মিশরের মৃতের শহরে থাকেন দেশের গরিব জীবন্ত মানুষেরা

কায়রোর ডেডসিটি তথা মৃতের শহরে এখন মিশরের অনেক গৃহহীন, গরিব মানুষজনের আশ্রয়স্থল। থাকার ঘর। অনেকটা বাংলাদেশের বস্তির মতো। কায়রোর কবর বাড়িগুলোয় দুই কোটির বেশি মানুষ থাকেন।

সারা মিশর জুড়ে থাকেন এমন নয় কোটির বেশি দরিদ্র মানুষেরা। বাংলাদেশের কোনএকটি কবরস্থানে আপনি কী থাকতে পারবেন? ভয় করবে না? কবর এলাকার মসজিদে কোন ইমাম-মুয়াজ্জিনের থাকার ঘর থাকতে পারে।

কিন্তু কবরস্থানে সপরিবারে কেউতো আপনাকে থাকতেও দেবেনা। মিশরের এটিও সত্য বাস্তব। যে গরিব মানুষ, যার থাকার ঘর নেই, তার আবার কিসের ভয়। গরিব জীবনতো জনমভর গরিব সারা দুনিয়া জুড়ে।

যার ঘর নেই তাদের থাকার মুখস্ত জায়গা যে রাস্তার পাশে! রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে যাদের জীবন, তাদের জন্যে কবর হোক আর শ্মশান হোক, মাথার ওপরের ছাদটাই গুরুত্বপূর্ন।

আর মিশরের এসব কবর বাড়ির প্রতিটির নীচতলার গ্রাউন্ড ফ্লোর জুড়ে যেহেতু মেঝের নীচে শুধু কবর আর কবর, মেঝের ওপরে একাধিক খালি ঘর, সেখানে যেহেতু স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকেন ঘরহীন গরিব মানুষেরা!

অনেকে বস্তির ঘরের মতো সেখান গড়ে নিয়েছেন মাথাগুজার ঠাঁই! নিজের একটি বাড়ি! এমন কবর বাড়িতে বংশ পরষ্পরায় এসব পরিবার থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এটি তাদের কবর বাড়ির জীবন।

এমন কবর বাড়িতে থাকা অনেক ছেলেমেয়ের জন্ম সেখানেই। সেখানেই তারা বড় হয়েছে। সেখান থেকেই তাদের অনেকে স্কুলেও যায়। অনেকের বিয়ে সাদিও হয় কবর বাড়িতে! সেখানে তাদের মৃত্যু-দাফনও হয়।

এমনকি কবরের ওপরে থাকা ছেলেমেয়ের যৌন নিপীড়নের অভিযোগও ওঠে। অভিযোগের তদন্ত করতে সেখানে পুলিশও আসে! গরিব মানুষজনের জীবন সবখানেই এমন! গরিব মানুষজন পৃথিবী যেখানে থাকুক সে লাঞ্ছিত। সুবিধা বঞ্চিত।

মিশরের কায়রোয় গেলে আপনি যে ডেড সিটি দেখবেন, এটি কিন্তু হঠাৎ করে কয়েক বছরে গড়ে ওঠেনি। সাত কিলোমিটার লম্বা এলাকাটি অনেকটা উপশহরের মতো। এরসঙ্গে মিশর নামের দেশ, কায়রো নামের শহরের ইতিহাসও জড়িত।

আরবিতে এর নাম আর কারাফা। ৬৪২ সালে মিশর দখলকারী এক মুসলিম কমান্ডার এটি গড়ে তুলেছিলেন। ১১ শতকের দূর্ভিক্ষের সময় বিপুল মানুষের মৃত্যুতে এর নানা অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়লেও পরে এলাকাটি আবার পুনঃনির্মান করা হয়।

হযরত মোহাম্মদের (দঃ) কোরাইশ বংশের মিশরের মর্যাদাপূর্ণ উত্তরসূরী ইমাম আল সায়াফি’র (রাঃ) কবরকে কেন্দ্র করে প্রথম কবরস্থানটির গোড়াপত্তন হয়। এরপর থেকে বছরে বছরে-শতকে-শতকে-সহস্র বছরে এর পরিসর শুধুই বেড়েছে।

ইমাম হাসানের (রাঃ) এর সূত্রে মিশরে গড়ে বেড়ে ওঠা হযরত মোহাম্মদের (দঃ) বংশধরদের অনেকের কবর এই কায়রো ডেডসিটিতে। মিশরের বিখ্যাত অনেক মানুষের শেষ শয্যা হয়েছে এই মৃতের শহরে।

 বিশাল কবর এলাকার বিভিন্ন অংশে ইমাম আল সাফি, সাঈদা রুকাইয়া সহ হযরত মোহাম্মদের (দঃ) বংশধর অনেকের নামে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন মাজার-মসজিদগুলো কালের সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি এমন একটি কবর বাড়িতে গিয়ে দেখি পরিবারের সবাই সেখানে গোল হয়ে বসে টিভিতে মুম্বাইর ছবি দেখছিলেন! ছবির হাসির দৃশ্য দেখে সবাই হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন! তখন পাশের বাড়িতে দাফনের জন্যে একটি লাশ এসেছিল।

সেই দাফনকে কেন্দ্র করে স্বজনরা সেখানে কাঁদছিলেন। বুক চাপড়াচ্ছিলেন। আর যারা টিভিতে ছবি দেখছিলেন তাদের একজনকে ইশারায় সে দিকে দেখাতেই তাদের হেসে গড়াগড়ি খাওয়া যেনো আরও বেড়ে গেলো!

তারা আমার ভাষা বোঝেননা। আমি তাদের ভাষা বুঝিনা। তারা টিভিতে ভারতীয় ছবি দেখছিলেন। চোখের সামনে ভারতীয় উপমহাদেশের রঙ-চেহারার আরেকটা মানুষ দেখে তাদের হয়তো উল্টো বিস্ময়-বিনোদন বেড়ে গিয়েছিল!

পাশে বসে এই মহিলা পরিবারের রান্না করছিলেন। রান্না করতে করতে তার চোখও টিভিতে চলা সিনেমার দিকে। গরিব মানুষের অদ্ভূত জীবন বাস্তবতার জীবন্ত বাস্তব যেনো সেই ছবি!

কেউ একজন সিনেমা পাল্টে খেলা দেখতে শুরু করেছে টিভিতে। তখন কোন একটি চ্যানেলে লাইভ ফুটবল খেলা চলছিল। একটা গোল হলো বুঝি খেলায়। সে গোলকে কেন্দ্র করে তাদের উচ্ছাস-চিৎকারের শব্দও বেড়ে গেলো। পাশের কবর বাড়িতে মৃতের স্বজনের কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেলো সেই উচ্ছাসের শব্দে!

ফুটবল মিশরের জনপ্রিয় খেলা। ফুটবল ক্লাবের নামে শহরের একেকটি এলাকার নাম হয়ে গেছে। ঢাকার একটি এলাকার নাম আবাহনী বা একটি এলাকার নাম মোহামেডান বললে-ভাবলে সেটা অস্বাভাবিক মনে হবে।

কিন্তু কায়রো একটি ফুটবল প্রেমিকদের শহর। বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে আমার বিস্ময় এভাবে কবরের ওপর থাকা-ঘুমানো বা টিভি দেখা! মৃতের শহর এখানে জীবন্ত গরিব মানুষের থাকার শহর।

আমাকে তাদের অনেকে বলেছেন,  তারা গরিব। কাজের জন্যে শহরে এসেছিলেন। প্রথম দিকে যেখানে কাজ পাওয়া কষ্টের ছিল বাসাভাড়া করে থাকা কঠিন হয়ে যায়। তখন তারা মানুষের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে চলতেন।

ডেড সিটিতে যেহেতু মানুষ মৃতের দাফনের উদ্দেশে আসেন তাদের মনও নরম থাকে। তাই তাদের কাজে সাহায্য পাওয়াও সহজ হয়। তখন তারা দেখেন এসব বাড়িতেও অনেক মানুষ থাকেন।

তাদের দেখাদেখি তারাও এমন কোন পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকা শুরু করে দেন। কবর বাড়িতে থাকতে প্রথম দিকে ভয় করতো। রাতের বেলা দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে যেতো। ঘুম থেকে জেগে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকে কখনও পাশাপাশি শুয়ে থাকা দুটি মৃত মানুষও মনে হয়েছে!

দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে দৌড়ে এলাকাটি ছেড়ে গেছেন, ঘোর কেটে গেলে আবার ফিরে এসেছেন, এমনও ঘটেছে। কিন্তু পরিবারের যাদের জন্ম এই কবর বাড়িতে তাদের এ নিয়ে কোন আলাদা বোধ নেই।

জন্ম থেকেইতো তারা দেখে আসছে এ জীবন! এসব কবর বাড়ির যারা মালিক তাদের পরিবারের সদস্যরা মৃতের জন্মদিন, মৃত্যু বার্ষিকী অথবা নতুন কারও কবর উপলক্ষে এসব বাড়িতে আসেন।

তাদের সিংহভাগ এমন লোকজনকে সে বাড়িতে আশ্রিতদের দেখে বিরক্তও হননা। বরং তাদের অনেকে তাদেরকে বাড়ির দেখভাল, পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব দিয়ে যান। মৃতের সৎকারের জন্যে সময় যারা এগুলোয় আসেন তাদের অনেকে ওই সময় এখানে দিন কয়েক থাকেন।

জন্মদিন মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আসা লোকজন মোটামুটি থাকেন সারাদিন। এরজন্যে তাদের একটি থাকার ঘর, রান্নাঘর, বাথরূম, বিদ্যুৎ-পানির ব্যবস্থা মোটামুটি গোছানো থাকে।

যাদের কবর বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই তারা বাড়িতে একটি জেনারেটর রাখেন। অনেকে জেনারেটর, কবর বাড়িতে আশ্রিতদের ব্যবহারের জন্যে রান্নাঘর-বাথরূমের চাবি দিয়ে আসেন।

তাদের মৃতের জন্যে নিয়মিত কোরান পড়বে, দোয়া করবে এই শর্তে দিয়ে আসেন টাকা-পয়সা। অথবা তারা ফিরে যাবার সময় তাদের সঙ্গে থাকা খাবার ও তাদের বাড়তি কাপড়চোপড়, কম্বলও তাদের দিয়ে আসেন।

কম্বল মিশরে শুধু রাতে ঘুমাতে নয়। দাফনেও ব্যবহার হয়। মরভূমিতে আমি কম্বলে পেঁচিয়ে অনেক লাশ দাফনও দেখেছি। জীবন যেখানে জীবন।