এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে টেস্টের এক নম্বর অল রাউন্ডার কে?
সাকিব আল হাসান!
আচ্ছা, বলুন তো, আর কোন ক্ষেত্রে আপনি বলতে পারবেন, আমাদের এই মানুষটা পৃথিবীর এক নম্বর!
পৃথিবীর এক নম্বর কথাটার মানে আমরা অনেক সময় বুঝিও না। এভারেস্ট পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়চুড়া, আমাজন পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী। পৃথিবীর সেরা ফুটবলার এই মুহূর্তে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। দুই নম্বর মেসি।
আর টেস্ট ক্রিকেটে এই মুহূর্তে পৃথিবীর এক নম্বর অল রাউন্ডারের নাম সাকিব আল হাসান।
শুধু কি টেস্টে, একটা সময় তো তিনি ক্রিকেটের তিন ফরমেই এক নম্বর অলরাউন্ডার ছিলেন। এই মুহূর্তে ওডিআইতে অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ে তিনি দুই নম্বর আর টিটুয়েন্টিতে তিন নম্বর অলরাউন্ডার। কিন্তু আমরা জানি, হাতের আঙুলটা সেরে উঠলে আবারও মাঠে নামার সুযোগ পেলে সেই হৃতগৌরব তিনি সহজেই পুনরুদ্ধার করতে পারবেন!
সহজ কথাটা কেবল সাকিব আল হাসানের সঙ্গেই যেন সহজেই মানিয়ে যায়।
কিন্তু একটু ঠাণ্ডা মাথায় কি আমরা পুরো ব্যাপারটা একবার ভাবব। আমাদের ঘরের ছেলে, মাগুরায় জন্ম, মাগুরায় শৈশব কাটানো সাকিব আল হাসান (৩১) বহুদিন ধরেই পৃথিবীর ক্রিকেটে এক নম্বর আসনটি ধরে রেখেছেন। র্যাংকিং না হয় বাদই দেয়া গেল, আমাদের মনে রাখা উচিত– কতবার তিনি দলের দুঃসময়ে ব্যাটিংয়ে নেমে কঠিন প্রতিপক্ষকে সহজ বানিয়ে ফেলেছেন, বল হাতে কত বার তিনি কঠিনতম বাধাটাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে জয় এনে দিয়েছেন, ফিল্ডিঙে কী ক্ষিপ্র তিনি। তার হাত থেকে ক্যাচ সাধারণত ফস্কে না, আর তিনি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে বল ছুড়ে মারলে উইকেট ভাঙবেই।
মনে রাখা উচিত, তবে আমরা মনে রাখি না। সাকিব ভালো করলে আমরা ধরেই নেই, ও তো ভালো করবেই। ও ভালো না করলে আমরা বলে বসি…
একবার যে বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ, সাকিব আল হাসান– তাতে কিন্তু বাড়াবাড়ি ছিল না। সেটা যেমন সত্যি, পান থেকে চুন খসলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ক্রিকেটারদের ধুয়ে দেবার প্রবণতাও তো বাস্তবতা।
২০ অক্টোবর ২০১৮ সাকিবের বনানীর নতুন ফ্লাটে গিয়ে হাজির হয়ে এক ফাঁকে ওই কথাটাও পাড়ি। বলি, সাকিব, আশা করি, আপনি ফেসবুক করেন না। তিনি বলেন, না, আমি ফেসবুক করি না। খবরের কাগজে খেলার খবর পড়ি না। টেলিভিশনে শুধু খবর দেখি। খবর জানার জন্য। আমার একটা ফেসবুক প্রফাইল আছে, যেটাতে শুধু আমার ঘনিষ্ঠজনেরা আছেন। তারা কেউ ক্রিকেট বোঝে না। ক্রিকেট নিয়ে কেউ কথা বললেই সে আউট। ফলে বাইরে কে কী বলছে আমি দেখি না। তবে…
তবে একটু আছে। ‘তবে কোনো একটা ছবির নিচে ওপরের দিকের দু একটা কমেন্টে তো চোখ যায়ই। কিন্তু জানেন, মানুষ কিন্তু আমাকে খুব ভালোবাসে। কাল রাতে বের হয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে। রিকশাওয়ালারা বললেন, ভাই, আপনি এখানে থাকেন। মাঝে-মধ্যে আসবেন। তাহলে দেখা হবে। আমি বললাম, এখানেই থাকি। দেখা তাে হবেই। ওদের ভালোবাসাটা কিন্তু খাঁটি। এরা যখন খেলা দেখেন, তখন তাদের রোজকার আয় বন্ধ হয়ে যায়। অথচ তারা কিন্তু ভাড়া করে রিকশা এনেছেন, মহাজনকে ঠিকই জমার টাকা দিতে হবে!
হা! সাকিব ভাবছেন শুধু শ্রমজীবী মানুষদের ভালোবাসাটাই খাঁটি! না-না সাকিব, আমাদের ভালোবাসাও জেনুইন!
তিনি বলেন, জেনুইন। সবারটাই জেনুইন। তবে আপনি যখন খেলা দেখেন, আপনার বেতনের টাকা তো আর কাটা যায় না।
আমার প্রায়ই এই ভাবনাটা আসে, বাংলাদেশের নরম পলিমাটিতে, এই রকম ভেজা বাতাসের দেশে এই রকম একটা যোদ্ধা ছেলে, লড়াকু ছেলে আমরা পেলাম কী করে? সাকিবকে বলি, সাকিব, আপনি যখন বল করেন, আপনার চোখে-মুখে আমি লড়াকু রোষটা দেখতে পাই। মাঝে-মধ্যে আপনি মাশরাফির পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ফিল্ডিং পজিশনের পরামর্শ দেন। তারপর বল হাতে যখন আপনি ছয় খান, তখন আমি বলে দিই, পরের বলেই আউট। প্রায়ই তা হয়ও। এই যে রোখ, এই যে জিদ, এটা আপনি পেলেন কোত্থেকে!
নানা কথায় উঠে আসে সেই রহস্যের রসায়ন। সাকিব বলেন, জানেন, আমি হারতে চাই না, হার মেনে নিতে পারি না। এটা ছোটবেলা থেকেই।
যখন আমরা টেনিসবল দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম, তখনো আমি হার মানতে পারতাম না। ছোটবেলায় এলাচি বিস্কুটের প্যাকেট বাজি ধরে খেলতাম। আরেকটু বেশি মানুষ হলে একটাকা দুইটাকা করে বারোটাকা হলে বাটার কুকিজ বিস্কুট নিয়ে খেলা। খেলোয়াড় যখন ভাগ হচ্ছে, তখন আমাকে যদি প্রথম ডাক না দিত, আমি তা মেনে নিতে পারতামই না।
অন্য কোনো খেলা, ধরো কেরম বা ব্যাডমিন্টন, এসবেই নিশ্চয়ই আপনি ভালো ছিলেন, এই ধরনের খেলায় বাবা কিংবা ছোট কোনো ভাইয়ের সঙ্গে আপনি কি হার মেনে নিতে পারেন?
না না। হার আমি কখনোই মানতে পারি না। আমি ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম, কেরমে ভালো ছিলাম।
একবার হলো কী, কেরম প্রতিযোগিতা হচ্ছে স্কুলে। আমি ফাইনালে উঠে গেছি। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ফাইনাল হচ্ছে।। আমার বন্ধু ২১ পয়েন্ট পেয়ে গেছে, আমি ০। আমার মনে হলো, আরে, আমি হারব নাকি। না। আমি হারব না। আমি হারতে পারি না। আমি খেলার মধ্যে ঢুকে গেলাম। মনোযোগ দিলাম। পর পর তিন বোর্ডে আমি ওকে হারিয়ে দিলা। ব্যাস।
শোনেন, আমার চ্যালেঞ্জ লাগে। ওই চ্যালেঞ্জটা যখন আসে, তখন খুব ভালো হয়। আমার জীবনের সব কিছু এসেছে আগে আগে। আমি যখন ভেবেছি আন্ডার ১৫ খেলব, তখন আন্ডার ১৭ খেলেছি। আন্ডার ১৯ খেলব ভাবছি, এ টিমে খেলেছি। আন্ডার নাইনটিন খেলব ন্যাশনাল টিমে খেলেছি। ২১-২২ বছর বয়সে ক্যাপ্টেন হয়ে গেছি ন্যাশনাল টিমের।
হ্যাঁ। ওয়েস্ট ইন্ডিজে যখন আপনাকে ক্যাপ্টেন হতো হলো, আর আপনি ব্যাট হাতে বাংলাদেশকে জেতাচ্ছিলেন, সেটা আমাদের মনে চিরস্থায়ীভাবে গাঁথা হয়ে গেছে। আপনার মাথা থেকে দরদর করে ঘাম বেরুচ্ছিল। আপনি বসে পড়ছিলেন। হেলমেট খুলে মাথায় পানি দিচ্ছিলেন।
হ্যাঁ। এই চ্যালেঞ্জটা আমার দরকার হয়। তখন তো আমার ক্যাপ্টেন হওয়ার কথা ছিল না।
হ্যাঁ। সাকিবের খেলা আমরা যারা দূরে বসে দেখি, ভালো করে খেয়াল করলে বুঝতে পারব, ওর মধ্যে একটা নাছোড় রোখ আছে, যাকে বলে জিগীষা। জয় করবার ইচ্ছা।
কিন্তু আপনার মধ্যে একটা সহজ ভাবও আছে। প্রাকটিসের সময় বা…
না-না। আমি কিন্তু খুবই সিরিয়াসলি প্রাকটিস করি। বোলিং ব্যাটিং ফিল্ডিং– সব। খুব মন দিয়ে করি। আমার সুবিধা হলো, আমার অল্পে হয়ে যায়। কিন্তু যখন যা লাগে, আমি করি।
সাকিব হচ্ছেন র ্যাপিড লার্নার। দ্রুত শিখে ফেলতে পারেন। ওর সম্পদ ওর প্রতিভা, সাহস, জিদ আর মনোবল। ও কখনো ভেঙে পড়ে না।
জিদের কথায় আবার আসি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জয়লাভ করছে, আর আমার কোনো কন্ট্রিবিউশন নাই, এটা আমি মানতেই পারি না। বাংলাদেশের জয়ে অবশ্যই আমার অবদান রাখতে পারতে হবে।
আমি বলি, সাকিব, আপনি যখন ব্যাটিং করেন, তখন আমি এত ভয়ে ভয়ে থাকি, এতবার আল্লাহকে ডাকি যে, আল্লাহ আমার বহু গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন…
সাকিব বলেন, এটা কেন হয় জানেন। কারণ আমি দলের জন্য খেলি। আমার নিজের রেকর্ডের জন্য আমি যদি খেলতাম, তাহলে আমার ব্যাটিংয়ের সময় আপনাকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো না। শোনেন, ইন্ডিয়ার সঙ্গে টেস্ট হচ্ছে। আমি নেমেই পিটাতে শুরু করলাম। কোহলি এসে বলল, তুমি কি ওয়ানডে খেলছ না কি টেস্ট। আমি বললাম, কোহলি, আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়।বেয়াদবি করতে এসো না। সে বলল, তাতে কী। তুমি তো আস্তে আস্তে খেললে একটা রেকর্ড করতে পারবে। টেস্টের মতো করে খেলো।
আমি বললাম, রেকর্ডের জন্য আমি খেলি না।
সাকিব দেশের জন্যই খেলেন। দলের জন্য খেলেন।
তিনি বলেন, বেশি ক্যালকুলেশন করে বেশি চাপ নিয়ে ফেললে খেলা ভালো হয় না। নির্ভারভাবে খেললে ভালো হয়। খেলাটা উপভোগ করতে হয়। আর খেলার মধ্যে ইনটেন্সলি ইনভলভড হতে হয়। এটা সব দিন সব বিষয়ে সব সময় হয় না। কিন্তু যখন হয়, তখন সেটা খুব কাজে লাগে।
নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের একটা পরামর্শ দিন।
‘খেলাকে উপভোগ করতে হবে। যদি তুমি খেলাটাকে উপভোগ করো, তাহলে বাকি সব হবে। তখন অনুশীলন হবে, সাধনা হবে। উপভোগ করাটাই আসল।’
সাকিব ব্যাখ্যাও দেন। আমি যদি খেলা উপভোগ না করি, তাহলে কেন আমি চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে রোদে পুড়তে যাব। আমি খেলাটা উপভোগ করি।
আমি বলি, আপনি তো বুদ্ধি দিয়ে বল করেন।
সাকিব হাসেন। বলেন, বল তো বুদ্ধি দিয়েই করতে হবে। আমার তো হাতে অস্ত্র কম।
দেশ নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখেন?
তিনি বলেন, আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদর দেখুন। তাদের মধ্যে ভীষণ পটেনশিয়াল আছে। তারা কিন্তু ছোট স্বপ্ন দেখে না। আমি যার সঙ্গেই কথা বলি, তাকেই দেখি বড় স্বপ্ন দেখছে। এই পরিবর্তনটা দেশে হয়েছে। এবং সবাই সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য চেষ্টা করছে। পুরাটা না পারলেই অনেকটাই সফল হচ্ছে। আপনি যদি বড় স্বপ্ন দেখেন, আর তার যদি অনেকটাই সফল করে ফেলেন, তাহলে কিন্তু আপনি বড় অর্জন করলেন। এইভাবে সবাই যখন একটু একটু করে সফলতা অর্জন করে, তখন দেশই এগিয়ে যায়। দেশ কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। দশ বিশ বছর পরে এই দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। ক্রিকেটের মতোই। আমাদের আগের প্রজন্ম একটা জায়গা পর্যন্ত এগিয়ে গেছেন। আমরা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গেছি। দেশের বেলাতেও তাই হচ্ছে। প্রত্যেকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ভালো করলাম। আরো একশজন ভালো করল। এইভাবে পুরা দেশ ভালো করছে। এটাই উন্নতি। এই উন্নতিটা হচ্ছে।
সাকিব বলেন, স্বপ্ন কিন্তু সেটাই, যেটা শুনে চারপাশের মানুষ চমকে উঠবে। মানুষ হাসাহাসি করবে। আপনার স্বপ্ন শুনে যদি কেউ হাসাহাসি না করল, সেটা তাহলে কোনো স্বপ্নই না।
সাকিবকে বলি, তাহলে আমরা বিশ্বকাপ নিয়ে একটা স্বপ্ন তো দেখি। লোকে যদি হাসাহাসি করে, তবুও। আমরা তো চ্যাম্পিয়ন হব।
সাকিব বললেন, হ্যাঁ, আমরা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারি। এটা হওয়া সম্ভব। ইংল্যান্ডে আমরা কিন্তু অত ভালো খেলি না। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে শুদু নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভালো খেলেছি। আমি বাস্তববাদী মানুষ। কাজেই এই হিসাবটা আমাদের মাথায় রাখতেই হবে। তারপরেও আমি মনে করি, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। জি। কেন নয়?
(প্রথম আলো, নভেম্বর ২০১৮, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত।)