নানা কারনে বিলাতের প্রিয়মুখ আমিন আলী ভাইকে আমি ভুলতে পারিনা। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে তাঁর বাড়ি। লন্ডনের বিখ্যাত রেডফোর্ট রেষ্টুরেন্টের মালিক। লন্ডনের শীর্ষদশ রেষ্টুরেন্টের তালিকা করতে গেলে রেডফোর্টকে এর নাম বাদ দেয়া যায়না। প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রভাবশালী ব্যক্তিটির রোজকার বেশভূষা খুব সাধারনত। থাকেনও সবকিছুতে নেপথ্যে। কিন্তু নেপথ্যের এই আমিন আলী বিলাতের রাজনীতিতে, বিশেষ করে লেবার পার্টিতে কতোটা প্রভাবশালী তা আমি লন্ডনে নিজে দেখেছি। ২০০৬ সালে আমি একবারই বিলাতে যাই। সাপ্তাহিক জনমত আমার সেই বিলাত ভ্রমনের আয়োজন করে। তখন আমি ঢাকা থেকে জনমতে লিখতাম। জনমতের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাশ পাশা তখন জনকন্ঠের বিলাত প্রতিনিধি ছিলেন। খায়খাতিরের যোগসূত্র সেখানেই। লন্ডনে গিয়ে দেখি সিলেটের অনেক সাংবাদিক। আমার এমসি কলেজ জীবনের অনেক বন্ধু-সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয় লন্ডনে। দীর্ঘদিন পর স্মরণীয় এক গেটটুগেদার।
কিন্তু আমার বিলাত যাত্রার আগেই লেবাননে হিজবুল্লাহ-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমার নতুন রুট হয় ঢাকা-দুবাই- দামাস্কাস-বৈরুত হয়ে লন্ডন। কারন যুদ্ধ সাংবাদিকতা আমার বিশেষ পছন্দের ছিল। ওই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে লেবানন পৌঁছাটাই ছিল আরেক যুদ্ধ। কারন বৈরুত বিমান বন্দর ইসরাইলিরা ধংস করে দিয়েছিল। সে বিষয়গুলো আরেকদিন লিখবো। একজন ‘সিলোটি’ অথবা ‘মলইবাজারি’ হিসাবে বিলাতে আমারও অনেক আত্মীয়স্বজন। কিন্তু আমি লন্ডন পৌঁছার আগে সবাইকে জানিয়ে রাখি আমি থাকবো সাংবাদিক ইসহাক কাজলের বাসায়। ঢাকায় সাংবাদিক জীবনের সময় শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ কেন্দ্রিক ইসহাক কাজলের চা শ্রমিক নেতৃত্ব আর তৃণমূল সাংবাদিকতা আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। ঘোষনা অনুসারে হিথরো বিমান বন্দরে আমাকে রিসিভ করে বাসায় নিয়ে যান কাজল ভাই। লন্ডনের মিডিয়া পাড়ার লোকজন তখন মোটামুটি জানতেন ইসহাক কাজল হোটেল এন্ড রেষ্টুরেন্টে আমি থাকি-খাই আর বিলাত ঘুরে বেড়াই আর প্রতিদিন জনকন্ঠে লিখি ‘বিলাতের পথে পথে’। অনেকদিন ধরে অসুস্থ প্রিয় ইসহাক কাজল ভাই।
এখন আমিন আলী’র প্রসঙ্গে আসি। মূলত সৈয়দ নাহাস পাশার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। প্রথম দিন থেকেই সখ্য হয়ে যায়। সম্ভবত সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানের সঙ্গেও তাঁর দেখা হয়ে থাকতে পারে। এরজন্যে আমাকে তিনি প্রায় ভুল করে পীর ভাই বলে ডাকতেন। আমি মজা করে তাকে বলতাম পীর-মুরিদ কিছুই হবার যোগ্যতা আমার নেই ভাই। আমিন আলী আমাকে ম্যানচেস্টারে লেবার পার্টির সম্মেলনে নিয়ে গেলেন। সারারাত গাড়ি চালালেন নাসা পাশা। পথে পথে অনেক গল্প। এর আগে এক ঘটনা ঘটে। লেবার পার্টির সম্মেলন, হাউস অব কমন্সে যেতে নাকি স্যুটেট-বুটেড হয়ে যেতে হয়। কিন্তু আমিতো জিন্স পার্টি। জিন্স-টি শার্টই বেশি পরি। অতএব আমার জন্যে জরুরি ভিত্তিতে স্যুট-টাই, ম্যাচ করে জুতো কেনা হলো। আমার লেখার সঙ্গে আপনারা যে ছবি দেখেন এটা কিন্তু লন্ডনে স্যুটেট-বুটেট করার পর টেমস নদীর পাড়ে তোলা। ফটোগ্রাফার অবশ্যই সৈয়দ নাহাস পাশা ভাই। বিশ্বাস করুন সেই ম্যানচেস্টারে লেবার পার্টির সম্মেলন-হাউস অব কমন্সে দিওয়ালির এক অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোন দিন পরিনি।
আমিন আলী ভাই একদিন আমাকে বললেন পীর ভাই একটা কাজ করতে হবে। রুশনারা আলীর একটা ইন্টারভ্যু করতে হবে। আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিলাতে লেবার পার্টির জন্যে এতোকিছু করি, কিন্তু আমাদের কমিউনিটির কোন এমপি নেই। এবার আমার লেবার পার্টির কাছে একজন এমপি ক্যান্ডিডেট চাইবো। এবং সেটি রুশনারা আলী। তাঁর আগ্রহ দেখে আমি বললাম, আমি লিখি বাংলায়। বাংলাদেশে জনকন্ঠে রুশনারা আলীর ইন্টারভ্যু ছাপা হলে বিলাতের লেবার পার্টি তাঁকে এমপি ক্যান্ডিডেট করবে কেনো। আমিন আলী ভাই আমাকে বলেন আপনি রুশনারার ইন্টারভ্যু করে জনকন্ঠে ছাপার ব্যবস্থা করুন। আমরা সেটি অনুবাদ করে লেবার পার্টিকে দেবো। সেই আয়োজন হলো। একদিন ব্রিকলেনের জনমত অফিসে আসেন রুশনারা আলী। ২০০৬ সালের কথা লিখছি। সেলোয়ার কামিজ পরা মাথায় ওড়না দেয়া সাদামাটা পোশাকের এক প্রবাসী বাংলাদেশি সিলেটি নারী। তাঁকে নারী লেখার কারন তখনই তাঁর বড়বড় ছেলেমেয়ে। আমার সঙ্গে সিলেটি ভাষাতেই কথা হয়। বুঝতে পারি ইংরেজির পর সিলেটি ভাষাতেই তিনি স্বচ্ছন্দ। তাঁর সেই ইন্টারভ্যু জনকন্ঠে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল। এবং সম্ভবত সেটিই বাংলাদেশের কোন জাতীয় কাগজে ছাপা প্রথম ইন্টারভ্যু। এরপর ২০১০ সালে যখন রুশনারা আলী মনোনয়ন পেলেন এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিজয়ী হন তখনও আমার আমিন আলী ভাইর কথা মনে পড়েছে।
সেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এখন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চার নারী এমপি। রুশনারা আলী, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, রূপা হক এবং আফসানা হক। এদের সবাইকে পথ দেখিয়েছেন রুশনারা আলী। স্বপ্ন দেখিয়েছেন আমার জানামতে প্রিয় আমিন আলী ভাইদের মতো কয়েকজন। বিলাতে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদির যাওয়া-খাওয়া বন্ধেও তাঁর একটি নেপথ্য ভূমিকা ছিল। যা আরেকদিন লিখবো। “চাইর কইন্যা বাংলাদেশি” এমপির মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকের ব্রিটিশ এমপি হওয়াটাকেও আমি ব্যতিক্রমী হিসাবে দেখি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যরা বংশানুক্রমে এখানে এমপি-মন্ত্রী হতে চান। উপজেলা চেয়ারম্যান-ইউপি চেয়ারম্যান কোন সুযোগ কেউ জাড়তে চাননা। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বিদেশে থাকা তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার শরণার্থী জীবন কেটেছে। ওই অবস্থায় বিলাতে বিয়ে হয় শেখ রেহানার। তাঁর দুই সন্তান ববি-টিউলিপের জন্ম হয় লন্ডনে। এমন একটি পরিবারের সদস্যা টিউলিপের এটি ভিন্ন এক অভিষেক। বিদেশে যারা থাকেন তাদের জন্যে ভিন্ন অনুপ্রেরনা এই চার কন্যা। প্লিজ বিদেশে দেশি রাজনীতির গ্রুপিং-মারামারির পথ বাদ দিয়ে এই চার কন্যার দৃষ্টান্তকে অনুসরন করুন। এতে দেশের সুনাম-পরিচিতি বাড়বে। চার কন্যাকে অভিনন্দন। আমার ‘চাইর কইন্যা বাংলাদেশি’। নেপথ্যের আমিন আলীর মতো স্বাপ্নিকদের কৃতজ্ঞতা। জয় বাংলা।