খামটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো – কামালকে সাথে নিয়ে গিয়ে ফর্ম তা জমা দিয়ে এসো। 

৭ দিনের মাথায় অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন থেকে ফোন এলো – ভিসা হয়ে গেছে।  পাসপোর্ট জমা দিতে হবে।

 যে দিন ভিসা পেলাম সে দিন থেকেই কেন জানি সবার অপ্রিয় হয়ে গেলাম।  লক্ষ্য করলাম কয়েকজন তো আমাকে এড়িয়ে চলাই শুরু করলো। তিন মাস ছিলাম – আমার প্রিয় কান্ট্রি ম্যানেজার “কালাই চেলভান” (যিনি আমার জন্যে অনেক কিছু করেছিলেন), তিনিই আমার সাথে প্রয়োজন না হলে কথা বলতেন না।  

সবার এমন আবেগী ভালোবাসা দেখে – সত্যি আমার অনেক কষ্ট হতো।  সাদা এবং দু একজন চাইনিজ ছাড়া প্রায় সবাই কে আমি কষ্ট দিয়ে এসেছিলাম।  কারণ কোনো একসময় আমি সবাইকে বলেছিলাম – আমি মালয়েশিয়াতে আরো তিন/চার বছর থাকবো!

বিদায় অনুষ্ঠান হলো  – প্রচুর গিফ্ট পেলাম।  কথা দিলাম – প্রতি বছর বাংলাদেশে যাবার সময় – সবার সাথে দেখা করে বাংলাদেশে যাবো! অস্ট্রেলিয়া আসার পর বাংলাদেশে প্রথম বার যেতে আমার সাত বছর লেগেছিলো। 

এর ই মধ্যে লোহ্ একবার এসে দেখে গেছে আমাদের। হটাৎ একদিন আমাকে ফোন করে বললো সে সিডনি আর মেলবোর্ন ঘুরতে আসবে – আমাদের দেখতে আসতে চায় – যমজদের দেখতে চায়।  আমি বললাম আসো  – আমি ছুটি নিয়ে রাখবো।  বললো দু দিন থাকবে।  আমি খুব রাগ করলাম – বললাম এ কেমন কথা! 

নির্ধারিত দিনে সে সিডনি থেকে ফোন করে বললো ক্যানবেরার বিমানে কিছুক্ষনের মধ্যে উঠবে – বললাম দেখা হবে এয়ারপোর্টে।  বাসায় নিয়ে এলাম – বাসায় আসতে আসতে প্রায় রাত বারোটা বেজে গেলো।  রোহিত, রোহান, মোনা সবাই সজাগ। কেউ ঘুমায়নি। লোহ্ জন্যে অপেক্ষা করছে সবাই।  রাত তিনটা পর্যন্ত আড্ডা – সবার জন্যে দামি দামি উপহার এবং আমার জন্যে ছিল প্লেনে দেয়া বাদামের পেকেট। 

আশ্চর্যের বিষয় হলো – লোহ্ আমাদের বাসায় ছিল ১০ দিন! ২ দিন সিডনি, ২ দিন মেলবোর্ন ঘুরে মালয়েশিয়া ফিরে গিয়েছিলো। 

২০০৬ এর পর যখন মালয়েশিয়া হয়ে বাংলাদেশ যেতাম – লোহ্ এর সাথে আমার দেখা হতোই। গত বছর পাঁচেক সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছি – দেখা হয় নি লোহ্ এর সাথে। 

বাবাহীন সংসারে, চির কুমারী লোহ্ থাকতো মায়ের সাথে। এক মাত্র ভাই থাকতো আলাদা বাসায়। মা মারা যাবার পর একা একাই থাকতো বাড়িতে।  ভীষণ অন্তর্মুখী মেয়েটি শেষে চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছিলো – কোথাও বের হতো না আর। 

হার্ট স্ট্রোক করে দু দিন পড়ে ছিল বেড রুমের মেঝেতে। দুদিন পর ভাই এসে তাকে বাঁচাতে পারলেও – পুরা শরীর পেরালাইজড হয়ে গিয়ে ছিল – বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো।  কোনোটাই ফিরে আসেনি আর। একাকী, নিঃসঙ্গ অবস্থায় দু বছর পর কোনো এক নার্সিং হোমে সবার অজান্তেই শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ আমাদের এই ভালোবাসার মানুষটি। 

লোহ্ ফঙ ওয়া। জীবনে প্রথম কোনো ঘনিষ্ট বন্ধু কে হারালাম।  দোয়া করি ওপারে ভালো থেকো বন্ধু আমার। 

দেখা হবে আবার আশা করি।