আপনারা হয়তো খেয়াল করছেন এই করোনার সময়েও এখন আমি মাঝে মধ্যে করোনা ইস্যু বাদ দিয়ে এই লিখছি সেই লিখছি! এটা অনেকটা আপনাদের ভয় তাড়ানোর চেষ্টা বলতে পারেন।
এখন প্রতিদিন করোনা সংক্রমন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এমনিতে আপনারা অনেকে বাস্তব নানা ভয়ের মধ্যে আছেন। কাজেই খামখো আর আপনাদের ভয় বাড়িয়ে কী লাভ।
অথবা আপনারা ভয় প্রুফ। ভয়টয় পাননা! টেলিভিশনে দোকান মালিকের এক নেতা বলছিলেন সাধারন মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয় পেলে এ দেশ স্বাধীন হতোনা! এই মহামারীর সময়ে দেশের একেকজন এমন কী যুক্তিবাদীরে বাবা!
বাংলাদেশের সিংহভাগ অপরিণামদর্শী মানুষ ভয় পেলে এই সময়ে এতো লোক কী রাস্তায়, হাটে-বাজারে থাকেন? অথচ এই অস্ট্রেলিয়ায় এখন করোনা প্রায় নেই। কিন্তু লোকজনের ভয় যায়নি। কারন এখনও প্রতিষেধক বাজারে আসেনি এই মহামারীর।
কয়েকদিন ধরে রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন নিয়ে আরেকটা লেখা লিখবো লিখবো করছিলাম। সমীর দত্ত নামে ভারতে পলাতক সেই লোকটা গত জানুয়ারি মাসে উত্তর চব্বিশ পরগনার ছোট শহরটায় স্বাভাবিক মারা যাবার পর তার ডেথ সার্টিফিকেটও এখন আমাদের কাছে আছে।
ছদ্মবেশী সমীর দত্ত হিসাবে মারা যাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি কবরও পায়নি। তাই এখন মাটি খুঁড়ে তার লাশ বের করে তার ডিএনএ করাও সম্ভব নয়। হিন্দু জ্ঞানে সেখানকার লোকজন মরার পর দাহ করে ফেলেছে মোসলেহ উদ্দিন তথা সমীর দত্তের লাশ।
তার ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের একটা চিঠি পাবার আছে। চিঠিটার কপি আমি যার কাছ থেকে পেতে পারি তিনি এখন এই মহামারীর সময়ে করোনায় আক্রান্ত। তবে সুস্থ হবার পথে।
সে কারনে ভাবলাম এই রোজার দিনে আজ ইরাকের মসুলে ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত একজন নবী হযরত ইউনুস (আঃ) এর মাজার দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখি। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর আমি সারা ইরাক ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নিয়েছিলাম।
সঙ্গী ছিলেন আমার গাড়ি চালক কাম গাইড নাবিল। আমি যখন ইরাকে পৌঁছি তখন কোন গাইড খুঁজে পাচ্ছিলামনা। অথচ আরবি না জানা কোন সাংবাদিকের তখনকার ইরাকে একজন গাইড ছাড়া ঘুরে বেড়ানো বা রিপোর্ট করা ছিল কঠিন এক বিষয়।
এই নাবিল এক সময় আমেরিকায় ছিলেন। তাই তার গাড়িতে ঘুরে বেড়ানোর সময় আমার গাইডের কাজটাও হয়ে যাচ্ছিলো। সেই সময়ে ইরাক যাবার ভিসা পাওয়া, গাইড পাওয়া, রিপোর্ট পাঠানো, সবকিছুই ছিল একেকটা যুদ্ধের মতো।
ঢাকার ইরাক দূতাবাস তখন ইনকিলাবের প্রভাবে চলতো। তাই জনকন্ঠের ফজলুল বারীকে তারা ভিসা দেয়নি। সারা দুনিয়ার সাংবাদিকরা তখন জর্দান হয়ে ইরাকে ঢুকছিলেন। ঢাকায় তখন জর্দানের দূতাবাস না থাকায় সে দেশের ভিসার জন্যে আগে দুবাই যেতে হয়েছে।
দুবাইর ভিসার ব্যবস্থা করেন চট্টগ্রাম এলাকার কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি। তারা সেখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। জনকন্ঠ পড়তেন গোগ্রাসে। তখন প্রতিদিন সকালের ফ্রাইটে ঢাকার পত্রিকা দুবাই যেতো।
দেশের মতো বাংলাদেশি হকাররা সাইকেলে তখন দুবাইর বাড়ি বাড়ি গিয়ে পত্রিকা বিলি করতেন। সেই পাঠকদের কাছে জনকন্ঠের সাংবাদিক হিসাবে তখন তাদের কাছেও আমার অনেক কদর। কে কোথায় আমাকে কার বাসায় রাখবেন, ভালো খাওয়াবেন এসব নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও ছিল।
কিন্তু তারা যে তখনও এক কক্ষে দ্বিতল খাটে নীচে ওপরে অনেকে থাকতেন! মরুভূমির গরম আবহাওয়ার শহরে প্লাস্টিকের বালতি ভর্তি করে রাখা পানি সারারাতে ঠান্ডা করে সকালে সে পানিতে গোসল করে কাজ যেতেন, তাদের সে জীবন দেখার অভিজ্ঞতাতো তখনই।
এমিরেটস এয়ারলাইন্সের মিডিয়া কনসালটেন্ট কাজী ওয়াহিদুল আলম ভাই আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ইরাক যাবো শুনে তিনি আমাকে ঢাকা-দুবাই-আম্মান-দুবাই-ঢাকা রুটের একটি ফ্রি টিকেটের ব্যবস্থা করে দিলেন।
তখন আরেকটি মজার ঘটনা ঘটে। এয়ারলাইন্সগুলো সাধারনত সাংবাদিকদের সৌজন্য বা ফ্রি টিকেট দিতো প্রচারের আশায়। কিন্তু তখনও ইরাক যুদ্ধের গতি কী হয়, কে জেতে কে হারে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল।
তাই এমিরেটস আমাকে টিকেটটি দেবার সময় একটি গোপনীয়তার শর্ত শিখিয়ে দেয়! তাহলো তারা যে আমাকে ফ্রি টিকেট দিয়েছে তা যেন আমি কোথাও না লিখি বা কাউকে না বলি।
দুবাইতে তখন আরেক তোড়জোড়! ইরাক যুদ্ধের প্রভাব যে আরব আমিরাতে নেই, সেটির প্রমান দেখাতে বানিজ্যিক বুদ্ধির চিন্তার সেই দেশ তখন সেখানে ভারত পাকিস্তান দলের ক্রিকেট ম্যাচের ব্যবস্থা করেছে।
এর প্রচারের জন্যে দেশটি ভারত-পাকিস্তানের পাশাপাশি বাংলাদেশ-শ্রীলংকার ক্রীড়া সাংবাদিকদেরও দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিল। সে কারনে জনকন্ঠের এক ক্রীড়া সাংবাদিকও তখন দুবাইতে অবস্থান করছিলেন।
জর্দানের রাজধানী আম্মান শহরটা অবশ্য আমার আগেভাগে দেখা চেনা এক শহর। কোন এলাকায় সন্তায় হোটেল-খাবার পাওয়া যায় তাও জানি। কারন এর আগে একবার ফিলিস্তিন যাবার চেষ্টায় আমি আম্মান গিয়ে প্রায় দেড় মাস ছিলাম।
কিন্তু এ দফায় আম্মান গিয়ে চমকে উঠি। প্রথম দাফায় দেখা আম্মানের ডাউন টাউন তথা পুরাতন শহরের সস্তা হোটেলগুলো ছিল ইরাকি লোকজনে পরিপূর্ন। সাদ্দাম সরকারের নির্যাতনে এই লোকগুলো ইরাক থেকে পালিয়ে এসে আম্মানের এসব হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পরিবর্তিত পরিবেশে যারা দেশে ফিরে যান। সে কারনে আম্মানের ডাউন টাউনের হোটেলগুলোর প্রায় সবগুলোই ফাঁকা। হোটেলের রূমও আগের চেয়ে সস্তায় পাওয়া যায়।
এ দফায় আম্মানের হোটেল ইন্টারকনে গিয়ে চমকে উঠি। বিভিন্ন দেশের শতশত সাংবাদিকের ভিড় সেখানে। জর্দান সরকার সেখানে সবাইকে একটি এক্রিডিটেশন কার্ড বানিয়ে দিচ্ছিল। ইরাক সীমান্ত তখন জর্দানের নিয়ন্ত্রনে। তাই সীমান্তে বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা সেই কার্ড দেখিয়ে ইরাকে ঢুকছিলেন।
সেই নাবিলের গাড়িতে একদিন মসুল যাচ্ছিলাম। পথ যেতে যেতে নানা বিবরন বলে যাচ্ছিলেন নাবিল। এক জায়গায় গিয়ে বারবার বলছিলেন নবী ইউনুস নবী ইউনুস! আমি নাবিলকে জিজ্ঞেস করি, কোন নবী ইউনুস?
যার নামে মুসলমানরা বিপদে পড়লে খতম ইউনুস পড়েন, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্তি কুন্তু মিনাজ জয়ালিমিন। ইনি কী সেই নবী ইউনুস? নাবিল, হ্যাঁ বলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বললাম গাড়ি থামাও। আমি ভেতরে যাবো।
অন্ধকার মাজার এলাকায় ঢুকেছি। মার্কিন বাহিনী গোটা ইরাকের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়ায় সে ইসলামের হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সেই মাজারটিও তখন অন্ধকার। মোমবাতির মৃদু আলো ছিল ভরসা।
অনেক নারী-পুরুষ তখন সেখানে জিয়ারতের দোয়া-দুরুদ পড়ছিলেন। হযরত ইউনুস (আঃ) এর মাজারের ভিতরেও মহিলাদের জিয়ারতে দেখে চমকে উঠি।
কারন আমরা সারাজীবন দেখেছি বাংলাদেশে হযরত শাহজালাল (রঃ), হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজারে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ারও প্রবেশাধিকার নেই। মাজারের নীচের মসজিদে দোয়া করে ছবি তুলে তাদের বরাবর চলে আসতে হয়।
ইরাকের মসুলের সেই হাজার বছরের পুরনো হযরত ইউনুস (আঃ) এর মাজার বোমায় উড়িয়ে দিয়েছিল আইএস এর জঙ্গীরা।