বঙ্গবন্ধুর একটি মূলবান কথা ‘দেশ চালায় খেটে খাওয়া মানুষ।’ আর এই মূল্যবান কথাটি বঙ্গবন্ধু একটি জনাকীর্ণ জনসভায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। একথার মধ্য দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ পরিবর্তনের পরামর্শ ছিল বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে। সরকার আর শাসক নয় সেবক-এমনি দৃষ্টিভঙ্গি সরকারি বেতনভুক্ত সকলকে ভাবতে হবে-এটাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সারমর্ম বহন করে। সাম্প্রতিক কতকগুলো বিষয় থেকে মনে হচ্ছে আমরা বঙ্গবন্ধুকে মুজিববর্ষেই ভুলে থাকছি। কি দারুণ স্বার্থপর আমরা বটে!
সেদিনের সেই জনসভায় আরও অনেক কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। একপর্যায়ে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে বললেন- আপনাদের একটি প্রশ্ন করি-এবং সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে বললেন আমিও তো আপনাদের একজন-সুতরাং, প্রশ্নটা আমাদেরকে করি। প্রশ্নটা ছিল- কাদের টাকায় দেশ চলে, আমরা কাদের টাকা থেকে বেতন পাই? বঙ্গবন্ধু সেদিন দ্রুতই নিজের ভুল নিজে সংশোধন করেছেন। কখনো তিনি নিজেকে জনগণ থেকে আলাদা করেননি। জনগণের জন্য, জনগণের টাকায়, জনগণের খেদমত করেছেন। তিনি কখনো বলতেন না আমি করে দিলাম বা আমি দিলাম। যদিও আজকের কোনো কোনো নেতা-কিংবা তাদের সমর্থক বলেন-আমি করে দিলাম কিংবা আমি করে দিয়েছি। মুজিববর্ষে মুজিবকে ভুলে যাওয়া!বঙ্গবন্ধু ‘আমি’ নয়- ‘আমরা’ ‘আমাদের’ চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শর কথা বলি ঠিকই তবে ‘আমরা’ বা ‘আমাদের’ চেতনা কারো কারো নেই বললে ভুল বলা হবে কি? ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ হতে পারা খুবই কঠিন সাধনা। বঙ্গবন্ধু সেই সাধনায় জেলখানায় প্রায় ১৩ বছর জীবন পার করেছেন। দেশ ও দশকে নিয়ে ভেবেছেন। মুক্তির গান গেয়ে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এভাবে তিনি মুজিব ভাই থেকে জাতির পিতা হয়েছেন। এভাবেই শেখ সাহেব থেকে আমাদের বঙ্গবন্ধু হয়েছেন।
সেই বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করে অনেকেই মন্ত্রী-সচিব-সামরিক-বেসামরিক আমলা আজ ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুর নৌকা মার্ক নিয়ে নির্বাচন করে জননেতা। সেই মন্ত্রীরা অনেকে মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বললেও অন্তরে অন্য ভাবনা ধারণ করেন হয়তো। আর সে ভাবনা এতো সদূর প্রসারী যে-কোনটি যৌক্তিক এবং কোনটি অযৌক্তিক সেসব নেতারা ভুলে যান। আর তাই খিচুড়ি সমাচার তৈরি করে আবার নির্লজ্জের মতো হাজির হন সাংবাদিক সম্মেলনে।
যদি এখানেই বিষয়টি শেষ হতো তবে না মন্ত্রীর চাপাবাজির সাফল্য বর্ণমালা সাজিয়ে বন্দনা করা যেত! কিন্তু না। কথায় আছে- বাবারও বাবা আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জনদরদী ওই নেতাকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধু যাদেরকে অভিহিত করেছিলেন ‘চাটার দল’]ভেবেছিলো আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পেয়ে গেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মরে নাই। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে। সুতরাং বহুল আলোচিত খিচুড়ি ভ্রমণ পরিকল্পনা থেকে অবশেষে বাদ পড়েছে।
স্কুলের শিশুদের খিচুড়ি দিতে গেলে জগাখিচুড়ি লাগতে পারে- সেটা বোঝার ক্ষমতা শিশুদেরও থাকে বলে দাবি করা যায়। তবে সিদ্ধান্তটি যে ভুল সেটা হয়তো মানতে চাইবেন না উদ্যোক্তারা। সকলেই একমত হবেন শিশুদের পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। সেটা কিভাবে কখন দেয়া যায়- তা নিয়ে একটি জনজরিপ করা যেত। প্রাথমিক ধারণাটা এরকম ছিল হয়তো। প্রতিটি স্কুলে খিচুড়ি রান্না করে সেটা বন্টন করা হবে। সেজন্য বাজার করতে হবে। বাজারের হিসাব রাখতে হবে, সেটা হিসাববিধি মেনে সরকারকে রিপোর্ট করতে হবে। এক গাদা কাজ। সুতরাং এটার জন্য ভাববার প্রয়োজন আছে-ট্রেনিংয়ের প্রয়োজনও আছে। তবে এটা অন্যভাবেও করা যায়। যেভাবেই করা হোক না কেন সমস্যা থেকেই যাবে।
কারও কারও অভিমত হলো- একটা ডিম যদি একজন শিশুকে দেয়া হয় তবে ২০ দিনে ২০টি ডিম। এই ২০টি ডিমের টাকা বাবা-মাকে দিয়ে দিলেই হলো। এ রকম অভিমত আরও আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত যদি খিচুড়ি বিজয়ী হয় তবে সেজন্য কেন বিদেশ যেতে হবে বোধগম্য নয় আমাদের।
এমন হতে পারে শিশুটি যখন স্কুলে আসবে- তারা মায়ের হাতে সেদ্ধ করা ডিমটি এনে জমা দেবে অফিসে অথবা শিশুরা তাদের খাবার বাক্সটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখবে। যখন টিফিন টাইম হবে তখন তারা সেটি নিয়ে খাবে। সঙ্গে তাদেরকে দুটি সিঙ্গারা দেয়া যেতে পারে। আর সকলকে এক গ্লাস দুধ দেয়া যেতে পারে। সেটা চকলেটে মিল্ক প্যাকেট আকারে দেয়া যেতে পারে। অথবা একজনকে কন্টাক্ট দেয়া যেতে পারে এগুলো সরবরাহ করবার জন্য। তারা সিঙ্গারা, ডিম ও দুধ সরবরাহ করবে স্কুল টিফিন টাইমে। সেজন্য ট্রেনিং নিতে বিদেশ যেতে হবে ভাবনাটা একেবারে স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছু নয়।
খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশনের জন্য বিদেশ না গিয়ে অনেকে বিকল্প একটি প্রস্তাব দিয়ে কাকরাইল মসজিদে যেতে বলেছেন। কারণ সেখানে আন্তর্জাতিক নেতারও খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশন করেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সরকারি আমলা, বিমানবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাকেও সেখানে দেখা যায়।
কিছুদিন আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম লন্ডন। সেখানে গিয়ে জেনেছি ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ প্রতিটি শিশুকে সপ্তাহে ২০ পাউন্ড দেন যাতে দুধ কিনে খেতে পারে। আমরা ডিম-দুধ দুটোই দিতে পারি না কি?
এখন কিভাবে হাত ধুঁতে হবে সেটার জন্য ট্রেনিং নিতে ৪০ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছে। সুতরাং ডিম কিভাবে খোসামুক্ত করতে হবে, ডিমের খোসা কোথায় ফেলা হবে, কে খোসা পরিষ্কার করবে নিয়েও যুক্তিতর্ক হতে পারে। এবং একপর্যায়ে ওই বিদেশ ট্রেনিংয়ের জন্য ২০ কোটি টাকা দাবি করা যেতে পারে! পলিসি ডিলেমা, পলিসি প্যারাডক্স।
এ প্রসঙ্গে আপনাদের একটি বিষয়ে জানাতে চাই- বিষয়টি হলো একসময় অস্ট্রেলিয়া তাদের প্লাস্টিক বর্জ্য রপ্তানি করতো পাশের দেশে। কিছুদিন আগে তারা আর এই সুবিধা দেবে না বলে জানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া বসে নেই কারও মুখের দিকে তাকিয়ে।
গতকাল অস্ট্রেলিয়ার এবিসি টিভিতে একটি প্রতিবেদন দেখলাম। সিডনি শহরে ওই বর্জ্য ব্যবহার করে রাস্তা কার্পেটিং করছে। অস্ট্রেলিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা আর বর্জ্য রপ্তানি করবে না।
বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করবার ধারণা নিতে বিদেশ যেতে হতে পারে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিক্ষার উন্নয়নে বিদেশ যেতে হতে পারে-কারণ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে, মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেও বিদেশ যেতে হয় ভালো স্বাস্থ্যসেবার জন্য।
আমাদের স্বাস্থ্য সচিবের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থেকে লেখা হয়তো অনেকেই পড়েছি। করোনা কিভাবে তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে গেছে না ফেরার দেশে। যদি বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে হয় ভালো সার্জন বা প্রকৌশলী তৈরি করতে সেজন্য আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা যেতে পারে। আর সেসব পরিকল্পনার কথা শুনলে জনমনে শান্তি আসবে- সেটা নিয়ে কেউ ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং আরেক জননেতা অভিনেতা ফারুককে সিঙ্গাপুর পাঠানো হলো। এভাবে আমরা আর কতকাল নিজেদের নিজেরা বঞ্চিত করবো? একদিন মানুষ জেগে উঠবে-যেভাবে আবরার-সিনহা হত্যাকাণ্ড থেকে জেগে উঠেছে, যেভাবে আসাদের শার্ট নিয়ে মানুষ পথে নেমে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেছে।
সমালোচনার মুখে অবশেষে ‘খিচুড়ি রান্না ও ব্যবস্থাপনা’ শিখতে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের বিষয়টি বাতিল করতে বলেছে পরি…
পর্দা কেলেঙ্কারি দিয়ে যে যাত্রা-সার্কাস শুরু হয়েছে, সেটা কোথায় শেষ হবে কেউ জানে না। পঁচা ডিমও কপালে জুটতে পারে কারও কারও- সুতরাং, সাবধান হওয়ার সময় এখনো আছে কিন্তু! প্রতিদিন কিন্তু হাওয়া বদলাচ্ছে। পিয়াজ-পিয়াজ খেলায় ধরা খেতে বেশি সময় লাগবে না কিন্তু নেতাজি! আগের মতো সিকিউর ভাববার দিন চলে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচন হবে একটি কঠিন নির্বাচন। সেখানে পার পাওয়া মোটেও সহজ হবে না। সেদিন কেউ আসবেনা বাক্সে ব্যালট ভরে দিতে। মোট ভোটের থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন এমন নেতাও আছেন জনমনে। মুজিব কোট পরে সাহেদ -লোপা -সাবরিনা রক্ষা পেয়েছেন কি? একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখবেন কি? “A Stitch in Time May save nine.”
লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ – শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।