এই মহামারীর শুরুতে এটি মোকাবেলায় সীমিত সামর্থ্যের বাংলাদেশের নানাকিছু বেশ গোছানো মনে হচ্ছিলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন এলাকার জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও সম্মেলনে দিক নির্দেশনামূলক বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছিলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে গঠিত হয়েছে বিশেষ একটি জাতীয় কমিটি। বলা হচ্ছিল গুরুত্বপূর্ন প্রতিটি সিদ্ধান্ত এই কমিটির মাধ্যমে হবে। কিন্তু ইদানীং মনে হচ্ছে সেখানে আর কোন সিদ্ধান্ত হচ্ছেনা!
এই করোনা ভাইরাসের মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, চীনের উহানের দেখানো প্রতিষেধক ছিল লকডাউন। ঘরে থাকা। ঘনঘন হাত ধোয়া। সামাজিক সংক্রমন রোধ, ইত্যাদি। গণন্ত্রবিহীন পুলিশি রাষ্ট্র চীন এটি কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করে সাফল্য দেখিয়েছে।
অতএব কেউ বলতে পারবেনা উহানের কোন বাসিন্দা এই মহামারী রোগটি কোথাও কোন দেশে নিয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশ যখন তাদের নাগরিকদের সেখান থেকে আদরে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার সঙ্গে রোগটিও সঙ্গে নিয়ে যায়।
কিন্তু বাংলাদেশ উহান থেকে যাদের নিয়ে এসেছিল তাদের কোয়ারিন্টানটা ঠিকমতো হওয়াতে তাদের মাধ্যমে সংক্রমনটা হয়নি। বাংলাদেশে রোগটি প্রথম ইতালি প্রবাসী ও পরে অন্যদের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আসে।
কিন্তু এরপর শিবচর, সাদুল্লাপুর, এবং মিরপুরের টোলারবাগের লকডাউন সহ নানান কড়াকড়ি ঠিকমতো মনে চলায় বাংলাদেশ রোগটির প্রথম ধাক্কা বেশ ভালোভাবে সামাল দিয়ে ফেলেছিল।
আর প্রথম থেকে বাংলাদেশের পুলিশ-সেনাবাহিনী সহ বিভিন্ন বাহিনী দারুন এক দক্ষতা-আন্তরিকতায় মানুষ সামাল দিচ্ছিল এবং এখনও দিচ্ছে। মানুষকে শুধু ঘরে রাখা নয়, মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া সহ মানবিক নানা কিছুতে পুলিশের ভূমিকাটি ছিল চমৎকৃত হবার মতো।
বাংলাদেশের প্রশাসনে এখন চমৎকার মানবিক নতুন এক প্রজন্মের রক্ত প্রবাহ আছে। শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনের এই চমৎকার শক্তিকে নির্ভর করে আসছেন। এর ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশের পুলিশের থানাগুলোর সামনে, সেনা ক্যাম্পগুলোর বাইরে প্রতিদিন খাবারের জন্যে নিরন্ন মানুষেরা লাইনে দাঁড়ায়, এবং তারা সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবারও পায়! এটি বাংলাদেশ আগে ঈদের সময়টা ছাড়া এমন দীর্ঘদিন কেউ দেখেছে কী?
আর প্রতিটি দূর্যোগের মতো এবারেও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে-পাড়া-মহল্লায় দেবতার মতো দাঁড়িয়ে গেছে মানবিক মানুষেরা। তারা নানাভাবে নিরন্ন মানুষজনের জন্যে খাবার সংগ্রহ করছে। প্যাকেট করছে। দরিদ্রদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে এসব খাবার।
আবার খাবার নিয়ে যেতে পথে তা ট্রাকশুদ্ধ লুট, ত্রানের জন্যে পথ অবরোধের এক-দুটি খবরও আছে। আমাদের দেশের গরিব মানুষের আবার ধৈর্য বেশি। তাই পরিবেশ পরিস্থিতি থাকা স্বত্তেও এমন ঘটনা কম ঘটে। তবে কড়া ব্যবস্থা নেয়ায় কমে এসেছে ত্রানের চাল চুরির খবর।
আমাদের শহর কুলাউড়ায় তরুন সংঘ নামের একটি সংগঠন তাদেরকে খুঁজে ত্রান দিচ্ছে যারা শরমে প্রকাশ্যে সাহায্য চাইতে বা লাইনে দাঁড়াতে পারেননা। বাংলাদেশে এখন এদের সংখ্যা বেশি। এমন লোকজনকে খুঁজে খুঁজে সাহায্য করার উদ্যোগ বেড়েছে বাংলাদেশের অনেক এলাকায়।
সিডনিতে থেকে একজন পাহাড়ি নেত্রী, এই পরিস্থিতিতে যার নিজের কাজ নেই, তিনিও সোশ্যাল মিডিয়ায় সুহৃদ মানুষজনকে সংগঠিত করে তহবিল যাই জোগাড় করতে পারছেন তা দিয়ে ত্রান পৌঁছে দিচ্ছেন দূর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামের এলাকায় এলাকায়।
মানুষের দূর্যোগের এই সময়ে এমন দেবতা-দেবী এখন বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে প্রবাসীদের মধ্যেও বিস্তর সক্রিয়। তাই এখনও কোথাও কেউ না খেয়ে মারা যায়নি।
নওগার পত্মীতলার ছোট চাঁদপুর এলাকার কয়েকটি ছেলেকে আমি অনলাইনে চিনিজানি যারা পহেলা বৈশাখে ত্রান পৌঁছে দিয়েছে এলাকার নিরন্ন আদিবাসীদের ঘরে ঘরে।
প্রিয় প্রজন্ম এই ছেলেগুলোর জন্ম মুসলমান পরিবারে না হলেও এই রোজায় প্রতিদিন তারা খিচুড়ি রান্না করে ইফতারের আগে এলাকার নিরন্ন মুসলমান পরিবারের ঘরে ঘরে তা পৌঁছে দিচ্ছেন। খাবার বিলি করার জন্যে তারা অবশ্য বেছে নিয়েছেন কিছু মুসলমান স্বেচ্ছাসেবক।
এলাকার নিরন্ন কুকুরগুলোকেও প্রতিদিন তাদেরকে এই খাবারের ভাগ দিতে হয়। সারাদেশেই এমন ত্রান উৎসব চলছে বেশুমার। কিছু লোক ত্রান দিচ্ছেন ছবির জন্যে। আবার ছবিতে নিজেদের লুকোতে চান এই মানবিক পক্ষই বাংলাদেশে এখন বেশি।
মহামারীর এই সময়ে ধান কাটা নিয়েও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল। কারন গণপরিবহন বন্ধ থাকায় মৌসুমি শ্রমিকরা ধান কাটার এলাকায় যেতে পারছিলোনা।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলাকায় এলাকায় ধান কাটার ব্যবস্থার অনুরোধ করলে সাড়াও আসে। চট্টগ্রাম এলাকা থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর নির্বাচিত শ্রমিকদের সামাজিক দূ্রত্ব মেনে শ্রমিক পাঠানোর দেশের ইতিহাসে প্রথম একটি চমৎকার ব্যবস্থাপনার নমুনা আমরা দেখেছি।
এই শ্রমিক সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় আহামরি না হলেও এই অভিজ্ঞতা আমাদের আগামীতে কাজে লাগবে।
অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী তাঁর সন্তানদের সংগঠন ছাত্রলীগ সহ অন্যদের ধান কাটায় সহায়তার আহবান জানালে সেখানে কিছু ধান্ধাবাজ ফটোসেশন প্রেমিক-প্রেমিকার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হলেও এলাকায় এলাকায় ছাত্রলীগের ছেলেরা কিন্তু কাজটি আন্তরিকভাবেই করেছে।
এবং দিনশেষে আমাদের বাংলাদেশ নামের সাহসী দেশটার কৃষক সমাজইতো সবকিছু সামাল দেয়। এবারও দিচ্ছে। ধান-ফসল এবারও তারা বেশি উৎপাদন করেছেন। প্রতি বছরই তারা এমন বেশি উৎপাদন করে করে দাম না পেয়ে বিপদে পড়েন। এবারও পড়বেন।
এভাবে এক মহামারীকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী মৃত্যু উপত্যকার উদ্বেগের সময়ে নানাকিছু যখন বাংলাদেশ সামাল দিয়ে যাচ্ছিল তখন পোশাক শ্রমিকদের মাধ্যমে বারবার উদ্বেগ ছড়িয়েছে এবং এখনও ছড়াচ্ছে।
এই পোশাক শ্রমিকরা এতোদিন ছিল বাংলাদেশের গৌরবের, এখন হয়ে গেলো আতঙ্কের! দেশে যখন লম্বা সরকারি ছুটি, গণপরিবহন যখন বন্ধ, তখন পরপর দু’বার পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে এলোমেলো আচরনে বাংলাদেশ দেখালো এই মহামারীর উদ্বেগের সময়েও এ দেশ কেমন আশ্চর্য সমন্বয়হীন!
বাংলাদেশে সিংহভাগ মানুষ যেখানে আইন মানেনা, পুলিশ-সেনাবাহিনী মানেনা, চান্স পেলেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মিথ্যা কথা বলে। যেখানে গ্রামের বাজার থেকে শুরু করে ছোট-বড় শহরের পাড়া-মহল্লায় লকডাউন কার্যকর করা যায়নি!
এসবের অজুহাতে কিছু পোশাক কারখানার মালিক এখন এসব পোশাক শ্রমিকদের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমন ছড়িয়ে দেবার বিষয়টি জায়েজ করে দেখাচ্ছেন!
এই পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়া, পোশাক শ্রমিকদের দাসযুগের মতো হাঁটিয়ে, ফেরী বোঝাই করে কারখানা এলাকায় নিয়ে আসা নিয়ে সরকারি বক্তব্যেও কোন স্বচ্ছতা নেই। একজন এক রকম কথা বলেন!
অথচ এখন নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর সহ পোশাক শ্রমিকদের থাকার এলাকাগুলো থেকে এখন করোনা রোগীদের সংখ্যাও এখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কারন তারা যেভাবে বস্তিতে থাকেন তারা যেভাবে কারখানায় আসাযাওয়া করেন, এমন পরিবেশ-পরিস্থিতিই বেশি ভালোবাসেন।
আর এখানে এসে তাদের অনেকে কারখানায় স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশে কাজ নয়, এই মহামারীর সময়ে বেতনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত! শিল্প পুলিশ খোঁজ রাখছে কারখানার মধ্যাহ্ন বিরতি বা ছুটির সময়ে যাতে বেতনের দাবিতে তারা বেশি হাঙ্গামা করতে না পারে!
এসব স্বত্ত্বেও পোশাক কারখানার মালিকরাও বাজির দানখোরের মতো নির্লিপ্ত! যেন এই মহামারীতে এখন পর্যন্ত চিকিৎসক মারা গেছেন, পুলিশ মারা গেছেন, সাংবাদিক মারা গেছেন, কিন্তু পোশাক কারখানার মালিক সেভাবে মারা না যাওয়াতে তারাও বেপরোয়া!
প্রতিযোগিতার বাজারে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিকদের তাদের কাজ ধরে রাখা দরকার। পোশাক শ্রমিকদের তাদের কাজ ধরে রাখা দরকার।
ওভার টাইম সহ একজন পোশাক শ্রমিক এখানে মাসে দশ হাজার টাকার মতো আয় করেন। এ টাকায় অনেকের নিজের এবং মায়ের সংসার চলে।
তাই এখন করোনায় মরলে মরেছি, কিন্তু কাজ হারালে এখন খাবো কী, এ নিয়ে বেপরোয়া এখন এই পোশাক শ্রমিকেরাও! এই মরার দেশে সমাজে তাদের কথা শোনানোর কেউ নেই! কারন এ জীবনভর ঠকতে ঠকতে তারা আর কাউকে বিশ্বাস করেননা।
এমন সবকিছু নিয়ে চরম বিশৃংখলার মধ্যে বাংলাদেশে যখন করোনা সংক্রমন মহামারীর দিকে যাচ্ছে, প্রতিদিন চূড়ার দিকে যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা, প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যু, প্রতিদিন বাড়ছে লাশ দাফন নিয়ে সমস্যা, তখন অবাক বাংলাদেশ যেন এই মহামারীকে বাজির ঘোড়ার মতো করে আচরন করছে!
এখন এখানে এই মহামারীর সময়ে, মহামারী নিয়ন্ত্রনের সর্বোচ্চ কমিটিকে আমল পাত্তা না দিয়ে অমুকে কারখানা খোলার ঘোষনা দিচ্ছেন বানিজ্যমন্ত্রী, মসজিদ খোলার ঘোষনা দিচ্ছেন একটা এলাকার মেয়র, ইফতারের দোকান খুলে দিচ্ছে পুলিশ!
এসবে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষজনের প্রশ্ন, আসলে কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ? মহামারীর সঙ্গে কী যা ঘটার ঘটবে অথবা যা ঘটার ঘটুক এমন বাজির ঘোড়ায় সওয়ার হওয়ার আচরন চলে?
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে একটু ঢু মেরে দেখুন। দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে যেখানে এখন পর্যন্ত করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নিয়েও কোন শৃংখলা পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি!
বাংলাদেশে এখনও গড়ে ওঠেনি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী খুঁজে খুঁজে করোনা পরীক্ষার কোন ব্যবস্থাও! জিজ্ঞেস করলে উপহাসের জবাব আসে! এরা কী ফুড ডেলিভারির লোক? যে বাড়ি বাড়ি রোগী খুঁজতে যাবেন!
বাংলাদেশ এই মহামারীর সময়ে এখনও জানেনা এর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাজ কী? আজ পর্যন্ত কোথাও মানুষের সাধারন অধিকার চিকিৎসা পাবার কোন নিশ্চয়তা নেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্য কর্মীরা যারা নিরলস কাজ করছেন, তাদের ত্যাগ-কষ্ট-শ্রমও নষ্টরা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। করোনা চিকিৎসা নিয়ে যে সর্বোচ্চ একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল, এটি থাকে কোথায়? এটি কাজ করছে কোথায়?
দিনশেষে কিন্তু সব বদনাম যাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একাউন্টে। কারন বাংলাদেশে তাকে ছাড়া কিন্তু আর কোথাও কাউকে কেউ সক্রিয়-উদ্বিগ্ন-আশার সলতে দেখিয়ে আমজনতা চলতে দেখেনা।