তাস বস্তুটার সঙ্গে আমার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় এত বেশি সম্পর্কিত যে তার একটু গুণগান না করলেই নয়। তাস খেলা নিয়েই আজ আমার লেখা ‘গরিবের ক্যাসিনো’।
তাসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বাড়ির রাখালের হাত ধরে। মাঝে মাঝে শখ করে উনার সঙ্গে মাঠে গরু চড়াতে গেলে উনি তাস খেলাটায় আমার হাতেখড়ি দিয়ে দেন। সেটা ছিল নিউজপ্রিন্টের একেবারেই সাদামাটা ধরনের তাস। উনি আমাকে জোড়া মেলানো খেলাটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও উনি একেবারেই লেখাপড়া জানতেন না।
নতুন ও নিষিদ্ধ শেখার আনন্দ ও উত্তেজনায় এরপর প্রায়ই উনার পিছু নিতাম। তাস খেলাটাকে তখনকার দিনে সহজ বাংলায় ‘জুয়া খেলা’ বলা হতো, যদিও সেটা বেশিরভাগ সময়ই টাকা ছাড়া খেলা হতো। পাড়ার মোড়ে বা মুদির দোকানে মানুষ জড়ো হয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘মেরিজ’ খেলতেন।
আমাদের ছোটদের দায়িত্ব ছিল চারদিকে নজর রাখা। কোন রাস্তা দিয়ে আমার বড় আব্বা (আব্বার নানা আব্বাস আলী মন্ডল, পাড়ার মাতুব্বর) আসছে কিনা? উনার ছায়াও যদি কোনভাবে দেখা যেতো তাহলে ছায়াছবির ম্যাজিকের মতো সবাই চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই হারিয়ে যেতো। এতে করে আমরা বুঝতাম এটা আসলে ভালো খেলা না। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য যে এই নিষিদ্ধ খেলাটাই আমি লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হওয়ার আগে শিখে ফেললাম।
ঢাকাতে হল জীবনের শুরুতেই তাস জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলো বন্ধুদের কল্যাণে। বিশেষ করে চয়ন ভাইয়ের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। এই মানুষটা আমার দেখা সবচেয়ে স্মার্ট ডাক্তার, যে কিনা ডাক্তারির কঠিন ও রসকষহীন বিষয়ের চোখ রাঙ্গানিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাহস করেছিল এবং আমি যতদূর জানি এখন পর্যন্ত উনি সেই সাহস ধরে রেখেছেন। উনি ঢাকা মেডিকেলের ফজলে রাব্বি হল থেকে এসে আমাদের এম এ রশীদ হলের ২০০১ নং রুম থেকে বন্ধু পাভেলকে ধরে নিয়ে আমাদের ২০২ রুমে চলে আসতেন। এরপর চলত বিরিতিহীন তাস খেলা।
চলছে তাসের আসর, টিভিতে চলছে বাংলাদেশের ম্যাচচলছে তাসের আসর, টিভিতে চলছে বাংলাদেশের ম্যাচবেশির ভাগ দিনই রাত গড়িয়ে ভোর, সকাল হয়ে যেতো। এমনও দিন গেছে সকাল গড়িয়ে দুপুর চলে এসেছে, কিন্তু আমরা তখনও তাওয়ায় বসে আছি। তিনজনে তো আর তাস খেলা হয় না, তাই এতে আমাদের চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে কখনও বন্ধু জ্যাক আবার কখনও বন্ধু সুদীপ্ত যোগ দিত। তবে বেশিরভাগ সময়ই আমরা ধরে বেঁধে আমার রুমমেট তৌহিদকে নিয়ে বসতাম।
একদিনের কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল শবে-বরাতের রাত। তৌহিদ কেবল এশার নামায পড়ে রুমে এসেছে। একটু পড়ে আবার নফল নামায পড়বে। ইতোমধ্যে চয়ন ভাই আর পাভেল এসে হাজির। ব্যস আর যায় কোথায়? ভুল-ভাল বুঝিয়ে ওকে নিয়ে আমরা মোনাজাতে মানে তাস খেলতে বসে গেলাম। সেই মোনাজাত চলেছিল ননস্টপ একেবারে ফজরের নামায পর্যন্ত। ফজরের নামাযের সময় বেচারা তৌহিদ এত্ত মন খারাপ করছিল যে তা দেখে আমার নিজেরই খারাপ লাগছিল।
আর ও যেহেতু নতুন তাস খেলা শিখেছিল তাই টুয়েন্টি নাইন খেলায় ওর খুবই ভালো হাত পড়তো। এমনও দিন গেছে একই দিনে ও দুই তিনবার চার গোলাম পেয়েছে। কিন্তু ও যেহেতু সৎ ছিল তাই বলে দিত। আমি সবসময়ই নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি, কারণ আমার চারপাশে সবসময়ই কিছু মানুষরূপী ফেরেশতা থাকে তার মধ্যে তৌহিদ অন্যতম। এই মানুষটা না থাকলে আমার হল জীবন কখনোই এতটা আনন্দের হতো না।
এরপর তাস খেলাটা ভালোমত চালু হয়ে গেলে আমার বিছানাটা ক্যাসিনোর টেবিল হয়ে গেলো। আমাদের ৯৮ ব্যাচের বন্ধু সাব্বির, মাসুম, জনি, রাসেল, বেনজির, শাকিল, আমাদের পিঠাপিঠি ব্যাচ ৯৯ এর মাজহার, মাহতাব ছিল আমাদের একেবারে নিয়মিত সভ্য। পরবর্তিতে এসে রুমমেট ফরহাদ এবং ওর বন্ধু মহল যোগ দিয়েছিল। আরো অনেকে ছিল যাদের নামের তালিকা দিতে গেলে এই লেখা আর শেষ করা যাবে না।
হলের অভ্যাসটা বাড়িতে গেলেও পিছু ছাড়ে না। বন্ধু সালাম, বিদ্যুৎ, ছোট নানা জাহিদ, শংকর কাকু আমাদের নিয়মিত খেলোয়াড় হয়ে গেলো। বাড়িতে থাকা অবস্থায় প্রায় প্রতি পূর্ণিমার রাতেই বাড়ির পিছনের খোলা মাঠেই আমাদের তাসের আসর বসতো। আর যখন ওদের কাউকে পাওয়া যেত না তখন আমরা তিন ভাই আব্বাকে বিভিন্নভাবে ফুসলিয়ে আমাদের সঙ্গে বসিয়ে দিতাম এবং সারাদিন চলতো আমাদের সেই তাস খেলা।
আব্বা এবং মেজো ভাই ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে পাকা খেলোয়ার এবং প্রায় প্রতিটা চালই দিত অনেক হিসেব করে। কিন্তু হাত খারাপ পড়লেতো হাজার হিসাব করে খেলেও লাভ হয় না। তাই প্রায় প্রতিবার খেলার শেষে দেখা যেত আমরা লাল কালো মিলিয়ে প্রায় গোটা আটেক সেট দিয়ে বসে আছি। আর আমার বন্ধু আমিনুর, সুমন, মেজো ভাইয়ের বন্ধু তামিম, উপল, ছোট ভাইয়ের বন্ধু পাভেল, সজিব এরাও এসে মাঝে মাঝেই যোগ দিত।
তাসের আসর শেষে ভোরবেলা খানাপিনাতাসের আসর শেষে ভোরবেলা খানাপিনাএরপর হলের জীবন শেষ করে যখন ক্যাম্পাসেরই ছোট ভাইদের সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকা শুরু করলাম, তখনও আবার সেই হল জীবনকে আমরা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসলাম। ছোটভাই সাজিদ, সনি, মইনুল, পার্থ এবং এদের প্রত্যেকের বন্ধুমহল সবাই আমাদের আসরের সদস্য হয়ে গিয়েছিল।
মানে বিয়ে করার পর লেজ কাটার পর সেই অভ্যাসটা ত্যাগ করতে পারি নাই। কিন্তু কাদের সঙ্গে খেলবো? তখন একেবারে হাতে ধরে ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানে আমার গিন্নি থেকে শুরু করে প্রত্যেক শ্যালক, শ্যালিকা, সম্মুন্ধি, মামা শ্বশুর, চাচা শ্বশুর এমনকি নিজের শ্বশুরকেও তাস খেলাটা শিখিয়ে দিলাম। ব্যাস আমাদের আর পায় কে? আমাদের দেখাদেখি মেয়েও তাস খেলতে চাই।
তখন মেয়েকেও শেখানো লাগলো। যখন আর কাউকে পাওয়া যেত না তখন আমরা বাপ-বেটি মিলে বসে যেতাম জোড়া মিলানো খেলতে। সে জোড়া মেলাতে পারুক বা না পারুক সব তাস নিয়ে বলতো বাবা আমি জিতে গেছি। এরপর তাস খেলার নেশা পেয়ে গেলো, প্রায় প্রতি রাত্রেই আমাদের বাপ-বেটির আসর বসা শুরু করলো।
সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ে অস্ট্রেলিয়া এসে তাস খেলার নেশা আরো বেড়ে গেলো। মনে মনে এক সেট তাস খুঁজছিলাম। লাকেম্বাতে বাজার করতে গিয়ে সেই সুযোগ মিলে গেলো। ব্যস, একেতো নাচুনে বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি। আড়াই ডলার দিয়ে কিনে নিলাম, আর বাসায় এনে লুকিয়ে রাখলাম। কিন্তু আমার সত্যান্বেষী মেয়ের চোখকে বেশিদিন ফাঁকি দিতে পারলাম না। সেটা আমার গিন্নী জানতে পেরে যথারীতি আমাদের উপর একচোট নিলেন। একেতো এই মেয়ে পড়াশোনা করে না তার উপর এইসব কিনে দিলে আর পড়াশোনা হবে? এরপর থেকেই চলছে আমাদের তাস খেলা।
এরপর মোস্তফা ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। মোস্তফা ভাই আমাদের এম এ রশীদ হলেই থাকতেন, কিন্তু চারতলায়। তাই উনার সঙ্গে ক্যাম্পাস জীবনে পরিচয় হয়নি। অস্ট্রেলিয়া এসে পরিচয় হলো এবং মনে মনে খুবই আফসোস হতো এমন একজন মাই ডিয়ার মানুষের সঙ্গে আমার হল জীবনে কেন পরিচয় ছিলো না। মোস্তফা ভাইয়ের বাসায় নিয়ম করে শনি এবং রোববার তাসের আসর বসতে শুরু করলো।
আমাদের তাস খেলার দল ভারি হতে থাকলো। দুই মামুন ভাই, তামিম ভাই, পারভেজ ভাই, জাহিদ ভাই, বন্ধু আলম, আমাদের দুই ব্যাচ জুনিয়র সুমনসহ আরো অনেকেই একে একে যোগ দিয়েছিলো তাস খেলার আসরে। আর আমরা যেহেতু নির্মল বিনোদনের জন্য খেললাম, তাই খেলার পাশাপাশি আড্ডাটা হতো অনেক প্রাণবন্ত। সেই আসর দিনে দিনে এমন জমে উঠেছিলো যে তখন আর এক সেট তাসে হতো না। দুই সেট তাস নিয়ে বসতে হতো। অনেক সময় তাস খেলতে খেলতে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলাও দেখা হতো, অনেকটা রথ দেখা এবং কলা বেচার আদলে।
দুপুর থেকে তাস খেলার আসর শুরু হয়ে অনেক সময় মাঝরাত পেরিয়ে যেতো। অনেক সময় এমনও হয়েছে মাঝরাতের পর আমরা সবাই বেরিয়ে পরে সিডনি শহর থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে ভোরবেলায় ঘুমাতে গেছি। তবে বেশিরভাগ দিনই অবধারিতভাবে তাস খেলার শেষে উনার বাসাতেই আমাদের রাতের খাবার খাওয়া হতো। তানজিনা ভাবি আর মোস্তফা ভাই হাসিমুখে আমাদের এই অত্যাচার সহ্য করতেন। আসলে সহ্য করতেন বললে ভুল বলা হবে, উনারা এটা উপভোগই করতেন। উনারা দুজনেই ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়িয়ে বেড়ানো মানুষ।
আমরা যারা নতুন এসেছিলাম তাদেরকে অনেক সময় গায়ে পরে সদুপদেশ দিতেন। আমরা সেটা অনেক সময় না মানলেও দিনশেষে এস বুঝতাম উনারা ঠিকই বলেছিলেন। পরবর্তিতে উনারা বাসাবদল করে অন্য এলাকায় চলে যাওয়াতে আমাদের তাস খেলার এই চাঁদের হাট ভেঙে গেলো। এরপর থেকে আমাদের আর একসঙ্গে হওয়া হয়নি। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে, তাই চাইলেও অনেকসময় এক হওয়া যায় না।
এক জীবনে তাস খেলার পেছনে যে পরিমাণ সময় দিয়েছি সেটা যদি অন্য কোন ক্ষেত্রে দিতাম, তাহলে এতদিনে সেই বিষয়ের আইনস্টাইন বা নিউটন হয়ে যেতাম। অথবা যদি টাকা পয়সা দিয়ে খেলতাম তাও একটা কথা ছিল। যাই হোক, এরপরও তাস খেলা চলবে, যতদিন বেঁচে আছি এবং সুস্থ আছি।
জানি না মৃত্যুর পর কোন জীবন আছে কিনা! যদি থেকে থাকে তাহলে সৃষ্টিকর্তা যেখানেই রাখুন না কেন, আমার একটাই আবদার থাকবে। আমাকে এক সেট তাস দেন আর তিনজন তাস খেলার মানুষ দেন, আর কিছুই চাই না আপনার কাছে।