বাংলাদেশে গেছে আমার সিডনিবাসী এক প্রিয় প্রজন্ম। ঢাকায় গিয়ে ফোনে বললো গত এক বছরে ঢাকার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এত ধুলাবালি যে তার এরমাঝে কাশি-শ্বাস কষ্ট দেখা দিয়েছে। আমি তাকে মজা করে বলি, একেই বলে দুই দিনের বৈরাগী, ভাতরে কয় অন্ন। এই দেশেই জন্ম তোমার, এখানেই বড় হয়েছো। এখন এক বছর ধরে সিডনি থেকে তোমার আর দেশ ভালো লাগছেনা! ছেলেটি বললো, আসলেই ভাই, এক বছরে লাইফ স্টাইল অনেক বদলে গেছেতো, এখানে এসে এখন পানি খেতেও ভয় করে। সিডনিতে আমরা বাসায় সবাই টেপে চাপ দিয়ে সাপ্লাইর পানি খাই। ছেলেটি বললো সিডনিতে আমরা বাসায়ও আস্তে কথা বলি। পাছে প্রতিবেশী বিরক্ত হয়। আর ঢাকায় চার দিকে শুধু শব্দ আর শব্দ! ক’দিন পর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। নির্বাচনের উত্তাপে কানফাটা শব্দদূষন চলছে। ঘরে ঘরে যে এসএসসি পরীক্ষার্থী এ নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা নেই! এ অবস্থায় বাচ্চা ছেলেপুলেগুলো পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোযোগ কী করে দেবে? ছেলেটি আমাকে বলে এই পরীক্ষার্থী বাচ্চা ছেলেপুলের কথা যারা ভাবেনা তারা কিভাবে ঢাকাবাসীর কল্যান নিয়ে ভাববে ভাই!
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে চারজন প্রধান প্রার্থী তাদের সবাই কোটি কোটি টাকার মালিক। ক্ষমতাসীন দলের দুই প্রার্থীরতো অনেক টাকা। আতিকুল ইসলাম ব্যবসায়ীদের নেতা, ঢাকার মেয়র ছিলেন। আর ব্যারিষ্টার তাপস গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের অনেক দুর্নীতিবাজের উকিল হিসাবে অনেক টাকাকড়ি কামিয়েছেন। সিলেটের রাগিব আলীকেও জামিন করাতে পেরেছেন এই শেখ সেলিমের ভাইপো এই তাপস। আর বিএনপি যে এতদিন ক্ষমতার বাইরে তাদের প্রার্থীদের দেখে তা বোঝার উপায় নেই। তাবিথ আউয়ালের নামডাক বিদেশি দুর্নীতি তদন্তেও আছে। ইশরাক হোসেন উত্তরাধিকার সূত্রে বিশাল অংকের টাকা পয়সার মালিক। অনেকটা আন্দালিব রহমান পার্থের মতো। নাজিউর রহমান মঞ্জুরের মৃত্যুর পর তার ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থ শুধু বিজেপির চেয়ারম্যান পদ নয়, পিতার দুর্নীতির বিশাল অংকের অর্থ বিত্তের মালিক বনে যান।
ঠিক তেমনি ইশরাকের সব বিত্ত-বৈভব তার পিতার সাদেক হোসেন খোকার রেখে যাওয়া। সাদেক হোসেন খোকা স্বনামখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি দুর্নীতির মামলার বিচার এড়াতে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন। ওই সময় বিদেশ চলে যান ইশরাকও। আমেরিকার মতো দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা কী পরিমান ব্যয়বহুল তা ওয়াকিফহালরা জানেন। কিন্তু সাদেক হোসেন খোকাকে আমেরিকায় ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্যে কারও কাছে কোন দিন হাত পাততে হয়নি। আমেরিকার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের সময় বাংলাদেশি পাসপোর্ট জমা দেয়ায় মৃত্যুর সময় সাদেক হোসেন খোকার হাতে কোন পাসপোর্ট ছিলোনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
ঢাকা শহরে যে পরিমান জনসংখ্যা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রায় সমান জনসংখ্যা। এমন একটি জনবহুল শহরের একমাত্র সিটি কর্পোরেশনকে যখন দু’ভাগ করা হয় তখন বাংলাদেশের পন্ডিতনমন্য লোকজন বিরোধিতা করেছিলেন! অথচ ঢাকায় যে পরিমান জনসংখ্যা এখানে তিরিশটি সিটি কর্পোরেশন করেও নানান সংকট সামাল দেয়া কঠিন হবে। সিডনি মহানগরীতে সিটি কর্পোরেশন ১৪ টি।
ঢাকার নানা সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন সময়ের মেয়ররা সিটি গভর্নমেন্ট গঠনের দাবি করলেও কোন সরকার তাতে সায় দেয়নি। অথচ মেয়ররা এখানে ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার! কারও কোন ক্ষমতাই নেই। মশা মারার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই সিটি কর্পোরেশনের! রাস্তাগুলো ময়লার ভাগাড়। নগরীর ফুটপাথে, রিক্সার গায়েও হাত দিতে পারেননা মেয়ররা। মেয়র আনিসুল হক তেজগাঁওর সাত রাস্তার এলাকার রাস্তার ওপর থাকা ট্রাক টারমিনাল অপসারন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর ট্রাক টারমিনাল আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। ষানজটের শহর ঢাকা। নতুন ঢাকা-পুরনো ঢাকা কোন অংশেই রাস্তায় কোন গতি নেই। মেট্রো রেল সহ নানা মেগা প্রকল্পের জন্যেও ঢাকা এখন একটি স্থবির শহরে পরিণত হয়েছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবেলায় ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম’ বলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই ঢাকার মেয়রদের। পুরনো ঢাকার মেয়রের সরকারি বাসস্থান মেয়র ভবন নতুন ঢাকার গুলশানে! অর্থাৎ ঢাকা দক্ষিনের মেয়র তারা এলাকায়ও থাকেন না!
অতএব চার মেয়র প্রার্থী মিলে যে সব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন এর বেশিরভাগ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। এগুলো বাস্তবায়নের কোন সামর্থ্য-ক্ষমতাই মেয়রদের নেই। সরকারি দলের মেয়র প্রার্থীরা জয়ী হলেও যাও কোন কোন কাজ নিয়ে সরকারি নেতাদের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ আছে। বিরোধীদলের মেয়ররা জিতলে এর কোন সুযোগই নেই। বাংলাদেশে সে সংস্কৃতিও নেই। সিলেটের বিরোধীদলের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দীর্ঘদিন কারাগারে কাটিয়েছেন। অতঃপর বিএনপির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে সরকারি দলের মন্ত্রীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে কাজকর্ম কিছু করা চেষ্টা করছেন। কারন প্রচলিত আইন কানুন এমন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নানান ছলছুতোয় মেয়রকে বরখাস্তও করতে পারে।
আর ঢাকায় বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, ইশরাক হোসেন প্রথম দিন থেকে হেং করেঙ্গা তেং করেঙ্গা উচ্চারনে মাঠ উত্তপ্ত করে ফেলেছেন! যেন ঢাকাবাসীর জন্যে কিছু কাজ করার চেষ্টা নয়, মূল মিশনটি হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে ফেলবেন! তাদের শিশুতোষ চিন্তায় কেনো মনে হলো তারা তা করতে গেলে শেখ হাসিনা বসে বসে বাদাম খাবেন! তাবিথ-ইশরাক দু’জনের সঙ্গে যে দুর্নীতির টাকাপয়সাও আছে। সৎ মানুষেরা অনেক কিছু পারে। দুর্নীতির টাকাপয়সাওয়ালাদের সময়ের প্রয়োজনে ইয়া নফসি ইয়া নফসি করতেও হয়। সব মিলিয়ে ঢাকায় যে ভোট হচ্ছে এতে ঢাকার শান্তি আসার সম্ভাবনা কম। শব্দ দূষনে ঢাকাবাসীর জীবন আরও অতিষ্ট। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হলো তা কোনদিন পূরন হবার নয়। লেমিনেটেড ব্যানার-পোষ্টারে যারা নগরীর বারোটা বাজিয়েছেন তারা কী করে ঢাকার পরিবেশ রক্ষার কাজ করবেন? নির্বাচনের পর আরও অশান্তি আসতে পারে। কারন বাংলাদেশে বিজিত প্রার্থীর বিজয়ী প্রার্থীদের অভিনন্দন জানানোর রেওয়াজ নেই।