অং সান সুচি। একদার শান্তির নায়িকা এখন খলনায়িকা। তিনি এখন নিত্য মিথ্যাও বলেন। বুধবার নেদারল্যান্ডের আন্তর্জাতিক আদালতের সামনেও মিথ্যা বলে গেলেন মিয়ানমারের এই নেত্রী! নির্লজ্জভাবে সাফাই গাইলেন গণহত্যার সঙ্গে জড়িত সে দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষে! সেই দেশটার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা নামের একটি জাতিকে ধংসের পরিকল্পিত গণহত্যা-নিষ্ঠুরতার সঙ্গে জড়িত। তাদের নৃসংসতার শিকার রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জীবন বাঁচাতে এখন বাংলাদেশে এবং সারা দুনিয়ায়। মিয়ানমারের এই লোকজনের চাপে বাংলাদেশের মতো একটা দেশ অস্বস্তিকর সমস্যায় পড়েছে। অথচ মিথ্যাবাদী সুচি আন্তর্জাতিক আদালতের সামনে বক্তব্য রাখার সময়ও রোহিঙ্গা শব্দটি একবারও উচ্চারন করেননি! স্বীকার করেননি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা! বলেছেন, ‘হয়তো মেরেছে তবে তা গণহত্যা হয়নি’!
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যারা হত্যাকান্ডের মতো বাড়াবাড়ির সঙ্গে জড়িত তাদেরকে বিচারের সম্মুখিন করা হয়েছে দাবি করে সুচি বলেছেন, এটা তার দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়, এটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেবার কিছু নেই! গাম্বিয়া কেনো মামলা করলো তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মিয়ানমারও। আবার বলেছে বাংলাদেশে যারা গেছে তাদের নিয়ে বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে, কিন্তু মামলা বা কারও কাছে অভিযোগ করতে পারেনা। এমন নানান অসংলগ্ন কথাবার্তা ছিল সুচি আর মিয়ানমারের আত্মপক্ষে। বোঝা গেলো তারা বুঝতে পেরেছে তাদের সবকূল গেছে। সবকূল যখন যাদের যায় তারাই এমন অসংলগ্ন এলোমেলো কথাবার্তা বলে।
বুধবার আদালতে সুচির বক্তব্য শুনতে শুনতে খারাপও লেগেছে। এই কয়েক বছর আগে বিশ্বজুড়ে এই মহিলার কি ভাবমূর্তি ছিল এখন কী! বিশ্ববাসীর অনেকে এখন মনে করে, দূর্ভাগ্য এই মহিলাকেই শান্তির জন্যে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছিল! বুধবার আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বক্তব্য উপস্থাপন যারা লাইভ দেখেছেন তারা মানবেন, সুচিগং শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন অবিরাম! গণহত্যা-মানবতার বিরোধী অপরাধের নতুন সংজ্ঞা দেবার হাস্যকর চেষ্টাও করেছেন সুচিগং। মামলাটি গাম্বিয়া কেনো করলো সে প্রশ্নও তুলেছে মিয়ানমার পক্ষ। তারা বলার চেষ্টা করেছে এই পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ। মামলা বাংলাদেশ করতে পারতো। তা না করে গাম্বিয়া কেনো করেছে যারা রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে কোনভাবেই জড়িতনা। আবার বলেছে বাংলাদেশও মামলা করতে পারেনা।
আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে-পিঠ বাঁচাতে হাস্যকরভাবে সুচিগং যেন দিতে চেয়েছে গ্রাম্য সালিশের যুক্তি! অথচ রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা এখন একটি বিশ্বজনীন সমস্যা। বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থী নেই। এরা একবার কোন দেশে গিয়ে ঢুকে পড়লে তাদের আর বের করা যায় না। কারন তাদের কোন দেশ নেই। মিয়ানমার তাদেরকে নাগরিক হিসাবে স্বীকার করেনা। এর কারনে আন্তর্জাতিক সমস্যার সুরাহা চেয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে পারে বিশ্বের যে কোন দেশ। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মূলত মুসলিম। সে কারনে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন ওআইসির সিদ্ধান্তে মামলাটি করেছে গাম্বিয়া। মামলাটি গাম্বিয়া কেনো করলো তা মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশের মির্জা ফখরুলও করেছেন। মির্জা ফখরুল এক সময় শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু এখন মাঝেমাঝে কিছু শিশুতোষ অথবা এলোমেলো কথাবার্তাও বলেন।
আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাটি বাংলাদেশ করেনি কৌশলগত কারনে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার শান্তিপূর্ন সুরাহার আশায় বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এই চুক্তিটি বহাল থাকা অবস্থায় সে দেশটির বিরুদ্ধে মামলায় যেতে পারেনা। মামলা বা যুদ্ধে গেলে চুক্তিটি অটোমেটিক বাতিল হয়ে যাবে। এমনিতে মিয়ানমার নিত্য মিথ্যা বলে। প্রায় বলে তারা শরণার্থীদের ফেরত নিতে বসে আছে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের পাঠাচ্ছেনা। শরণার্থীদের দেখিয়ে বাংলাদেশ ত্রান বানিজ্য করতে চায় মাঝে এমন কথাও বলা হয়েছে। অথচ মিয়ানমারের এখনও ভয়ের পরিবেশের কারনে শরণার্থীরা এখনও নিজের দেশে ফিরে যেতে রাজি হচ্ছেনা। বাংলাদেশ মিয়ানমারকে কোন অজুহাতের সুযোগ দিতে চায় না। এরজন্যে আইসিসির সিদ্ধান্তে গাম্বিয়াকে দিয়ে মামলাটি করিয়েছে। আর মামলাটি গাম্বিয়া করায় যে ভালো হয়েছে তা আদালতে সে দেশের বিচারমন্ত্রী এবং তাঁর টিমের যুক্তি উপস্থাপন শুনে সবাই সে ধারনা পেয়েছেন। আমিতো পুরোই মুগ্ধ।
গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু এর আগে রুয়ান্ডার গণহত্যার বিচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আফ্রিকার ছোট দেশ গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী হবার আগে তিনি বাংলাদেশে এসে সরেজমিন রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলো দেখে গেছেন। এরজন্যে রোহিঙ্গা জাতির কান্না তিনি অনুভব করতে পেরেছেন। অধ্যাপক পায়াম আখাভান, অ্যান্ড্রু লোয়েন্সটিন, আরসালান সুলেমান, অধ্যাপক পিয়ের দ’আরজন, পল এস রাইখলার, অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডসকে নিয়ে তাঁর টিমের যুক্তি উপস্থাপন এতোটাই সুগ্রন্থিত ছিলো যে তাতে সুচিগং এর মাথা আওলাইয়া যাওয়ায় প্রশ্ন তুলেছে গাম্বিয়া কেনো আইলো! আন্তর্জাতিক আদালতে আরসা পারসা দেখিয়ে সুচিরা পার পাবেননা।
কারন যে আদালতে বিচারটি হচ্ছে এর আইন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই আদালতের আইনে আছে গণহত্যার সংজ্ঞা শুধু একদল মানুষকে মেরে ফেলা নয়। একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে ধংস নিশ্চিহ্ন করার জন্যে আকারে-ইংগিতেও যদি ভয় দেখানো হয় সেটিও জেনোসাইডের সমান অপরাধ। বার্মা তথা মিয়ানমার দীর্ঘদিন থেকে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্তে লিপ্ত। তারা এই গোষ্ঠীর নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। এদেরকে রোহিঙ্গা নামেও স্বীকার করেনা। আর লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে বেড়াতেও আসেনি বা শরণার্থী শিবির তাদের কোন কুটুম্ববাড়িও নয়। রোহিঙ্গাদের শুধু হত্যা-ধর্ষন নয়, তাদের বাড়িঘর-গ্রাম সব জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই গ্রামগুলোতে এখন রোহিঙ্গা বসতির কোন প্রমানও আর নেই। এই মিথ্যাবাদী নোবেল বিজয়িনীর বিশ্বে ঘোরাফেরাও আগামীতে বন্ধ হবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার নিশ্চয়তা কবে হবে তা কেউ জানেনা। কারন এই দেশটি দুনিয়ার কাউকে মানেনা।