নানান সীমিত সামর্থ্যে করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটা বাংলাদেশ মোটামুটি ভালোই শুরু করেছিল। বাংলাদেশের সামর্থ্য বলতে এর অল্পতে খুশি হ্যাপি জনগোষ্ঠীর এক মওসুমে ফসল ভালো হবার অভিজ্ঞতার সঙ্গে বর্ননা করা চলে। ফসল ভালো হলে কৃষক ফসলের দাম না পেলেও বাজারে চাউলের দাম নিয়ন্ত্রনে থাকলে বাংলাদেশের লোকজন মোটামুটি ভালো আছি, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন জাতি, এসব স্বগোতোক্তি সহ তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।
কিন্তু কোন এক মওসুমে যদি অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় হাওর বা দেশের কোন একটি এলাকার ফসল, তখন খাদ্য আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার সহ নানাকিছুতে বাংলাদেশকে যে কি সব প্রতিক্রিয়া দেখানো লাগে, তা মোটামুটি সবার মুখস্ত অভিজ্ঞতা। এক মওসুমে ভারত পিঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করাতে বাংলাদেশের কি অবস্থা দাঁড়িয়েছিল সে অভিজ্ঞাতো এইতো কিছুদিন আগের।
এবার করোনা যুদ্ধের শুরুতে বাংলাদেশে যখন কম টেস্ট হচ্ছিলো তখন দেশের বিজ্ঞ ভাবকরা অনভিজ্ঞরা টেস্ট কম তাই রোগীও কম বলে বলে উপহাস করা-লেখা শুরু করেছিলেন! কিন্তু একটু কষ্ট করে বাংলাদেশের সামর্থ্য তারা খুঁজে দেখার জানার চেষ্টা করেননি। অথবা সে সাহস করেননি।
কারন তাদের অনেকেও যে নিজস্ব নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অথবা জ্বর-কাশির চিকিৎসা করতেও সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক যান! গ্লুকোমার মুখস্ত চিকিৎসায় লাটবহর সহ নিয়মিত বিলাত যান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি! অথচ এইসব ক্ষমতাবানরা কখনও দেশের চিকিৎসা সামর্থ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেননি!
অথবা অন্য সত্য প্রকাশের ভয়ে তারাও এই সময়ে চুপ মেরে গেছেন! যখন জেনেছেন গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দকৃত বিপুল অর্থ সুনিপুন দক্ষতায় খেয়ে ফেলেছেন দেশের কোন একজন সাবেক পরাক্রমশালী! যার ছেলেরা এখন আমেরিকার বিশিষ্ট রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী!
এবার মূলত চীন পরিস্থিতি সামাল দেবার পরই সেখান থেকে কিট-মাস্ক-পিপিই এসব পেতে শুরু করার পর বাংলাদেশ কিছুটা সামর্থ্য অর্জন শুরু করে। যদিও চীনা অনেক পন্যের মান নিয়ে এখন প্রশ্ন চলছে বিশ্বব্যাপী।
নিম্নমানের চীনা পিপিই-মাস্ক এসব ফ্রি স্টাইল আমদানি করে যথাযথ যাচাইবাছাই ছাড়াই চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে বিলি করে তাদের করোনায় আক্রান্ত করিয়েছেন প্রচার প্রেমিক এক সিটি মেয়র!
এরপরও এই মহামারীর সংক্রমনে যেহেতু বিশ্বজুড়ে পরাশক্তি-দূর্বল দেশ, ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, মুসলমান-হিন্দু বলে আলাদা কোন বাছ-বিচার নেই সেহেতু এই যুদ্ধের লড়াইটা যার যার সামর্থ্য অনুসারে কৌশলগত।
কিন্তু কিছু কৌশল বিশ্বজুড়ে সবার জন্যে সমান। তাহলো, ঘরে থাকা, ঘন ঘন সাবানে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা, এবং বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যসম্মত-পরিচ্ছন্ন মাস্ক ব্যবহার।
চীনের মতো কড়াকড়িভাবে লকডাউন যারা কার্যকর করতে পেরেছে ভিয়েতনাম অথবা শ্রীলংকার মতো তারাই বেশি সাফল্য পেয়েছে এ যুদ্ধে।
বাংলাদেশের যেহেতু নিজস্ব চিকিৎসা সামর্থ্য কম, দেশের হাসপাতালগুলোর বেশিরভাগে যেহেতু মানসম্মত অবাঠামো নেই, বাংলাদেশের রোগী-ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের সিংহভাগ যেহেতু উজ্জ্বল অজুহাত মাষ্টার!
তাই বাংলাদেশের জরুরি দরকার ছিল রোগটা যাতে না হয় সে জায়গাতে অটল অটুট থাকা। কিন্তু বাংলাদেশের যে জায়গাটি এরমাঝে ভেঙ্গে পড়েছে!
মানুষকে ঘরে রাখতে প্রথম থেকে অনেক পরিশ্রম করেছে বাংলাদেশের পুলিশ এবং সেনা সদস্যরা। কোথাও কোথাও এখনও করছে। কোথাও কোথাও সেনা বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে গাড়িতে বসে থাকলেও আসল কাজটা করে দেশের সিভিল প্রশাসন।
কারন এখনও শুধু সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখেই অনেকে ভয়ে ঘর থেকে বেরোয়না। কিন্তু বাংলাদেশের এই কষ্টগুলোও সাফল্যে পৌঁছবার আগেই পন্ড হতে বসেছে!
কারন বাংলাদেশের গরিব মানুষজনের সামর্থ্য কম। এই সামর্থ্যহীন সব মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেবার কথা বলেছিল বাংলাদেশ।
বলেছিল এখন পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের হাতে কার্ড আছে। আরও পঞ্চাশ লাখের কার্ড করে এক কোটির মানুষের ঘরের পাঁচ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে খাবার!
কিন্তু এই ঘোষনা বাস্তবায়নের কোথাও না কোথাও গলদ আছে বলেইতো এই মানুষেরা সরকারি ঘোষনায় ভরসা না করেছে বেরিয়ে পড়েছে জীবিকার সন্ধানে! এরা করোনায় মরার ঝুঁকি নিতে রাজি আছে। কিন্তু ক্ষুধায় মরতে রাজি নয়!
প্রথম বলা হয়েছিল, এই রাষ্ট্র পোশাক কারখানার শ্রমিক সবার ব্যাংক অথবা মোবাইল ফোনের একাউন্টে আগামী তিন মাস যার যার বেতনের টাকা পৌঁছে দেবে! এই অর্থ গার্মেন্টস কারখানার মালিকদের নামে দেয়া হবে স্বল্পহার সুদে!
কিন্তু বাংলাদেশ সম্ভবত এ ঘোষনায় আর অটুট নেই! অথবা পোশাক শ্রমিকরাও আর এই ঘোষনায় বিশ্বাস করে ঈমান আনতে পারে নাই!
অতএব বেতন এবং চাকরি রক্ষায় এই গণপরিবহন বন্ধের সময়ে পোশাক শ্রমিকরা হেঁটে-ভ্যানে-ট্রাকে যে যেভাবে পেরেছে ঢাকা অথবা কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গিয়েছে!
করোনা মহামারীর এই সময়ে এখন পর্যন্ত নানাকিছুতে বাংলাদেশ সমন্বয়হীন হওয়াতে পোশাক শ্রমিকরা এখন পর্যন্ত ঘরে থাকা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আবেদন দুমড়েমুচড়ে দিয়ে দু’বার করে মোট চারবার আসা যাওয়া করেছেন এবং এখনও করছেন!
বাংলাদেশের বয়স্ক লোকজন জানেন, এই জনপদের লক্ষ লক্ষ মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু প্রানের ভয়ে এভাবে দীর্ঘপথ হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়েছিলেন।
এবার ভীতিকর এই সময়ে যখন প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, তখন এভাবে পোশাক কারখানা খুলে দেবার জন্যে আমরা প্রথমে অতি সরলভাবে এরজন্য বানিজ্যমন্ত্রী, বিজেএমইএ’র সভাপতি সহ কিছু পোশাক কারখানার মালিককে দায়ী ভেবেছিলাম।
কিন্তু এরমাঝে জানা গেলো সিদ্ধান্তটি হয়েছে সরকারিভাবে। বাংলাদেশের পক্ষে এরমাঝে সুইডেনকে জানানো হয়েছে আমরা ভয়ডরহীন স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে পোশাক কারখানাগুলোয় কাজ করতে শুরু করে দিয়েছি!
মূলত পোশাক শ্রমিকদের ব্যাপক মুভমেন্টের মাধ্যমে ভেঙ্গে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষকে ঘরে থাকতে বলার শপথ।
সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ধান কাটার মৌসুমি শ্রমিক পাওয়া নিয়েও উদ্বেগ দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহবানে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কাটার শ্রমিকদের হাওর অঞ্চলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। ছাত্রলীগও এরমাঝে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের ধান কাটায় সহায়তা করে প্রশংসা পেয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের কতিপয় কান্ডজ্ঞানহীন মন্ত্রী-নেতা ধান কাটার ফটোসেশনের জন্যে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার মহামারী আইনকে অবজ্ঞা করেছেন! স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই সামাজিক দূরত্বের বিষয়ে অবজ্ঞা করা হয়।
সর্বশেষ হাওরে ধান কাটায় সহায়তার নামে কান্ডজ্ঞনহীন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে সামাজিক দূরত্বের আইনকে চরমভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে।
হাওরে ধান কাটা উদ্বোধনের ফিতা কাটার নামে, ধান কাটার নামে দুই মন্ত্রীর নেতৃত্বে সামাজিক নিরাপত্তা আইনকে অবজ্ঞার পাশাপাশি এই মহামারীতে গণসংক্রমনের চরম এক বিপদজ্জনক মহড়া করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের অবকাঠামোও বাংলাদেশে নেই।
একবার অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলের একটি ছবি ছাপা হয় স্থানীয় মিডিয়ায়। ছবিতে দেখা যায় টার্নবুল একটি স্পিডবোটে বসে আছেন। ওই ছবি দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে ঠিকানায় আড়াইশ ডলারের জরিমানার চিঠি পাঠায়।
অস্ট্রেলিয়ার আইনে আছে কেউ স্পিডবোটে চড়ার সময় তার পরনে একটি দৃষ্টিযোগ্য নিরাপত্তা ভ্যাস্ট থাকতে হবে। টার্নবুলের পরনে তা ছিলোনা।
জরিমানার চিঠি পেয়ে প্রধানমন্ত্রী টার্নবুল অপরাধ স্বীকার করে জরিমানা পরিশোধ করায় তাঁর জনপ্রিয়তাও বাড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় ক্ষমতায় ছিলেন এই টার্নবুল।
অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় রাগবি লীগ এনআরএল এর তিন জনপ্রিয় তারকা এই মহামারীর সময়ে সমুদ্র সৈকত লাগোয়া এক খামার বাড়িতে ক্যাম্পিং এ গিয়েছিলেন। এই মহামারীর সময়ে যা অস্ট্রেলিয়ায় নিষিদ্ধ।
ক্যাম্পিং এ গিয়ে সামাজিক দূ্রত্ব না মেনে তারা ভক্তদের সঙ্গে ছবি তোলেন। হেলমেট ছাড়া মোটর সাইকেল চালান এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করে শিকার করেন।
এই তিন তারকার একজন এসবের ছবি-ভিডিও পোষ্ট করেছিলেন ইন্সটাগ্রামে। পুলিশ ইন্সটাগ্রামের এই ছবি-ভিডিও দেখেই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব না মানায় সেই ছবিতে থাকা সবাইকে জরিমানা করা হয়েছে মাথা পিছু এক হাজার ডলার।
হেলমেট ছাড়া মোটর সাইকেল চালানোর জন্যে তাদেরকে ৩৪৪ করে ডলার করা হয়েছে। বেআইনি শিকারের অপরাধে বিচারের জন্যে তাদেরকে আগামী আগষ্টে আদালতে তোলা হবে।
আর এনআরএল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার ডলার করে জরিমানা করেছে। তাদেরকে খেলা থেকে সাসপেন্ড করেছে বিভিন্ন মেয়াদে।
সামাজিক দূরত্ব আইন কড়াকড়িভাবে মানায় করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়া। করোনা ভাইরাস ফ্রি ঘোষনা করা হয়েছে রাজধানী ক্যানবেরাকে। কিন্তু যেহেতু এখনও করোনার কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি, তাই সামাজিক দূরত্ব সহ নানা বিধিনিষেধ এই দেশে এখনই শিথিল করা হবেনা।
বাংলাদেশ কী আইন অমান্যকারী এসব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে? এই সামর্থ্য অর্জনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধারন মানুষকে আইন মানতে বলাটাও অরণ্যে রোদন মাত্র।
যেদিন মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন এই দেশে আইন সবার জন্যে সমান হবে সেদিন এমন মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ও সহজ হয়ে যাবে বাংলাদেশের।