১৯৮৭ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিন্তায় প্রতি সপ্তাহে রাজাকারদের তালিকা ছাপা হচ্ছিল। এই তালিকাটি ছিল আমার সারাদেশ পায়ে হেঁটে ভ্রমনের সময় সংগ্রহ করা। সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভ্যুর সময় তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমি দেশের প্রতিটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকাটি সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলাম।
আমাদের ওই তালিকা ছাপা দেখে পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড তাদের প্যাডে আমাদের একটি চিঠি লিখে পাঠায়। সেই চিঠিতে বলা হয় একাত্তরে তাদের সাঈদখালি গ্রাম এলাকায় দেইল্লা রাজাকার নামের একজন হিংস্র প্রকৃতির রাজাকার ছিল। পাড়েরহাট গ্রামে হাটবারে সে হিন্দু বাড়ি লুট করা মালামালও বিক্রি করতো।
দেশ স্বাধীন হবার পর দেইল্লা রাজাকার এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় তাকে তখন মুক্তিযোদ্ধারা ধরতে পারেনি। সেই চিঠিতে লেখা হয় তারা অবাক হয়ে দেখছেন সেই লোকটিই এখন নাম পাল্টে বিভিন্ন এলাকায় দেলোয়ার হোসেন সাঈদি নামে ওয়াজ করে বেড়াচ্ছে!
পিরোজপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সে চিঠি পেয়ে এ ব্যাপারে সাঈদির বক্তব্য নেবার জন্যে আমি তাকে ফোন করি। তিনি প্রথমে বিষয়টির সত্যতা অস্বীকার করেন। এরপর এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার কথা বলতে তার ইন্টারভ্যুর জন্যে আমাকে সময় দেন। ইন্টারভ্যুর উদ্দেশে যাবার আগে আবার ফোন করলে তার বাসা থেকে বলা হয় আগের দিন তিনি বিদেশে চলে গেছেন।
আমি বুঝতে পারি আমাকে এড়িয়ে যাবার জন্যে তিনি এমনভাবে সময় দিয়েছেন যখন তিনি দেশে থাকবেননা। এভাবে আমি পরেও বিভিন্ন সময়ে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কখনো ফোন তুলে নাম শুনে ফোন রেখে দিয়েছেন। কখনও নানান ব্যস্ততার বাহানা দেখিয়েছেন।
এরশাদ যুগের পর খালেদা জিয়ার আমলে সাঈদি তখন ওয়াজের ময়দানে ব্যাপক জনপ্রিয়। তার ওয়াজের ক্যাসেট তখন বিপুল বিক্রি হয়। সেই জনপ্রিয়তা নিয়ে সাঈদি তখন মাওলানা রহিমের ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক দল নামের একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের জন্মের সশস্ত্র বিরোধিতার কারনে যখন জামায়াতে ইসলামী নামের কোন রাজনৈতিক দল করা যাচ্ছিলোনা তখন জিয়ার আমলে জামায়াত প্রথমে মাওলানা রহিমকে দিয়ে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক দল নামের দলটি গঠন করায়। জামায়াত এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে।
যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষনের সঙ্গে ব্যাপক সম্পৃক্ত ইসলামী ছাত্র সংঘ নিয়ে মাঠে আর নামা যাবেনা এই বিবেচনাতেই তারা সংগঠনের নতুন নাম নেয় ইসলামী ছাত্র শিবির।
এই সংগঠনের রগকাটায় দক্ষতার কথা বাংলাদেশের এই প্রজন্ম জানেনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের নানান ক্যাম্পাসে, বিশেষ করে মেডিক্যাল কলেজে এরা ভীতি আতঙ্কের সৃষ্টি করে রেখেছিল।
ঠিক এখন তারা আবার আমার বাংলাদেশ পার্টি নামে মাঠে নামতে চাইছে। এই দলের ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক, তাজুল ইসলাম সহ অনেকে জামায়াতের ফাঁসিতে দন্ডিত আসামীদের আইনজীবী ছিলেন। তাদের দলের নাম হতে পারে আমার পাকিস্তান পার্টি! আমার বাংলাদেশ নয়। কারন তাদের রক্ত পাকিস্তানের।
মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের দলটি যখন জামায়াতে ইসলামী নামে দল গঠনে সমর্থ হয় তখন বিলুপ্ত হয় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামের দলটিও। সাঈদি সহ এ দলের লোকজনও তখন জামায়াতের সঙ্গে মিশে যায়।
যুদ্ধাপরাধী ওয়াজি মাওলানা সাঈদি বিভিন্ন সময়ে নাম পাল্টেছে। যেমন সাঈদখালি গ্রামের নামের সঙ্গে মিলিয়ে প্রথমে তার নামকরন করে দেলোয়ার হোসেন সাঈদি। এরপর নামের সঙ্গে আল্লামা’ যুক্ত করে। কিন্তু কোন কিছুতে তার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারী রাজাকার যুদ্ধাপরাধী তকমাটি কখনও কোন কিছুতেও ঘুচে যায়নি।
জনকন্ঠে একবার সারাদেশের রাজাকারদের নিয়ে ‘সেই রাজাকার’ নামের একটি সিরিজ রিপোর্ট ছাপা হয়। সেই সিরিজে সাঈদির রাজাকারি নিয়ে লেখায় সাঈদির পান্ডারা তখন জনকন্ঠের পিরোজপুর প্রতিনিধি কমলকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
সেই কমল বেঁচে গেলেও এখন নানান শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার মাঠ পর্যায়ের এমন নির্যাতিত সাংবাদিকদের মূল্যায়ন করেন। কমলকে একবার তার সঙ্গে বিদেশ সফরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। ওই সময় আমেরিকায় নিষিদ্ধ হন সাঈদি। ৯/১১ এর পর সারা পৃথিবীর বিপদজ্জনক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি তালিকা করে আমেরিকা। ‘নো ফ্লাই প্যাসেঞ্জারস’ লিস্ট নামের ওই তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র সাঈদির নাম ছিল।
আমেরিকা তখন তালিকাটি বাংলাদেশ সরকারকে পাঠায়। বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশনকে বলা হয় তারা যাতে সাঈদিকে আমেরিকাগামী কোন বিমানে চড়তে না দেয়। নিষেধাজ্ঞা স্বত্ত্বেও সাঈদিকে কোন বিমান যদি আমেরিকায় নিয়ে আসে, তবে সে বিমান সংস্থাকে আমেরিকায় নিষিদ্ধ করা হবে।
জামায়াত যেহেতু তখন বিএনপির ক্ষমতার পার্টনার, তাই বিএনপি সরকার তখন সাঈদিকে নিয়ে পাওয়া চিঠিটি চেপে যায়। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের কোন একটি অজ্ঞাত সূত্র সে চিঠির একটি কপি আমাকে ফ্যাক্স করে পাঠান। তিনি হয়তো খেয়াল করেছিলেন এই রিপোর্টার এসব রিপোর্ট করে।
সেই চিঠি সহ আমেরিকায় সাঈদি নিষিদ্ধ শিরোনামের একটি রিপোর্ট জনকন্ঠে ছাপা হলে জামায়াত স্বভাবসুলভ সত্য নয়, বস্তুনিষ্ঠ নয় বলে একটি প্রতিবাদ পাঠায়। জামায়াতের প্রতিবাদের সঙ্গে প্রতিবেদকের বক্তব্যে আমরা লিখেছিলাম, প্রতিবাদতো পাঠাবেন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে। কারন এ নিষেধাজ্ঞা তাদের।
বলাবাহুল্য জামায়াত তখন এ নিয়ে আর কোন ঘাটাঘাটিতে যায়নি। এরপর আর কোন দিন আমেরিকায় যাবার চেষ্টা করেননি সাঈদি।
এরপর সাঈদির বিলাতে যাবারও পথ বন্ধ হয়ে যায়। ইরাক যুদ্ধের পর কক্সবাজার এলাকার একটি ওয়াজের ক্যাসেট বিলাতের চ্যানেল ফোরের হাতে পড়লে তারা সাঈদিকে নিয়ে একটি রিপোর্ট করে। ওয়াজের ব্যস্ত শিডিউল নিয়ে সাঈদি তখন লন্ডনে গিয়েছিলেন।
কক্সবাজারের ওয়াজে সাঈদি বলেছিলেন ইরাক যুদ্ধের কারনে বিলাত-আমেরিকার যেখানে যাকে পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধ প্রতিশোধ নিতে হবে। চ্যানেল ফোর তখন প্রশ্ন রেখে রিপোর্ট করে বিলাতের জন্যে বিপদজ্জনক এই ব্যক্তিকে বিলাতে প্রবেশের অনুমতি কী করে দিয়েছে সে দেশের হোম অফিস।
হোম অফিস তখন চ্যানেল ফোরকে বলে সাঈদিকে ভিসা দিয়েছে ফরেন অফিস। এ নিয়ে হোম আর ফরেন অফিসের যুদ্ধ তখন তুঙ্গে।
আসলে সাঈদিকে ওই সময়ে ব্রিটিশ ফরেন অফিস কোন ভিসাই দেয়নি। সাঈদির পাসপোর্টে আগে থেকেই বিলাতের পাঁচবছরের মাল্টিপল ভিসা ছিল। বাংলাদেশের প্রভাবশালীদের অনেকের পাসপোর্টেই এমন বিলাত-আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশের মাল্টিপল ভিসা থাকে।
সাঈদিকে নিয়ে বিলাতের হোম অফিস আর ফরেন অফিসের এমন টাগ অব ওয়ারের সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সেখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আমিন আলীর সঙ্গে পরামর্শ করতে যায়।
আমিন আলী লন্ডনের বিখ্যাত রেডফোর্ট রেষ্টুরেন্টের মালিক। বিলাতে তখন লেবার পার্টি ক্ষমতায়। লেবার পার্টির নেতাদের সঙ্গে আমিন আলীর ব্যক্তিগত সখ্য রয়েছে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সহ লেবার পার্টির প্রভাবশালী নেতারা সপ্তাহে এক দু’দিন রেডফোর্টে খেতে যেতেন।
২০০৬ সালে এই আমিন আলীই আমাকে দিয়ে প্রথম রুশনারা আলীর ইন্টারভ্যু করিয়েছিলেন। সেই ইন্টারভ্যুর কপি লেবার পার্টির হাইকমান্ডে দিয়ে তখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিনিধি হিসাবে রুশনারা আলীর প্রথম মনোনয়ন আদায় করেন।
ওই সময়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা আমিন আলীর কাছে জানতে চান তারা যদি সাঈদিকে ধরে মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেন এতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
আমিন আলী তাদেরকে বলেন সাঈদিকে গ্রেফতার করে আমেরিকার হাতে তুলে দিতে গেলে সাঈদি আন্তর্জাতিক ফিগার হয়ে যাবেন। এরচেয়ে বরঞ্চ সাঈদিকে খবর পাঠানো যেতে পারে যে তাকে গ্রেফতারের চিন্তা করছে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। এমন খবর পেলে সাঈদি নিজে নিজেই চলে যাবেন।
সেটাই করা হয়। আমিন আলীর বুদ্ধিতে সাঈদিকে খবর পাঠানো হলো যে তাকে গ্রেফতারের চিন্তা করা হচ্ছে। এমন খবর পেয়ে বিলাতের ওয়াজের সব কর্মসূচি বাতিল করে ঝড়ের বেগে দেশে ফিরে যান সাঈদি।
আমেরিকা-ব্রিটেনে ওয়াজের মার্কেটটি ছিল সাঈদির উপার্জনের বড় উৎস। কিন্তু প্রথমে আমেরিকা পরে বিলাতের বাজারটি এভাবে বন্ধ হয়ে গেলে সাঈদির অর্থনৈতিক ভিত্তি ভেঙ্গে যায়।
কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশের মিডিয়ায় রাজাকার সাঈদিকে নিয়ে প্রথম রিপোর্ট, তার আমেরিকা-বিলাত যাওয়া বন্ধের রিপোর্টগুলোও আমার হাতে হয়েছে। এরপর কিন্তু লইট্যা ফিস, সোনা পাখি, ময়না পাখি অডিওর চেয়ে সাঈদির আর কোন ক্যাসেট অতো জনপ্রিয়তা পায়নি।
গত কয়েকদিন ধরে হঠাৎ করে যুদ্ধাপরাধী সাঈদির মুক্তি দাবি করে তার ভক্তরা অনলাইনে বিশেষ তৎপর। আমাকে একজন জানালো টুইটারে নাকি তার মুক্তি দাবির পক্ষটি তৎপর বেশি। তাকে বলেছি এদের দৌড় শুধু অনলাইনেই। মাঠে নামার শক্তি তাদের নেই। কারন মাঠটি বাংলাদেশের।
মানুষকে ভুল বুঝিয়ে সাঈদি চাঁদে দেখা যাবার গুজব ছড়িয়ে তান্ডব বারবার সৃষ্টি করা যায়না। বারবার বোকা বানানো যায়না মানুষকে। কাদের মোল্লার ঘটনাটি মনে করিয়ে দিলাম।
কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ মানুষ হয়তো এক পর্যায়ে আদালতের সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিতো। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ঔদ্ধত্ত্ব্যের আঙ্গুল দেখিয়ে শাসানি মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল।
এরপর শাহবাগ বিপ্লব, কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির পর একের পর এক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতার ফাঁসি কেউ ঠেকাতে পারেনি।
সাঈদির উপজেলা চেয়ারম্যান ছেলেকে স্থানীয় পুলিশের গার্ড অব অনারের সালাম দেবার ঘটনার কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা কি তারা ভুলে গেছেন? এরপর কি আর কেউ সেই সালাম দেবার নেবার চেষ্টা করেছে?
কারন দিন শেষে কিন্তু এই পুলিশ বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ কিন্তু রাজারবাগের পুলিশ। দেশের একটি এলাকার মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একজন উপজেলা চেয়ারম্যান হতে পারেন।
কিন্তু তার পিতাতো পাকিস্তান রক্ষার জারজ সৈনিক। বাংলাদেশের নয়। তাদের ফাঁসি দিলে প্রতিবাদ হয় পাকিস্তানের সংসদে। একেকটি ফাঁসির পর তাদের আশ্রয় বিএনপি পর্যন্ত মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়। কোথাও একটা মিলাদও দিতে পারেনা।
কাজেই সাঈদির বিষয়টি যারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তারা হয়তো ভুলে গেছেন সাঈদির যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিরুদ্ধে একটি আপিল আবেদন এখনও বিবেচনাধীন আছে আপিল বিভাগে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এই আপিল ফয়সালায় আন্তরিক।
অতএব কেউ যাতে ভুলে না যান ফাঁসির মঞ্চ ডাকছে যুদ্ধাপরাধী সাঈদিকে। কসাই কাদের মোল্লার ঔদ্ধত্ব্যের আঙ্গুলের ফয়সালাও হয়েছে ফাঁসিতে। সাঈদিরও তাই হবে। কারন বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টে এখন কোন পাকিস্তানি বিচারপতি নেই। বাংলাদেশের লক্ষ কোটি প্রিয় প্রজন্ম এখানে জয়বাংলার যোদ্ধা। পাকিস্তান জিন্দাবাদের না।