বুয়েটে আমার সিট বরাদ্দ হয় ড. এম এ রশীদ হলে। আর রুম দেওয়া হয় ২০২। রুম ঠিক হওয়ার পর এলাকার বড় ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানলাম ওই রুমে এক ‘লিডার’ থাকেন।
ভাইয়ারা আরো বললেন উনি মানুষ হিসেবে খুবই ভালো, তবে একটাই সমস্যা উনার রুমে অনেক গেস্ট থাকে। এক টার্ম কষ্ট করে থাকো, পরে রুম চেঞ্জ করে নিও। আগের বছরও একই ঘটনা ঘটেছে। প্রথম কয়েকদিন ঢাকা মেডিকেলের ফজলে রাব্বি হলের বন্ধু রেজাউল ইসলাম হিটু আর সোহেল আশকার চয়নের ১১৩ নম্বর রুমে, তারপর বুয়েটের বড় ভাইদের রুমে থাকলাম কয়েকদিন।
পরে একদিন ভাইয়ার দেখা পেলাম এবং আমাদের ব্যাপারটা বললাম। উনি বললেন কোনো সমস্যা নাই, উঠে পড়ো। আমিতো মহাখুশি। বিছানা-বালিশ নিয়ে সেদিনই উঠে পড়লাম এবং সারা বুয়েট জীবন ওই এক রুমেই পার করে দিলাম। সমস্যা যে কিছু হতো না তা নয়, মাঝে মাঝে উনার গেস্টের সঙ্গে ডবলিং করতে হতো আর একবার মাত্র অন্য রুমে ঘুমাতে যেতে হয়েছিলো।
কিন্তু উনি যদি এই একই পোস্ট অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হোল্ড করতেন তাহলে উনার জন্য আলাদা রুম থাকতো, উনাকে লেভেল ওয়ান, টার্ম ওয়ানের ছেলেদের সঙ্গে রুম শেয়ার করতে হতো না। উনি আমাদের কি ঝাড়ি দিবেন উল্টো মাঝে মাঝে আমরা উনাকে ঝাড়ি দিতাম। উনি অম্লান বদনে শুনতেন, কিন্তু কিছুই বলতেন না।
পরবর্তীতে উনি একজন সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। সৃষ্টিকর্তা উনাকে দীর্ঘায়ু দান করুন এবং অন্য লিডারদেরও দেখেছি তারা কখনই জুনিয়র বা অন্য দলের কর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন না। লেভেল ওয়ান, টার্ম ওয়ানের বা লেভেল ওয়ান, টার্ম টুয়ের কথা, একদিন বুয়েটের গেটে গিয়ে দেখি গেট খোলা। কিন্তু কিছু বড় ভাই গেটের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেট বন্ধ করে কেনো গেট বন্ধ তার পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন। আর একদল মিছিল নিয়ে উনাদের ব্যারিকেডের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন আর আসছেন এবং গেট খোলা রাখার পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন।
আমি আমার জীবনে প্রথমবার কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। আমি কি বাংলাদেশে আছি না অন্য কোন দেশে আছি। যেখানে জাতীয় রাজনীতিতে কাদা ছুড়াছুড়ি সাধারণ ব্যাপার, কিছু হলেই একে অপরের মুখ দেখাদেখি বন্ধ, সেই দেশে আমি একি দেখলাম। ঘটনাটা আমার তরুণ মনে খুবই নাড়া দিয়েছিলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে একটু পরে দেখি দুই দলের লিডার এক কোণায় একসঙ্গে বিড়ি ফুঁকছে আর ফিসফিস করে আলাপ করছে, বিষয়টা কী আমি শুনতে পাইনি। কিন্তু এই সখ্যতা এদেশে সত্যিই বিরল ছিলো।
আমদেরই ফ্লোরের সিঁড়ির অন্য পাশে থাকতেন আমার রুমমেট বড় ভাইয়ের বিপরিত মতবাদের দলের আর এক লিডার। বিকেল হলেই আমরা বেড়িয়ে পড়তাম যার যার ধান্দায়। এমনই একদিন বিকেলে বের হচ্ছি রুম থেকে, দেখি অন্য পাশের ওই লিডার ভাই আমার রুমে এসে উপস্থিত। উনাকে দেখেতো আমি ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম, কারণ দেশের রাজনীতি ততদিনে আরো ঘোলা হয়ে গেছে এবং আগের সেই সহমর্মিতা আর নাই।
উনি এসে আমার রুমমেটের সঙ্গে প্রথমে কুশল বিনিময় করলেন। আমার রুমমেটের থেকে ওই লিডার ভাই সিনিয়র ছিলেন, তাই আমার রুমমেট উনাকে ভাই সম্বোধন করলেন এবং খাতির করে বসালেন। সঙ্গে সঙ্গেই ক্যান্টিন বয়কে ডাকলেন। ওই লিডার ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন কী কী নাস্তা করতে চান? তারপর শুরু হলো তাদের গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর। ওইদিন আমার তেমন কোন কাজ না থাকায় তাড়াতাড়ি রুমে ফিরলাম, সন্ধ্যার পর পরই দেখি তখনো তাদের গল্প শেষ হয়নি।
কোন এক ইউকসু নির্বাচনের আগে আমাকে এসে ধরলো আমাদের লেভেলের-ই কিছু বন্ধু, বলল তোকে কাউন্সিলর হতে হবে। আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম এই দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনই হয় না, সেই দেশেরই একটা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলরদের ভোটে প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে। যাই হোক পরবর্তীতে আমি অসময়ে বাড়ি চলে আসাতে আর কাউন্সিলর হিসেবে ভোট দিতে পারিনি। তখন নিয়ম ছিলো নিজ দলের মধ্যে একাধিক প্রার্থী নির্বাচন করতে চাইলে কাউন্সিলররা ভোটের মাধ্যমে একজনকে মনোনয়ন দিতেন। তারপর উনি মূল নির্বাচনে প্রার্থীতা করতে পারতেন।
হলে রাতের বেলা একই সময়ে সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র-সংগঠন মিছিল করছে, কারো সঙ্গে কোন মারামারি হচ্ছে না। এই ব্যাপারটাও আমার কাছে ছিলো চরম আশ্চর্যের। যদিওবা কোন কারণে দুদলের মিছিল মুখোমুখি হয়ে যেতো তখন যে যে যার যার সাইড নিয়ে চলে যেতো। একদল এই হলে সম্মেলন করছে তো অন্যদল অন্য হলে, কি সুন্দর বোঝাপড়া!
বুয়েটে সনি মারা যাবার পর আমি একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তারপরও পরিস্থিতি অতটা খারাপ হয়নি। মিছিল হলো, যারা যারা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলো তাদের রুমে আক্রমন হলো। কিন্তু আবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে ওই মানুষগুলো তখন রুমে থাকলেও তাদের উপর আক্রমন হয়নি। সেই রাগ গেলো দরজা-জানালা-বিছানার উপর দিয়ে। ওই অভিযুক্ত মানুষগুলোর বেশিরভাগই ছিলো আমাদের হলের বাসিন্দা, তাই ব্যাক্তিগতভাবে আমি তাদের চিনতাম। লিডারদের মধ্যে তারা সত্যিকার অর্থেই ছিলো একটু বেশি বেয়াড়া টাইপের, কিন্তু সংখ্যায় তারা ছিলো হাতেগোনা কয়েকজন।
যেমন- ক্যান্টিনে খেয়ে সময়মতো টাকা পরিশোধ না করা, জুনিয়রদের সঙ্গে তুই-তোকারি ভাষায় কথা বলা ইত্যাদি। কিন্তু তারপরও শুনিনি তারা কোন জুনিয়র বা অন্য দলের নেতা-কর্মীদের গায়ে হাত তুলেছে। কিন্তু আমরা যখন বুয়েট থেকে বের হয়ে আসি সেই ২০০৪ সালে তখন বুয়েটের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বুয়েটের রাজনীতি তখন সনি হত্যার জন্য দায়ী বুয়েটের এক ছাত্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করা শুরু করে দিয়েছে।
বুয়েটে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ হয় আর তার বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডাররা। সনি-হত্যার সঙ্গে জড়িতরা তাদের সেই একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাগ বসাতে চেয়েছিলো অস্ত্রধারী গুন্ডা ভাড়া করে। আর তাদের সেই সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের বলি হয় মেধাবী ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। খুনিদের সঙ্গে কিছু সাগরেদও ছিলো সরাসরি এই ঘটনার ইন্ধনদাতা। মহামান্য আদালতের রায়ে এদের বেশিরভাগেরই সাজা হয়। যদিও তারা সাজা ভোগ না করে দেশ ত্যাগ করে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে সনি-হত্যার পর বুয়েটের সাধারণ ছাত্র সমাজ রোষে ফেটে পরে এবং অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। তখন আবার একদল ছাত্র যারা খুনিদের সঙ্গে একই দলের ছাত্র-সংগঠন করতো তারা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সেইসব স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করতে থাকে। এরা সবাই তখন বুয়েটের বিভিন্ন বর্ষের ছাত্র ছিলো। পরবর্তীতে তাদের অনেকেই সরকারের প্রভাবে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের উচ্চপদে চাকরি পায় এবং এখন পর্যন্ত তারা সেইসব চাকরিতে বহাল তবিয়তেই আছে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমি এতকিছু কিভাবে জানি? এর উত্তর হচ্ছে সনি-হত্যার পর যখন বুয়েটের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা রোষে ফেটে পড়ে তখন সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো আমাদের ব্যাচেরই কিছু ছেলে। তখন আন্দোলন করাটা ছিলো নেহায়েত বোকামি, কারণ খুনিরা ছিলো তখনকার সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের। তাই বাংলাদেশের সরকার থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বুয়েটের প্রশাসন সবই ছিলো তাদের ফেভারে। তাই এতবড় হত্যাকাণ্ডের দিনও রাতে সন্ত্রাসীরা তাদের সাগরেদদের নিয়ে এম এ রশিদ হলের একটা রুমে যথারীতি তাস খেলছিলো।
তারা ঘুণাক্ষরেও ধারণা করতে পারেনি যে বুয়েটের আঁতেলমার্কা সব ছাত্র একজোট হয়ে তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু বুয়েটের ছাত্ররা তাদের সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিলো। যদিও তার ফল হিসেবে অনেক ছাত্রকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয় ক্ষমতাশীল ছাত্র-সংগঠনের কর্মীদের হাতে। এছাড়া বুয়েট প্রশাসন তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে বুয়েট থেকে বহিষ্কার করে। আর একবার বহিষ্কার হলে আবার স্বাভাবিক ছাত্র-জীবনে ফিরে আসাটা ছিলো প্রায় অসম্ভব পর্যায়ের কাজ।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অনলাইনের এই যুগে সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া গেছে। একজন এখন থাকে কানাডাতে। ফেইসবুকে তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের হাসিমুখের ছবি। বেশ কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ থাকে অস্ট্রেলিয়াতে এবং ভালো জব করে। ফেইসবুকে রয়েছে তাদেরও সপরিবারে হাসিখুশি ছবি। তবে সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে তাদের বিপরীত মতাবলম্বীরাও রয়েছে তাদের বন্ধু তালিকায়। আসলেই রাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু নেই যেন।
সেই থেক বুয়েটে মারামারি চল শুরু হলো। এরপর আমরা একসময় পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়ে আসলাম। বুয়েটে আমরা যারা পড়েছি তারা বুয়েটের যেকোন বিষয়েই অনেক সংবেদনশীল মনভাবাপন্ন। বুয়েটের কোন ভালো খবরে যেমন আমরা উল্লসিত হই অনলাইনে এবং বাস্তব জীবনে তেমনি আবার খারাপ খবরে মুষড়ে পড়ি। এর আগেও একজন বুয়েট ছাত্রকে হত্যার ঘটনায় আমরা খুবই অবাক হয়েছিলাম, কারণ সনি হত্যার পর বুয়েটে এমন অপকর্ম আর কেউ করার সাহস পায়নি। আর গতকাল পেলাম আবরার হত্যার খবর। একজন বুয়েটিয়ান হিসেবে খুবই মুষড়ে পড়েছি।
আরো বেশি অবাক হয়েছি যে প্রক্রিয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি জানি না যারা হত্যা করেছে তারা ঠিক কোন ধরনের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের আশায় সেটা করেছ। কারণ আমি দেখেছি বুয়েটের ছাত্র সংগঠনের সবচেয়ে বড় লিডারও মূল ছাত্র সংগঠনের কমিটিতে পঞ্চাশ একশো জনের যে সহ সভাপতি এবং সহ সাধারণ সম্পাদকের তালিকা থাকে তার একেবারে নিচের দিকে স্থান পায়। তাদের উপরে অনেক অখ্যাত কলেজের ছাত্র-সংগঠনের নেতারা স্থান পেয়ে যায়।
আর এই ব্যাপারটা বুয়েটের আগেকার আমলের ছাত্রনেতারা জানতেন, তাই হয়তোবা নিজেদের মধ্যেকার সুসম্পর্ক কখনই নষ্ট হতে দিতেন না, কারণ কর্মজীবনে গিয়ে দেখা যাচ্ছে হয়তোবা তাদেরকে একই অফিসে কাজ করতে হচ্ছে। অথবা বিপরীত মতাবলম্বী ছাত্র-সংগঠনের বড় ভাইয়ের কাছেই যেতে হচ্ছে চাকরির জন্য। আসলে বুয়েটের সব ছাত্র-ছাত্রী মিলিয়ে বুয়েট একটা পরিবারের মতো।
আমি যেদিন প্রথম ঢাকা শহরে আসি সেদিন গাবতলিতে পা দিয়েই বন্ধুদের বলেছিলাম আমাকে কুষ্টিয়াতে ফিরে যাবার টিকেট করে দে আমি বাড়ি ফিরে যাই। এই গন্ধযুক্ত শহরে আমার থাকা হবে না। বুয়েটে ভর্তির সুযোগ না পেলে কথাটা হয়তোবা সত্যিই হয়ে যেতো, কারণ আমি বুয়েটের ছায়াঢাকা সুনিবিড় ক্যাম্পাসকে বলতাম রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে এক টুকরো গ্রাম। ঠিক একইভাবে রাজধানীর রাজনৈতিক উত্তাপও খুব একটা বুয়েটকে স্পর্শ করতো না, তাই বুয়েটের পরিবেশটা আসলেই ছিলো আটপৌরে গ্রামীণ।
আর বুয়েটের শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রী সবাই মিলে ছিলো একটা একান্নবর্তী পরিবারের মতো। দিনেদিনে সেই পরিবেশ নষ্ট হয়েছে যেটা আসলে আমাদের দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু তবু ভাবতে খুবই খারাপ লাগে, কারণ বুয়েট একজন বুয়েটিয়ানের কাছে সবচেয়ে আবেগের জায়গা।